ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

সবকিছু সর্বত্র একত্রে : মাল্টিভার্সে মাতন

অভিষেক ঘোষ Aug 27, 2022 at 7:32 am ফিল্ম/ওয়েব সিরিজ রিভিউ

ছবি : এভরিথিং এভরিহোয়্যার অল অ্যাট ওয়ান্স

পরিচালনা : ড্যানিয়েলস্ (Daniel Kwan, Daniel Scheinert)

পরিবেশনা : A24

মুক্তি : ২০২২

অভিনয়ে : Michelle Yeoh, Stephanie Hsu, Ke Huy Quan, Jenny Slate, Harry Shum Jr., James Hong, and Jamie Lee Curtis


বিশ্বজুড়ে সিনেমা মেকিংয়ে বিগত কয়েক বছরে বিরাট বদল এনেছে মার্ভেল সিনেম্যাটিক ইউনিভার্স, বর্তমানে তাদের 'মাল্টিভার্স ফর্মুলা' সুপারহিট। সুতরাং এই গোত্রের আরো অনেক ফিল্ম যে অচিরেই বাজারজাত হবে, সে সম্ভাবনা খুবই প্রবল। দর্শক হিসেবে আমরা আরো উৎসাহিত বোধ করতেই পারি তখন, বিশেষ করে যখন কোনো প্রজেক্টে 'উইন্টার সোলজার', 'সিভিল ওয়ার', 'ইনফিনিটি ওয়ার' ও 'এন্ডগেম'-খ্যাত রুসো ভাইয়েরা জুড়ে থাকেন। তখন আরো ভালো ভাবে মালুম হয়, জটিল একটা প্লটকে কতখানি গুছিয়ে বলা সম্ভব! পপুলার সিনেমার নিহিত সম্ভাবনার পূর্ণতম প্রকাশ বোধ হয় কেবলমাত্র  এই জাতীয় ছবিতেই হওয়া সম্ভব। কারণ এমন অনেক ফিল্মই আমরা দেখি যা শ্রুতিনাটক, উপন্যাস বা, অডিও স্টোরি হলেও চলত, সিনেমাটা বানানোর দরকার ছিল না। সিনেমা আসলে অনেকগুলো বিষয়ের সুতো একজায়গায় বেঁধে একটা সুদৃশ্য রামধনু বানায়। সিনেমার বিভিন্ন বিভাগ আসলে ভিন্ন ভিন্ন সুর, সেই সব সুর একত্রে মেলানো ও একটিই সুরে পরিণত করতে পারাটাই বিরাট চ্যালেঞ্জ। আবার এমন কোনো শর্তও নেই যে, সব সুর মেলাতেই হবে ! কিন্তু যদি কোনোভাবে সব সুর মিলে যায়, তখন একটা অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে, তারই উজ্জ্বল নমুনা - 'Everything Everywhere All at Once' (২০২২), যা আদতে তিনটি পর্বে বিভক্ত। 'ইনফিনিটি ওয়ার'-এর মতো ছবি ছাড়াও 'The Witch Part 1 : The Subversion' (২০১৮) এ ব্যাপারে অনেকখানি সফল হয়েছে। তাতে একটা ম্যাজিক হয়, রবি ঠাকুরকে কোট করে বললে, "সে-যে  চমকে বেড়ায় দৃষ্টি এড়ায়, যায় না তারে বাঁধা / সে-যে  নাগাল পেলে পালায় ঠেলে, লাগায় চোখে ধাঁধা ।" - অর্থাৎ এ জাতীয় ছবি আসলেই একধরণের 'মনোহরণ চপলচরণ সোনার হরিণ'! যা দেখতে বসে অনায়াসে এই দুঃখ-জর্জর মূল্যবৃদ্ধিতে ধড়ফড় পৃথিবী থেকে ক্ষণিকের মুক্তি মেলে, নিশ্চিন্তে অনুভব করা যায়, 'আমি আছি সুখে হাস্যমুখে, দুঃখ আমার নাই'! কারণ এই 'আমি' ব্যর্থ হলেও, সুবৃহৎ মাল্টিভার্সের কোথাও না কোথাও একজন 'সফলতর আমি' তো রয়েছেই!


সিনেমার প্লটে এক অপরিচ্ছন্ন 'Laundromat'-এর মালিক চাইনিজ-আমেরিকান ওয়েমন্ড ওয়াং দাম্পত্য জীবনে অখুশি। কিন্তু স্ত্রী এভলিন কোয়ান (অভিনয়ে Michelle Yeoh), শ্বশুর গং-গং (অভিনয়ে জেমস হং) বা, একমাত্র কন্যা ‘জয়’ - কাউকেই সে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে চায় না। তার জীবনের একমাত্র আদর্শ হল যাকে বলে, 'হ্যাপি ফেস'! তাই বিচ্ছেদের নোটিশ তার ব্যাগেই থেকে যায় অথবা হাতে; যতক্ষণ না 'আলফা-ভার্স' থেকে ওয়েমন্ডের উন্নতর ভার্সন 'আলফা-ওয়েমন্ড' এসে সব এলোমেলো করে দেয়। কীভাবে এই ইউনিভার্স-জাম্প সম্ভব হয়? জানার জন্য সিনেমাটা দেখাই ভালো। ডঃ স্ট্রেঞ্জ বা, ওয়ান্ডা যেভাবে 'ড্রিমওয়াক' সারে, অনেকটা সেই কায়দায় অ্যাডভান্স সায়েন্সের বোড়ে এগিয়ে দিয়ে এই ছবিতে 'আলফা-ভার্স' তার সৈনিকদের পাঠায় এই ইউনিভার্সে। কিন্তু কেন? জোবু তুপাকি-কে আটকাতে, যে কিনা যত নষ্টের গোড়া একটি 'Doughnut-shaped Bagel' বানিয়েছে চরম হতাশা থেকে। এই চরম হতাশার মূলে রয়েছে জয়ের বাবা-মায়ের অজস্র ভুল পদক্ষেপ, সিদ্ধান্তহীনতা ও নিজস্ব চারিত্রিক সংকট (পার্টি-প্রস্তুতির প্রারম্ভিক দৃশ্যে ও Internal Revenue Service-এর অফিসের দৃশ্যে যার চমৎকার ঝলক মেলে), জয়ের আত্ম-নিপীড়ন, সমকামিতা ও মায়ের প্রতি ক্ষোভ। গোটা ছবিটা বেশ কতকগুলি চেনা ছকের (জয় ও আধা-মেক্সিকান বেকির সমকামিতা, মা-মেয়ের, বাবা-মেয়ের সম্পর্ক, টালমাটাল দাম্পত্য, ঘৃণা-হতাশা-তীব্র বিদ্বেষ বনাম ভালোবাসা, অ্যাপোক্যালিপ্স, কড়ে-আঙুলে কুংফু) মধ্যে দিয়েই হেঁটে চলে (যেখানে স্পষ্টতই প্রায় গোটা কেরিয়ার মাইকেল মেয়ারের 'হ্যালোউইন'-আতঙ্কের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলা জেমি লী-কার্টিস-কেই আমরা প্রায় 'লেডি মাইকেল মেয়ার' হিসেবে দেখি)। অথচ এতগুলো চেনা ছকের চক্রব্যূহেও ছবিটা আশ্চর্যভাবে একটা ভারসাম্য বজায় রাখে অজস্র বিজাতীয় চিত্রকল্পের মধ্যে - ছবির সম্পাদনা ও ভিস্যুয়াল এফেক্টস্ সেখানে অবিশ্বাস্য সাবলীলতায় সেকেন্ডের ভগ্নাংশে দেখিয়ে দেয় মাল্টিভার্স-পাড়ি ও একই চরিত্রের অজস্র ইউনিক-ভার্সন। কিন্তু কোথাও বেসুরে বাজে না এই 'Fusion', উল্টে চমকপ্রদ অ্যাকশন দৃশ্যের আড়ম্বরে  'Symphony' হয়ে ওঠে। আমরা অনুভব করি, আমাদের ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত তৈরি করে অনিঃশেষ শাখা-বাস্তব ('Branch Reality') সৃষ্টি-সম্ভাবনা। যদি এভলিন প্রথম যৌবনেই বাবার কথা মতো ওয়েমন্ডকে ত্যাগ করত, তাহলে সে কোথায় পৌঁছতে পারত; অথবা ওয়েমন্ড নিজেই বা কোথায় উপনীত হতো (সেক্ষেত্রে তো ওদের মেয়ে জয় জন্মাতই না) - সেই সবকিছুই ছবিটা আশ্চর্য দক্ষতায় প্লটে গেঁথে নেয়। কিন্তু আমাকে সেসব যত-না মুগ্ধ করে, তার চেয়েও বেশি অবাক করে ছবির নির্মাতাদের আশ্চর্য কল্পনাশক্তি! 'The Amusement Park' বা, 'Dawn Of The Dead' ছবিতে জর্জ রোমেরো যেভাবে কল্পনার উন্মত্ত তরঙ্গে আমাদের সহনশীলতার মাত্রাটিকে ঠেলতে ঠেলতে চেতনাকে একেবারে অসাড় করে দেন একসময়, অনেকটা সেভাবেই এই ছবি যেন আমাদের দেখিয়ে দেয় 'জন্ম মৃত্যুর প্রগাঢ় কৌতুকে হাসি ও কান্নার সারাৎসার'! সর্বক্ষণ এক তীব্র 'সমর বিউগ্‌ল' শোনানোর পরিবর্তে এই ছবি আমাদের উপহার দেয় 'হৃদয় খুঁড়ে তোলা মায়া-খনিজ', বুঝিয়ে দেয় 'এমন মোহময়, কিছুই কিছু নয়' অথচ অনেক কিছু হতেই পারে। এই ছবি যেন এক আশ্চর্য স্বপ্ন যা, ঘুম ভাঙার বহুক্ষণ পরেও স্মৃতিতে সজীব হয়ে থাকে ফিনকিময়-বিস্ময় হয়ে। ভাবুন তো, সেকেন্ডের ভগ্নাংশে অজস্র পৃথক স্থান ও কাল দেখাতে পোশাক পরিকল্পনা, কালার গ্রেডিং, আর্ট ডিরেকশনে কতটা নিখুঁত হতে হয়! কতখানি পরিশ্রম লাগে!


গোটা সিনেমায় একটা নিয়ন্ত্রিত 'ক্যাওস' আছে, যেটা অত্যন্ত উপভোগ্য; অন্তত অ্যারনোফস্কির 'Mother!'(২০১৭) ছবির মতো কখনোই হাতের বাইরে বেরিয়ে যায় না । বেসবল-ব্যাট নিয়ে একতলার সিলিংয়ে লাগানো এয়ার-কুলারে শব্দ তুলে দোতলায় স্বামীকে আহ্বান, পায়ের কৌশলে টুল ঠেলায় কুংফু-মাস্টারের সুপ্ত-সম্ভাবনা, কুকুর ছুঁড়ে লড়াই অথবা শেষ কমব্যাটে অবদমিত সুখ-সৃষ্টির কুংফু বা, নিষ্প্রাণ কোনো অলীক ইউনিভার্সে দুই পাথরের কথোপকথন কিম্বা হট-ডগ আঙুলেদের বিড়ম্বনাময় পা-সর্বস্ব জীবন, ডঃ স্ট্রেঞ্জের মিউজিক্যাল-ফাইট মনে করিয়ে দেওয়া বাটন-ফাইট সিকোয়েন্স - সবই সেই ক্যাওসের মায়াবী কল্পনা । অনেকের মনে হতে পারে, এমন ওলট-পালট ঘটনাক্রম কি 'consequence-free' ? উত্তর হল - একেবারেই নয়, গোটা গল্প-জুড়েই সেই বার্তা রয়েছে, সবই ধ্বংস হতে চলেছে, তাই মরিয়া একটা শেষ চেষ্টা ‘সর্বোত্তম এভলিন’কে খুঁজে বের করার, যে কিনা 'এভিল'-কে চিনে নিয়ে তার প্রাণ-ভোমরাটিকে বধ করবে । সত্যিই তার দরকার আছে কি ? আছে কি বিকল্প কোনো পথ, এই মৃত্যু-মুখর মাল্টিভার্সাল যুদ্ধে ? উত্তর রয়েছে সিনেমায় । শেষ দিকে হাতে হাতকড়া-পরা, বিক্ষুব্ধ এভলিনের সামনে অচঞ্চল ওয়েমন্ড যে চাইনিজ গানটি গুনগুন করে গায়, কেমন যেন মনে হয় সুরটা বড্ড চেনা, 'ইয়ে যো মহাব্বত হ্যায়... ইয়ে উনকা হ্যায় কাম... মর যায়ে, মিট্ যায়ে, হো যায়ে বদনাম' ! ঠিক-ভুল জানি না, তবে ওই গানটি সত্যিই মানানসই ওই দৃশ্যে। অজস্র মৃত্যুর পরেও দু'জনের মিলন নিশ্চিত, তাও একই জীবনে - এ জিনিস সিনেমাই দেখাতে পারে ।

..................... 

#Everything Everywhere All at Once #Film Review #ফিল্ম রিভিউ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219131