ফিচার

ভারতীয় পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের জনক: প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ

মন্দিরা চৌধুরী Dec 17, 2021 at 6:47 am ফিচার

১৯৬১ সালের মাঝামাঝি সময়ে বেশ চাঞ্চল্যকর একটা ঘটনা ঘটেছিলো। গোদাবরী নদীর তীরে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চলাকালীন পাওয়া গিয়েছিল একটা ডাইনোসরের জীবাশ্ম, তার বয়েস প্রায় ১৬০ মিলিয়ন বছর। সেই বছর ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী, তাই সেটার নাম দেওয়া হল বড়পাসরাস টেগরি। এই খননকার্য চালাচ্ছিলেন কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট বা ISI-এর ভূবিজ্ঞানীরা। সেই জীবাশ্ম এখনও ISI তেই রাখা আছে। খটকাটা লাগে এখানেই, ISI বিখ্যাত রাশিবিজ্ঞান চর্চার প্রতিষ্ঠান হিসেবে, সেখানে ভূবিজ্ঞানী আর প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য! আজকের দিনে বিভিন্ন বিষয়ের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষণা সংস্কৃতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, কিন্তু এত বছর আগেই একই প্রতিষ্ঠানে আলাদা আলদা বিজ্ঞানীদের কাজের পরিসর তৈরি করে দিয়েছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউটে।

ছোটো থেকে প্রশান্তচন্দ্র বেড়ে উঠেছিলেন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত দিক থেকে উৎকৃষ্ট একটি পরিমণ্ডলে। তাঁর পারিবারিক আদি নিবাস বর্তমান বাংলাদেশের বিক্রমপুরে। তাঁর ঠাকুরদা যৌবনে কলকাতায় চলে আসেন। তিনি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন, সেই সময়ে তিনি বিধবা বিবাহ করেছিলেন। প্রশান্তচন্দ্রের জন্ম হয় ১৮৯৩ সালে কলকাতার কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়িতে। তাঁর জ্যাঠামশাই ছিলেন রয়্যাল সোসাইটি অফ এডিনবার্গ-এর ফেলো এবং কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিওলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান। কলকাতায় ফিরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে শারীরবিদ্যা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর স্ত্রী ছিলেন কেশবচন্দ্র সেনের কন্যা মনিকা সেন। প্রশান্তচন্দ্রের মামা ছিলেন প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসক নীলরতন সরকার। প্রশান্তচন্দ্রের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় কলকাতার ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুলে। এরপর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন, সেখানে শিক্ষক হিসেবে পান জগদীশ চন্দ্র বসু এবং প্রফুল্ল চন্দ্র রায়-কে।

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হওয়ার পর উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য প্রশান্তচন্দ্র পাড়ি দিলেন লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু তীরে এসে তরী ডুবলো, জাহাজ বন্দরে ভিড়তে দেরি হওয়ায় ট্রেন ধরতে পারলেন না তিনি৷ তবে এই ট্রেন ফেল করার ঘটনাই এরপর বদলে দেবে প্রশান্তচন্দ্রের জীবনের গতিপথ। স্থানীয় এক পরিচিতের বাড়িতে সে রাতটা কাটান তিনি, আর সেই সময়েই মত পরিবর্তন করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার পরিকল্পনা বাতিল করে তিনি ভর্তি হন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংস কলেজে, গণিত আর পদার্থ বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে। এই সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া গেল কিছুদিন বাদেই, সেবছর একমাত্র তিনিই পদার্থবিদ্যায় প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সিনিয়র রিসার্চ ফেলোশিপ দিয়ে সম্মানিত করে। তারপর ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরিতে নোবেলজয়ী পদার্থবিদ চার্লস টমসন রিজ-এর তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন প্রশান্তচন্দ্র। এখানে গবেষণা চলাকালীন তাঁর সঙ্গে আলাপ হয় গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজনের, ক্রমশ যে আলাপ গড়াবে বন্ধুত্বে। 

গবেষণার মাঝে প্রশান্তচন্দ্র দেশে ফেরার জন্য কিছুদিন ছুটি নেন। বিশ্বযুদ্ধের জন্য জাহাজ ছাড়তে দেরি হওয়ায় হাতে বাড়তি কিছু সময় পান, সেই সময়ে তাঁর হাতে আসে কার্ল পিয়ার্সনের 'বায়োমেট্রিকা'। নয় খণ্ডের পুরো বইটি কিনে নিয়ে জাহাজে উঠলেন প্রশান্তচন্দ্র। সেদিন বোধহয় তিনি নিজেও ভাবতে পারেননি যে এই বইই তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবে, তাঁর হাত ধরে জন্ম নেবে বিজ্ঞানের নতুন এক শাখা। এরপর আর গবেষণার জন্য ইংল্যান্ডে ফেরা হয়নি প্রশান্তচন্দ্রের, প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন তিনি। অধ্যাপনা শুরু করলেও তাঁর মাথায় তখন সবসময়ে ঘুরছে বায়োমেট্রিকা। কিছুদিন পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীল প্রশান্তচন্দ্রের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফলাফলের পরিসংখ্যানগত বিশ্লেষণের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। তিনি অত্যন্ত নৈপুণ্যের সঙ্গে এই কাজ করে দেন। এটাই ছিল ভারতবর্ষে রাশিবিজ্ঞান সংক্রান্ত প্রথম আধুনিক কাজের প্রস্তাবনা। প্রশান্তচন্দ্রের বয়েস তখন মাত্র চব্বিশ বছর। এর বছর তিনেক পরে অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভের অধিকর্তার কাছ থেকে পাওয়া কলকাতায় বসবাসকারী কিছু অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে এদের বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক আলোচনা করেন। পরবর্তী প্রায় দেড় দশক ধরে এই বিষয়ের গবেষণা থেকেই জন্ম নেয় বিখ্যাত 'মহলানবীশ ডি-স্কোয়ার্ড'। এখনও পর্যন্ত এই তত্ত্বের জন্যই আন্তর্জাতিক স্তরে প্রশান্তচন্দ্রের খ্যাতি।

প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রশান্তচন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন স্ট্যাটিস্টিক্যাল ল্যাবরেটরি। এই ল্যাবরেটরিতেই বীজ বপন হয় ভবিষ্যতের ISI-এর। পরবর্তীকালে এখান থেকেই রেজিস্টার্ড সোসাইটি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ISI, ১৯৩১ সালে যা স্থানান্তরিত হয়ে চলে আসে প্রশান্তচন্দ্রের বরানগরের বাড়িতে। প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিকে প্রচণ্ড অর্থকষ্ট ছিল, এমনকী আংশিক সময়ের অধ্যাপকরা মাত্র পাঁচ টাকা সাম্মানিকের বিনিময়ে এখানে পড়াতেন। ১৯৫৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ISI-কে Institute of National Importance ঘোষণা করে, তার ফলে প্রতিষ্ঠানের খরচ চালানোর জন্য সরকারি অনুদান আসতে থাকে। এই দিক থেকে বিচার করলে ISI কিন্তু দেশের প্রথম স্বীকৃত National Institute, IIT বা IIM-এর আগেই ISI এই স্বীকৃতি পেয়েছিল।

আরও পড়ুন : বিস্মৃতির অতলে ভারতের প্রথম কম্পিউটারের নির্মাতা সমরেন্দ্র কুমার মিত্র / অলর্ক বড়াল 

প্রশান্তচন্দ্র জাতীয় স্তরে অনেক কাজ করেছেন, জাতীয় পরিকল্পনায় তাঁর অবদান যুগান্তকারী। জওহরলাল নেহেরুর অনুরোধে তিনি কংগ্রেসের বার্ষিক রিপোর্টের পরিসংখ্যানগত অংশ লিখে দেন। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও তাঁর অবদান অসামান্য। তিনি শ্রীনিবাস রামানুজন স্বর্ণপদক, স্যার দেবীপ্রসাদ সর্বাধিকারী স্বর্ণপদক, অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ওয়েলডন স্মৃতি পুরস্কার পান। । ১৯৬৮ সালে প্রশান্তচন্দ্র পদ্মবিভূষণ পুরস্কার পান। এছাড়াও তিনি ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমির ফেলো, ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের সভাপতি(১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ), আমেরিকার পরিসংখ্যান সমিতির ফেলো ছিলেন। তাঁর বিপুল কর্মকান্ডের কথা মাথায় রেখে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ২০০৬ সালে তাঁর জন্মদিন ২৯ জুনকে জাতীয় পরিসংখ্যান দিবস হিসাবে পালনের মাধ্যমে প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশকে বিশেষ স্বীকৃতি প্রদান করা হয়।


আরও পড়ুন : রবীন্দ্রনাথের কথায় কবি হবার উৎসাহ হারিয়েছিলেন শিবরাম?

# প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ # দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর #প্রেসিডেন্সি কলেজ #মন্দিরা চৌধুরী #ফিচার #ওয়েব পোর্টাল #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

74

Unique Visitors

214955