ফিজিক্সে ফেল, অথচ তিনিই বানালেন ‘উড়ন্ত নৌকা’
সায়েন্স নিয়ে না পড়লে জীবন বৃথা – এমনটা ভাবার মতো মানুষ আমাদের মধ্যে সংখ্যায় কম তো নয়ই, কিঞ্চিৎ বেশিই বটে। কিন্তু একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে গিয়ে যদি সে ফিজিক্সে ফেল করে? সেই ছাত্রছাত্রীর ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায় বাবা-মা, পাড়া-প্রতিবেশী সবার মনেই। সম্প্রীতির সঙ্গে এমনটা হয়েছিল নিশ্চয়ই। শুধু হাল ছেড়ে দেওয়ার বদলে আরও শক্ত করে চেপে ধরেছিলেন তিনি। কে জানত, একদিন তাঁর হাত ধরেই দ্রুতগামী নৌকার সংজ্ঞাই পাল্টে যাবে?
কলকাতায় বেড়ে ওঠা সম্প্রীতি ভট্টাচার্যর জীবনটাই হাল ছাড়তে না-চাওয়ার রূপকথা। কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর বাড়িতে প্রথম কম্পিউটার আসে, আর তিনিও বিজ্ঞানচর্চার স্বপ্নটাকে সার্থক করতে লেগে পড়েন। আশেপাশে অনেক বন্ধুই বিদেশে গিয়ে পড়াশুনো করছে, কিন্তু তাঁর রেজাল্টে তো সেই মোয়ার নাগাল পাওয়া সহজ নয়! নাছোড় সম্প্রীতি একের পর এক গবেষণা সংস্থায় ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করা শুরু করলেন। একটা-দুটো নয়, মোট পাঁচশো চল্লিশটা আবেদনপত্র পাঠিয়েছিলেন তিনি, খারিজ হয়েছিল পাঁচশো উনচল্লিশটাই! একমাত্র ফার্মিল্যাব, বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির সম্মানার্থে স্থাপিত আমেরিকার অন্যতম সেরা পার্টিকল ফিজিক্সের গবেষণা সংস্থা, অন্যরকম ভেবেছিল। ফার্মিল্যাব সম্প্রীতিকে সুযোগ দিয়েছিল তিনমাসের গ্রীষ্মকালীন ইন্টার্নশিপের, কিন্তু ফিজিক্সে ফেল করা মেয়েটির আগ্রহ আর অধ্যবসায় তার মেয়াদ বাড়িয়ে দিল আরও নয়মাস। সেই অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা তাঁকে ওহায়ো স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স প্রোগ্রামে প্রবেশাধিকার দিল, সেই সঙ্গে নাসায় স্বল্পসময়ের গবেষণার সুযোগ।
এরপরে স্বাভাবিকভাবেই পিছনে ফিরে তাকাতে হয় না। সম্প্রীতি তাকাননি, বিশ্বখ্যাত এমআইটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পিএইচডি করেছেন। ২০১৪ সালে যখন তাঁর পিএইচডির ব্যস্ততা তুঙ্গে, তখনই দুনিয়া-কাঁপানো এক অঘটন ঘটে – মালয়েশিয়া এয়ারলাইনের ফ্লাইট ৩৭০ দক্ষিণ চিন সমুদ্রের অতলে তলিয়ে যায়। কীভাবে একটানা তল্লাশি চালিয়েও বিমানের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা যাচ্ছিল না, সেই ঘটনা সম্প্রীতিকে রীতিমতো ধাক্কা দিয়ে যায়। সমুদ্রের গভীরে খোঁজাখুঁজি চালানোর মতো প্রযুক্তি যে প্রয়োজনের তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে, সেটা বুঝতে পেরে সেদিকেই নিজের বাড়তি অধ্যয়ন ঢেলে দেন তিনি। পরের বছরেই জনাকয়েক সঙ্গী নিয়ে তৈরি করে ফেলেন নিজস্ব সংস্থা – হাইড্রোসোয়ার্ম। ক্ষুদ্রাকার রোবটের ঝাঁক দিয়ে জলের গভীরে নজরদারি চালানোর প্রযুক্তি তৈরি করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। সমুদ্রতলে কাজ করার মতো ড্রোন বানিয়েও ফেলেছিলেন তাঁরা, কিন্তু সংস্থার প্রকৃত লক্ষ্যপূরণ আর হয়ে ওঠেনি। তবে নাছোড়বান্দা তো সম্প্রীতির ডাকনাম হয়ে গেছে ততদিনে, তাই আবার তৈরি করলেন নতুন সংস্থা – নেভিয়ার।
সম্প্রীতির মূল উদ্দেশ্য ছিল জলযাত্রাকে আরও উন্নত, স্বল্পব্যয়ী এবং পরিবেশবান্ধব করে তোলা। প্রথাগত আধুনিক নৌকার সফটওয়্যারের খোলনলচে বদলে নিয়ে স্বয়ংক্রিয় নৌকা তৈরি করা ছিল সেই লক্ষ্যের দিকে প্রাথমিক পদক্ষেপ। অতিমারির কবলে পড়ে তাঁর যাত্রা কিছুটা বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার পরে তিনি যোগাযোগ করলেন এমআইটির একসময়ের সহকর্মী রিও বেয়ার্ডের সঙ্গে, দুজনে মিলে তৈরি করলেন নেভিয়ার। সঙ্গে পেলেন আরও কিছু সমমনস্ক কাজপাগলকে। পরবর্তী এগারো মাসে তাঁরা বানিয়ে ফেললেন তিরিশ ফুট আকৃতির আট-যাত্রীবাহী প্রমোদতরী N30, যার মূলে আছে হাইড্রোফয়েল প্রযুক্তি। N30 দাঁড়িয়ে থাকে তিনটে কার্বন ফয়েলের উপর, যার মাধ্যমে জলের চার ফুট উপর দিয়ে প্রবল স্রোতের মধ্যেও বিন্দুমাত্র না টলে বিমানের ভঙ্গিতেই ছুটে চলে সে। নৌকার সেন্সর প্রযুক্তি ঢেউয়ের তীব্রতা সম্বন্ধে তথ্য পাঠায় চালক সফটওয়্যারে, সেই অনুযায়ী ফয়েলগুলি নৌকার যাত্রা মসৃণ করতে সাহায্য করে। শক্তির সাশ্রয় এবং গতির দিক থেকে বিচার করলে যেকোনও অত্যাধুনিক গ্যাসোলিন-চালিত নৌকার থেকে দুটি নব্বই কিলোওয়াট বৈদ্যুতিক মোটর-বিশিষ্ট N30 অন্তত দশগুণ বেশি ক্ষমতাশালী। বর্তমানে সান ফ্রান্সিস্কোয় নেভিয়ারের সদর দপ্তরে এই প্রোটোটাইপ থেকে ব্যবসায়িক উৎপাদনের কাজ চলছে। আগামী বছরের মধ্যে তিরিশ থেকে পঞ্চাশটি নৌকা প্রস্তুত করে ফেলার মতো জায়গায় তাঁরা চলে আসবেন, এমনটাই সম্প্রীতির বিশ্বাস। ধনীদের বিলাসের জন্য নয়, আগামী ভবিষ্যতের গণমাধ্যম হিসেবে দ্রুতগামী জলযাত্রার বিকল্প তৈরি করাই সম্প্রীতির লক্ষ্য।
হাল না ছাড়াই যাঁদের অভ্যাস, তাঁরা আসলে আমাদেরকেই স্বপ্ন দেখার ভরসা জোগান।
..............
#Navier #Hydroswarm #silly পয়েন্ট