আগুনের ফুলকি, খোলা চুলের নিশান আর প্রতিবাদের নতুন ভাষ্য
১
বেশিদিন নয়, এই মাত্র বছর তিনেক আগের কথা। ফুটবল খেলা দেখার ভারি শখ হয়েছিল একটি মেয়ের। কিন্তু তার দেশে মেয়েদের ফুটবল স্টেডিয়ামে ঢোকা নিষেধ। এমনিতেই সে দেশে মেয়েদের পায়ে পায়ে বেড়ি পরানো। নিষেধের বেড়ি। বোরখা ছাড়া রাস্তায় বেরোনো যাবে না, পাছে শরীরের উঁচুনিচু দেখে ফেলে কোনও পুরুষ হোঁচট খায়। চুল খুলে রাখা যাবে না, ঢেকে রাখতে হবে হিজাবের কড়া শাসনে। খোলা চুলের অবাধ্যতায় যদি কোনও পুরুষের মনে দোলা লাগে! তেমনভাবেই, খেলার স্টেডিয়ামেও ঢুকতে পারবে না মেয়েরা। না মানে, খেলা দেখার উত্তেজনায় পুরুষদের মুখ থেকে যেসব শ-কার ব-কার বেরোবে, তা কানে আসা কি কোনও নারীর পক্ষে সমীচীন? এত যত্নে যে তাদের চার দেওয়ালে আর বোরখার আড়ালে পুরে রাখা হয়েছে, সে তো তাদের শ্লীলতা বাঁচানোর জন্যেই। এই সব যুক্তিই জানত সেই মেয়ে। তবুও কেন কে জানে তার মনে হয়েছিল, এই সবগুলোই আসলে স্রেফ মেয়েভুলানো বুলি। তাই ২০১৯-এর মার্চ মাসে চুপচাপ পুরুষের ছদ্মবেশে আজাদি স্টেডিয়ামে পৌঁছে গিয়েছিল সে। কিন্তু বাস্তবটা যেহেতু সিনেমার মতো হয় না, তাই ঢোকার মুখেই ধরা পড়ে গিয়েছিল মেয়েটি। বিচার হয়েছিল আইনমাফিক। হ্যাঁ, বেআইনেরও একটা আইন থাকে বইকি। হাজার হোক, সময়টা যে একুশ শতক। 'দ্য স্টোনিং অফ সুরাইয়া এম'-এর মতো স্রেফ পাথর ছুড়ে একটা মেয়েকে মেরে ফেলায় অনেক হ্যাপা এখন। মানবাধিকার কমিশন, রাষ্ট্রসংঘ, বিশ্বশান্তি... বিষ না থাক, কুলোপানা চক্কর তো আছেই। তাই আইন মেনে বিচার হয়েছিল ২৯ বছরের সাহার খোদায়েরির। একুশে আইন মাফিক সেই বিচারের রায় বেরোবার আগেই, রাষ্ট্রের পা থেকে বলটা কেড়ে নিয়েছিলেন ফুটবলপ্রেমী সাহার। রায় বেরোবার দিনটিতেই আদালত চত্বরেই গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। আর লড়াইটা শুরু হয় তার পর থেকেই।
২
"খণ্ড তাকে খণ্ড করে ছড়িয়ে দিয়ে যারা
ভাবছে খতম। ভেবেছে নিষ্প্রাণ
তাদের আশা ভঙ্গ করে জাগছে সতীপীঠে
একের লড়াই অন্য কারও তেজে"...
সেদিন সাহার খোদায়েরির পুড়তে থাকা শরীর থেকে আগুনের ফুলকি ছিটকে গিয়েছিল সারা ইরানে। ডাক এসেছিল খেলা বয়কটের। প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল দেশে। অবশেষে, একটি মেয়ের প্রাণের দামে ইরানের সব স্টেডিয়ামের দরজা খুলে গিয়েছিল মেয়েদের জন্য।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি বোধহয় একেই বলে। আসলে ইতিহাস থেকে তো শিক্ষা নেয় না কোনও দেশের কোনও শাসকই। আর সেই কারণেই ভুলের পরে ভুল আর তারপরে ভুলের মাত্রাবৃত্ত রচিত হতে থাকে। আর এই পুনরাবৃত্তির পালটা হিসেবেই লেখা হয়ে চলে মারের মুখের ওপর দিয়ে চলার গল্প। যেমনটা লেখা হচ্ছে আজ।
চলতি মাসের ১৩ তারিখে কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরানের দিকে যাওয়ার পথেই মাহসা আমিনির গাড়ি থামিয়েছিল ইরানের নীতি পুলিশ। সেই ইরান, যেখানে একসময় বিকিনি পরে সমুদ্রস্নানে যেতেও বাধা ছিল না মেয়েদের। যেখানে ছয়-সাতের দশকেও পশ্চিমি ধাঁচের স্কার্ট পরা মেয়েদের দেখা যেত রাস্তায়। তারপর, গল্পটা পালটে গেল। ইরানে ততদিন রাজতন্ত্রই চলছিল, তবে তার পিছনে জারি ছিল পশ্চিমি দুনিয়ার সমর্থন। কিন্তু সেই সময়ের শাসক, শাহ মহম্মদ রেজার দুর্নীতি আর স্বৈরাচার নিয়ে বিরোধও ঘনিয়ে উঠছিল ভিতরে ভিতরে। আর তার জেরেই ১৯৭৯ সালে ইরানের দুই রাজনৈতিক দল, দক্ষিণপন্থী ন্যাশনালিস্ট পার্টি আর বামপন্থী তুদে-রা ডেকে আনে নির্বাসিত আয়াতুল্লাহ রুহউল্লাহ খোমেনিকে। যে খোমেনি বছর কয়েক পরেই সলমন রুশদির মাথা কেটে নেওয়ার ফরমান জারি করবেন, 'স্যাটানিক ভার্সেস' লিখে ইসলামের অবমাননা করার অভিযোগে। বলাই বাহুল্য, খোমেনি কট্টরপন্থী মুসলিম। সুতরাং গদি ওলটাল, আর তার সঙ্গে সঙ্গেই উলটেপালটে গেল গোটা দেশটাও। ১৯৭৯ সালের ইসলামিক বিপ্লবের পর থেকেই দেশের মেয়েদের জন্য হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করল প্রশাসন। বাইরে বেরোলে মেয়েরা যথাযথ 'পোশাক' পরছে কি না, তার উপরে নজরদারি চালাবার জন্য বরাদ্দ হল নীতি পুলিশ। আর সেই নীতি পুলিশেরাই সেদিন গ্রেপ্তার করেছিল মাহসাকে। কেবল, মাথায় হিজাব ছিল না বলে। কিন্তু পুলিশি হেফাজতে গিয়েই যে কী করে কোমায় চলে যেতে পারে ২২ বছরের একটা তরতাজা মেয়ে, সে গল্পটা কিছুতেই ঠিক বানিয়ে উঠতে পারছে না বেচারা পুলিশ প্রশাসন। আর সেই ফাঁকটা দিয়েই ঢুকে পড়ছে হাজার হাজার মেয়ে। ঢুকে পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। পুলিশরা আর কী করবে ভেবে না পেয়ে কেবল গুলি চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই নিহতের সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়েছে। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি অনড়। খোদ সিএনএন-এর মুখ্য সাংবাদিককেও হিজাব পরানোর সবক শেখাতে চান তিনি। আমেরিকান সাংবাদিক ক্রিস্টিন আমানপোর হিজাব না পরায় পূর্বনির্ধারিত সাক্ষাৎকার বাতিল করে কার্যত নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট। তবু লড়াই ছাড়ছেন না ইরানের মেয়েরা। মাহসা আমিনির মৃত্যুর পর তাঁর নাম নিয়েই রাস্তায় নেমে এসেছেন তাঁরা। যে চুল ঢেকে রাখার জন্য এত নিদান, সেই লম্বা চুল কেটে পতাকা বানিয়ে টাঙিয়ে দিচ্ছেন তাঁরা। গড়ে উঠছে প্রতিবাদের নয়া বয়ান। যেমন নিজস্ব বয়ান তৈরি করেছিলেন সাহার খোদায়েরি। হিজাব খুলে আগুনে ছুড়ে দিচ্ছেন ইরানের মেয়েরা। যে শরীরকে ঢেকে রাখার জন্য এত রক্তচক্ষু, সেই শরীরকেই ভরা রাস্তায় উন্মুক্ত করছেন তাঁরা। আর সেই ক্যানভাসেই রক্তের অক্ষরে ফুটে উঠছে মাহসা আমিনির নাম। কোনও ‘মেয়েদের যা করা উচিত'-সুলভ তত্ত্বের ছায়ায় নয়, এবার তাঁরা নিজেরাই লিখছেন নিজেদের প্রতিবাদের বর্ণমালা। আর সেইসব অক্ষরের তলায় গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অবদমনের আসুরিকতা। নারীপক্ষের সূচনা হচ্ছে— এ দেশে নয়, ও দেশেও।
কবিতা-ঋণ : অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়
............................................................
সিরিজ-পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র
#Iran #Mahsa Amini #ইরান #নারীপক্ষ #মাহশা আমিনি #silly পয়েন্ট