রূপকথার গল্প : নারীর কণ্ঠ পুরুষের স্বর
এক-একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে আর আমরা গোটা দেশ বিধ্বস্ত হয়ে যাই বারবার। সংস্কৃতির ভিত্তি নড়ে যায় আমাদের, আমরা হাতড়ে দেখি ভুল কোথায় ছিল। কোন ত্রুটিতে আজ আমরা এরকম নারকীয় নৃশংস এক-এক ঘটনাকে বহন করছি। পুরুষতন্ত্রকে বিশ্লেষণ করি বারবার, পৌঁছে যাই পিতৃতন্ত্রের দোরগোড়ায় আর দেখি পুরুষতন্ত্র কেবল পুরুষের একার নয়, তা নারীরও। পুরুষ এবং নারী উভয়েই নিবিড়ভাবে বিশ্বাস করেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে। ব্যক্তি পুরুষ যত না করেন, তার থেকে ব্যক্তি নারীর এই ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস, আস্থা অনেক বেশি। আর তাই-ই “রমণীতন্ত্র” বলে কোনও শব্দই তৈরি হয় না, যেমন রমণী শব্দের কোনও পুরুষবাচক শব্দই নেই! কারণ পুরুষকে রমণ করেন যিনি তিনিই রমণী, আর নারীকে রমণ করার প্রয়োজন বা প্রশ্ন কোনোটাই নেই।
এই একপেশে জীবনের গল্পই তাই লুকিয়ে থাকে আমাদের সাধারণ ঐতিহ্যে। মুখে মুখে প্রচলিত লোককথায়ও। রূপকথায় রাজা-রানির প্রেম ভালোবাসার চেয়ে প্রাধান্য পেয়ে যায় নারীদের ওপর অত্যাচারের কাহিনি। কিন্তু নারীদের সেইসব অত্যাচার এক নারীর আর-এক নারীর ওপর। এক নারীর ঈর্ষা আর-এক নারীকে অসহায় করছে— সেইসব গল্প। সুয়োরানিদের অত্যাচার দুয়োরানির ওপর। অসহায়া দুয়োরানি তার সতিন কিংবা দিদিদের চক্রান্তে হারাচ্ছে তার রাজসুখ, স্বামী, সন্তান, সংসার। সুয়োরানিদের কথামতোই কখনো অরুণ বরুণ কিরণমালাকে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বুদ্ধু ভুতুমের নির্বাসন হচ্ছে, কিংবা সাত ভাই চম্পা হারিয়ে যাচ্ছে, আর সর্বোপরি, ভুল সন্তান জন্মের দায় একা নিয়ে তাদের মায়েরা বনবাসে যাচ্ছে। এসবই হচ্ছে সুয়োরানিদের চক্রান্তে।
নজরে থাকুক
যে মেয়েটির নাম কেউ-না / প্রতিভা সরকার
রূপকথার গল্পে খুব স্পষ্ট করে থাকছে এই দুই বিভাজন। ভালো মেয়ে খারাপ মেয়ে। দরিদ্র, অসহায়া দুয়োরানি ভালো আর ঈর্ষাপরায়ণ, দাপুটে সুয়োরানিরা খারাপ। এই বিভাজন আরও স্পষ্ট হয়ে কোনও কোনও গল্পে মানবী আর রাক্ষসীতে পরিণত হচ্ছে।
রাজার দুই রানি, মানুষ রানি আর রাক্ষসী রানি। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’-তে সংকলিত বিখ্যাত ‘লালকমল আর নীলকমল’ গল্পের শুরু। রাক্ষসী রানিকে অবশ্য বাইরে থেকে দেখে বোঝা যায় না, সেও মানুষ সেজে থাকে। শুধু সতিন পুত্রকে খেতে দেবার সময় তার নোলা দেখে ফেলে রাজপুত্র। কিন্তু রাক্ষসী রানির যে সন্তান, নীলকমল, সে কিন্তু দাদার অনুগামী। সে-ই মায়ের সাথি হয়ে হত্যা করে নিজের দিদিমার বংশ, মানে রাক্ষসের বংশ। এই একই গল্প শুনেছিলাম উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ির কাছের একটা গ্রাম দেউলটি থেকে। সেখানে বক্তা পদ্ম দাসী খুব স্পষ্টই বলেছিলেন, দুধকলম (লালকমল নয়) আর নীলকলমের গল্প আর নীলকলমের নিজের রাক্ষসী মাকে মেরে ফেলার গল্প। -- “তখন একটা রাগ হল যে কী রে, --মাইরা ফেলাইল, কালকে তো তাহলে দুধকলমকেও মাইরা ফেলাবে, পরশু দিন তো তাহলে আমাকেও খাইয়া ফেলাবে। তাহলে তো, রাক্ষসের বংশ তো না মারলে হবে না, ধ্বংসাতে হবে । তখন কয়েকদিন পর ও ওর মাকে মেরে ফেলায়।”
এই রাক্ষসের বংশ থেকে কেমন করে যেন রক্ষা পেয়ে যায় রাক্ষসরানির সন্তান নীলকমল। বরং নিজ মাকে হত্যা করে সে হয়ে ওঠে নায়ক। মাতৃহত্যা কত সহজে মহিমান্বিত হয়ে ওঠে নারীটিকে দোষী সাব্যস্ত করলে। এই জাজমেন্টাল ব্যবস্থা কিন্তু একা নারীদের জন্যই। কে হবে রাক্ষসী, কে হবে রানি, সেটা নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে কোন এক অলক্ষ নির্দেশে। এবং আজও ভারতবর্ষে ডাইনিদের গ্রামছাড়া করার মতো বা হত্যা করার মতো ঘটনা এতই সুলভ যে, তার পিছনে এই কাহিনিগুলির বিস্তার একধরনের নৈতিক সমর্থন জারি রেখেছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠতে পারে।
‘ঠাকুরমার ঝুলি’-র ‘সুখু দুখু’ গল্পে এই বিভাজনের কারণ খুব স্পষ্ট করা হয়েছে। কীরকম স্বার্থত্যাগ আর লোভহীনতার জন্য দুখু সুন্দর হল, গা ভর্তি গয়না পেল, চাঁদের বুড়ির উপহার পেল এবং লোভ করার জন্য সুখু কীভাবে কুৎসিত হল, সম্পদ থেকে বঞ্চিত হল, সেই গল্প শুনিয়ে মেয়েদের জীবনাচরণ কেমন হবে স্পষ্ট করা হয়েছে সেই প্রেসক্রিপশনে। আর নারীরাই বহন করছেন এই বিশ্বাস, পুরুষতান্ত্রিকতাকে। চাহিদা খারাপ, সাজগোজও খারাপ, আর আত্মত্যাগ সুন্দর, আভরণহীনতাও সুন্দর, এই বক্তব্য স্পষ্ট ধারায় প্রবাহিত করা হয়েছে, কারণ হিসেবমতো ‘ভালো মেয়ে’ ছাড়া এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা অচল। ভালো মেয়ে - খারাপ মেয়ের মতো ভালো ছেলে - খারাপ ছেলের কোনও নিয়মাবলিকেন্দ্রিক গল্প নারীমহল পুরুষমহল কোথাওই প্রচলিত নয়।
আর সবচেয়ে মজার হয়তো এটাই, রূপকথার সাম্রাজ্যে, লিখিত বা মৌখিক, কোথাও কিন্তু পুরুষের কোনও কাজের জন্য জবাবদিহি চাওয়া হয় না। তার কোনও কাজকেই প্রশ্ন করা হয় না। বরং যে ছলনাময়ী নারীটি সুন্দরী সেজে রাজাকে ভুলিয়ে অরণ্য থেকে এসে বিয়ে করেছে, তাকেই শাস্তি দেওয়া হয়, তাকেই দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
এই নারীই কখনো সুয়োরানি, কখনো রাক্ষসী রানি, কখনো ছদ্মবেশী দাসী। কিন্তু কোথায় পুরুষেরা? সাধারণ লোককথায়, বিশেষত রূপকথায় নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচারের গল্প প্রায় নেই। ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘বুদ্ধু-ভুতুম’ কিংবা ‘অরুণ-বরুণ-কিরণমালা’-য় রাজারা প্রায় কিচ্ছু বোঝেন না, ভাবেন না, অথচ বড় রানিদের কথায় ছোট রানির সন্তানজন্মের ভ্রান্তি বিশ্বাস করেন পুরোটাই। অনায়াসে মেনে নেন মানুষের পেটে বিড়ালছানা-কুকুরছানা কিংবা কাঠের পুতুল হয়েছে। রাজাদের সম্পূর্ণ ঔদাস্যের মধ্যেই নির্বাসন হয়ে যায় ছোটরানির।
গল্পের শেষে তাই শাস্তি হয় সুয়োরানিদের। রাজা বাদ থাকেন এই শাস্তি থেকে। বরং তাঁকে সুযোগ দেওয়া হয় ভুল বোঝা থেকে সঠিক উপলব্ধির। কিন্তু কাহিনিতে একবারও আসে না কেন রাজারা একাধিক বিবাহ করলেন সেই প্রশ্ন। কেন সুয়োরানিরা থাকতেই দুয়োরানিদের প্রবেশ ঘটে? একাধিক রানি থাকতেও রাজার সন্তানহীনতার মূল দায় কার? সপত্নীত্ব কি বিনা ঈর্ষায় মেনে নেওয়া সম্ভব? যদি পুরুষকে এইভাবে স্ত্রীর অধিকার অন্যের সঙ্গে ভাগ করে নিতে হত? সুয়োরানিদের জন্য মহিলা গল্পকথকেরাই জীবন্ত কবরের নিদান দেন, কিন্তু ভেবে দেখেন না তাদের অসূয়ার উৎস কতটা যুক্তিসংগত ছিল।
নজরে থাকুক
হাথরস যে নতুন ও পুরোনো প্রশ্নগুলি আবার তুলল / শতাব্দী দাশ
নারীর ওপর পুরুষের অত্যাচার প্রত্যক্ষভাবে ছিল ‘উমনো-ঝুমনো’ গল্পে। মাত্র একখানা করে পিঠে খেয়ে ফেলার অপরাধে মেয়েদের বাবা তাদের জঙ্গলে ফেলে আসেন। আমরা সবাই জানি আমাদের ভারতবর্ষে কন্যাসন্তান আজও কী বিপুলভাবে এই অসাম্য, অবহেলা, নিষ্ঠুরতার শিকার। অদ্ভুতভাবে এই নিষ্ঠুর এবং বাস্তবসম্মত গল্পটি কোনও বিখ্যাত রূপকথার সংকলনে স্থান পায় না। ব্রতকথার মোড়কে গল্পটিকে পাওয়া যায়, যেখানে মেয়েদুটি তাদের বাবাকে ক্ষমা করে দিচ্ছে। তবু কেন এই গল্পগুলিতে মেয়েরা নিজেরাই প্রশ্ন তুলল না? ব্রতপাঠ কিংবা মুখে মুখে বলার সময়েও না?
কেন? উত্তর পাওয়া সোজা নয়। নারীর কণ্ঠস্বরে বারবার মিশে গেছে পুরুষতন্ত্র। নারী নিজে বিশ্বাস করতেই ভুলে গেছে সে নিজে কী চায়। পুরুষতন্ত্রের চাহিদার কাছে আত্মসমর্পণ ঘটেছে তার। আর এ কথাও উল্লেখ না করে পারা যায় না যে বেশিরভাগ রূপকথাই সংকলন করেছেন পুরুষ সংকলকেরা। তবে কি পুরুষ দ্বারা পরিচালিত পুরুষতন্ত্র আর নারী দ্বারা পরিচালিত পুরুষতন্ত্র মিলে সৃষ্টি করেছে এক-এক মধুর কাহিনি, যার আপাত আড়ালে আছে শুধু অন্য এক নারী কর্তৃক অসূয়াজনিত হেনস্থা, নারীর নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দেবার এক ক্রূর ষড়যন্ত্র? মাধুর্যের আপাত আড়ালে তবে কি নিদারুণ পরাজয় হয়ে গেছে নারীর স্বস্তির? শান্তির? বাস্তবে এই ধর্ষণপ্রধান দেশের ছবি, এমনকি দ্রৌপদীর বেদনার আভাসও রূপকথার গল্পে অনুপস্থিত, শুধু পুরুষকে নির্দোষ দেখানোর দায়ে?
তাই নারীকে এই প্রচলিত নারীবিশ্ব থেকে বার করে আনাও আজকের লড়াইয়ের একটা পর্ব হয়ে উঠুক। রূপকথার মাধুর্যের আড়ালে তবে নতুন বিশ্বে স্পষ্ট হয়ে উঠুক তার ষড়যন্ত্রটাও। নারীর কণ্ঠ মুক্ত হোক। লেখা হোক নতুন রূপকথা, যা নারী-পুরুষ কাউকেই অসম্মান না করে মধুর সাহিত্য হয়ে থেকে যাবে।
[ কভার পোস্টারঃ অর্পণ দাস ]