নাৎসি ক্যাম্প থেকে পালিয়ে নোবেল জয় : বিজ্ঞানী হফম্যানের ছোটোবেলা
হাড়-কাঁপানো শীতের সন্ধ্যে। তখনও আকাশে চাঁদ ওঠেনি। যতদূর চোখ যায় চারপাশে শুধু জমাট অন্ধকার। চিলেকোঠা-র ছোট্টো ঘরটিতে একটি মাত্র জানলা, কম্বল দিয়ে আড়াল করা। সেই জানলাও সব সময় বন্ধ থাকে। ঘরে কোনও আলোও জ্বালানো যাবে না। তাহলেই বাইরের মানুষ টের পেয়ে যাবে ওই ঘরে কেউ রয়েছে, আর টের পেলেই মৃত্যু অনিবার্য! ঘরের বাসিন্দা সাড়ে-পাঁচ বছর বয়সের একটি ছেলে আর তার মা। জানালার খড়খড়ি সরিয়ে ছেলেটি উঁকি মেরে বাইরে তাকায়; অন্ধকার.... কিছুই প্রায় দেখা যায় না। তবু ছেলেটি তাকিয়ে থাকে, যতদূর দৃষ্টি যায়। কারও পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে কি না, কিংবা কোনও অস্পষ্ট ছায়া সরে গেল কি না – বোঝার চেষ্টা করে সে। ছোট্ট ছেলেটির কাছে ওই জানালার ফাঁক দিয়ে আসা এক চিলতে আলোই পৃথিবী।
যে ঘরে ওরা আছে, সেই বিল্ডিং-টি একজন ইউক্রেনিয়ান শিক্ষকের। বিল্ডিং-এর নিচের তলার একটি ঘর বাচ্চাদের স্কুল হিসেবে ব্যবহার হয়। যে জায়গার কথা বলছি সেটি তৎকালীন দক্ষিণ পোল্যান্ড-এর (বর্তমানে ইউক্রেন) অন্তর্গত ‘জোলেখিভ’ নামের একটি জায়গা। আর যে বাচ্চা ছেলেটি-র কথা বলছি ওর নাম রোয়াল্ড সাফ্রান। বাবা মা দুজনেই ইহুদি। বাবার নাম হিলাল সাফ্রান, যিনি একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। মা ক্লারা রোজেন স্কুল শিক্ষিকা। জানুয়ারির ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৪এর জুন – এই পনেরো মাস মা আর ছেলে ওখানে লুকিয়ে ছিল। আশ্রয়দাতা পরিবারের কর্তা ও গিন্নি ছাড়া আর কেউই জানত না এ বিষয়ে। এমনকি পরিবারের অন্য সদস্যরাও জানত না।
এবার এখান থেকে আরও কয়েকমাস পেছনে চলে যাব। ১৯৪১ সালের কথা। নাৎসি বাহিনী সেসময় পোল্যান্ড আক্রমণ করেছে। ইহুদিদের দেখলেই নাৎসি বাহিনী বন্দি করছে নির্বিচারে, তারপর অকথ্য অত্যাচার। হিলাল সাফ্রান, ক্লারা এবং তাঁদের চার বছরের সন্তান রোয়াল্ড, নাৎসি-শাসিত লেবার ক্যাম্পে নজরবন্দি হয়ে দুঃসহ জীবন কাটাচ্ছে সেসময়। হিলাল সাফ্রানের বাবা,ভাই এবং আরও বেশ কিছু আত্মীয় পরিজনেরও ঠাঁই হয়েছে ওই ক্যাম্পে। কয়েক সপ্তাহ যেতে না যেতেই বেশ কয়েকজন নজরবন্দিকে হত্যা করে নাৎসিরা। হিলালের বেশ কয়েকজন আত্মীয় পরিজনও রেহাই পেল না। চারপাশ জুড়ে শুধু আতংক, বীভৎসতা, রক্ত আর বারুদের গন্ধ। নির্বিচারে হত্যালীলা চলছে। শুধু তা-ই নয়, ওখানকার স্থানীয় ইউক্রেনিয়ান বাসিন্দা যারা, তারাও আজ জার্মান নাৎসি-বাহিনীর হত্যালীলায় সহযোগিতা করছে। যাদের সঙ্গে একসঙ্গে ওঠাবসা করেছে কয়েক মাস আগেও, সেই মানুষগুলিও আজ শত্রু।
ছোট্ট রোয়াল্ডের বাবা হিলাল সাফ্রান একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার আর সে কারণেই রাস্তা-ঘাট বা ব্রিজ মেরামতি করা ইত্যাদি বিভিন্ন কাজে তাঁকে প্রয়োজন পড়ে নাৎসিদের। সেই জন্যে ক্যাম্পে অন্য বন্দিদের ক্ষেত্রে যেমন কড়াকড়ি, সাফ্রানের ক্ষেত্রে সেসব ছিল অনেকটাই শিথিল। আর এই শিথিলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে সাফ্রান এবং অন্য কয়েকজন ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করতে থাকে। কাজটা খুব সাবধানে করতে হবে। একটু অসাবধান হওয়া মানেই একসঙ্গে সবার মৃত্যু। প্রথম দফায় স্ত্রী আর শিশুপুত্রকে লেবার ক্যাম্প থেকে অতি গোপনে বের করে এনে সেই সহৃদয় ইউক্রেনিয়ান শিক্ষকের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন হিলাল। স্ত্রী আর ছেলেকে ক্যাম্প থেকে সরিয়ে আনলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি নিজে রেহাই পেলেন না। কয়েক মাস পরেই ক্যাম্প থেকে পালানোর পরিকল্পনাকারী হিলাল সাফ্রান এবং তাঁর কয়েকজন সঙ্গীকে গুলি করে হত্যা করল নাৎসিরা। বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গেল সাফ্রানের শরীর। এদিকে ছোট্টো রোয়াল্ড সেই চিলেকোঠার ঘরে অপেক্ষা করে থাকে কখন তার বাবা ফিরে আসবে। রোজ উঁকি মেরে জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকে আর মা’কে জিজ্ঞেস করে, বাবা কখন আসবে? ক্লারা বুঝে গেছেন স্বামীর কী পরিণতি হতে পারে।
সেদিনের সেই রোয়াল্ড হিলাল আজকের বিশ্ববন্দিত নোবেলজয়ী তাত্ত্বিক রসায়ন বিজ্ঞানী রোয়াল্ড হফম্যান। নোবেল পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন আরও অজস্র গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার ও স্বীকৃতির শিরোপা। ‘উডওয়ার্ড-হফম্যান রুলস অফ অরবাইটাল সিমেট্রি’ – উচ্চতর রসায়নে প্রসিদ্ধ এই সূত্রটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন যে দুজন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী তাঁদের একজন রবার্ট বার্নস উডওয়ার্ড আর অন্যজন রোয়াল্ড হফম্যান। ইলেকট্রন অরবাইটালের সিমেট্রিক্যাল চরিত্র থেকে রোয়াল্ড হফম্যান দেখিয়েছেন রাসায়নিক বিক্রিয়ার পথ। ১৯৮১ সালে রসায়নবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বর্তমানে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ফ্র্যাংক এইচ টি রোডস অফ হিউম্যান লেটারস’ প্রফেসর (এমিরিটার্স) হিসেবে যুক্ত আছেন রোয়াল্ড।
শৈশবের অস্থির বিপন্নতার অজস্র স্মৃতি আজও রোয়াল্ডের মনে গেঁথে আছে। যে শহরে থাকতেন, সেখানে চার হাজার ইহুদির মধ্যে বেঁচে ছিল মাত্র দুশো জন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে পোল্যান্ড এবং চেকোস্লোভাকিয়ার সীমানা পেরিয়ে অস্ট্রিয়া এবং জার্মানিতে একটার পর একটা উদ্বাস্তু শিবিরে আশ্রয়। এই সময় মা আবার বিয়ে করেন। শেষে ১৯৪৯ সালে এগার বছর বয়সে রোয়াল্ড, মা এবং সৎ পিতার সঙ্গে এলেন আমেরিকার নিউ ইয়র্ক সিটিতে। শুরু হল নতুন এক জীবন। এগার বছর বয়সে মাতৃভূমি ছেড়েছিলেন, তারপর সাতান্ন বছর বয়সে ২০০৬ সালে ইউক্রেনে এসেছেন সপরিবারে। স্কুলঘরের সেই চিলেকোঠার ঘর আর সেই সহৃদয় ইউক্রেনিয়ান পরিবারের সঙ্গে ফিরে দেখেছেন মাতৃভূমি। ২০১৭ সালে রোয়াল্ড হফম্যানের ৮০ তম জন্মদিনে এবং নোবেল পুরস্কারের কথা মনে রেখে, তাঁর সম্মানে পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশ করেছে মাতৃভূমি ইউক্রেনের সরকার।
শুধু গবেষণাগারের চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় রোয়াল্ড হফম্যানের যাপন। রাসায়নিক বিক্রিয়া, বিশ্লেষণ এবং অণু-পরমাণুর অন্দরমহলের হালহকিকতের খোঁজ রাখার বাইরেও রয়েছে তাঁর স্বকীয় জীবনবীক্ষা আর সৃজনশীলতার জগৎ। যেখানে কাব্য-সাহিত্য-শিল্পকলা আর সংস্কৃতির সারস্বত সাধনা। পাশাপাশি মানবহিতৈষণা এবং বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার নিরন্তর প্রয়াস। তিনি একজন সমাদৃত কবি, লেখক এবং নাট্যকারও। কবিতার সঙ্গে এই বিজ্ঞানীর সম্পর্ক নিবিড় এবং দীর্ঘ পাঁচ দশকের মতন। অসামান্য মনন ঋদ্ধ ছ’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। কবিতা ছাড়াও সাহিত্য শিল্প ও বিজ্ঞানের মিশ্রণে আরও কয়েকটি অসাধারণ গ্রন্থ রয়েছে। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর প্রত্যেকটি বই। এছাড়াও আছে তিনটি নাটকের বই। হফম্যান এবং স্ট্যানফোর্ডের বিশ্ববন্দিত রসায়নবিদ কার্ল জেরাসির লেখা বিপুল জনপ্রিয় ‘অক্সিজেন’ নাটকটি কমবেশি পনেরোটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে অক্সিজেন আবিষ্কারের পেছনে জড়িত সাফল্য, খ্যাতি, কৃতিত্বের কাড়াকাড়ি, নীতিহীনতা এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা – বিজ্ঞান ইতিহাসের এইরকম নানা টানাপোড়েন নিয়ে নির্মিত হয়েছে এই নাটক। আমেরিকা ও ইউরোপের বেশ কয়েকটি জায়গায় মঞ্চস্থ হয়েছে এবং অর্জন করেছে বিপুল জনপ্রিয়তা।
রোয়াল্ড হফম্যানের লেখা “সামথিং দ্যাট বিলংস টু ইউ” নামের একটি আত্মজীবনী মূলক নাটকে ধরা আছে জার্মান অধ্যুষিত পোল্যান্ডে হলোকস্ট থেকে বেঁচে যাওয়া একটি সাত বছরের জীবনের সেই মর্মন্তুদ কাহিনি। ইউক্রেনিয়ান স্কুলের চিলেকোঠার ঘরে মায়ের সঙ্গে লুকিয়ে থাকা সেই ভয়াবহ দিনের কথা। ফুটে উঠেছে মানুষের নিষ্ঠুরতা, উদ্বাস্তুদের বিপন্নতা, যন্ত্রণা। যেমন তাঁর লেখা ‘ফিল্ড অফ ভিউ’ কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে চিলেকোঠার সেই ছোট্ট আকাশ দেখতে না-পাওয়া জানালা দিয়ে দেখা নীচে স্কুলের বাচ্চাদের খেলাধুলো।
“From the attic the boy saw,
as children played,
but they always ran away
From the window frame.”
শুধু গবেষণাই নয়। রসায়নের প্রাজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে সমাজ ও বিজ্ঞান সম্পর্কিত তাঁর ধারাবাহিক বক্তৃতাগুলিও অনবদ্য। তিনি মনে করেন, শিক্ষকতা এক মহান দায়িত্ব। কেবলমাত্র উচ্চতর গবেষণামূলক তাত্ত্বিক রসায়নের বক্তৃতা নয়, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের একটি প্রাথমিক কোর্সেও পড়িয়েছেন তিনি বছরের পর বছর। যে ক্লাসে উপস্থিত ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আটশো পঞ্চাশের কাছাকাছি; এতটাই জনপ্রিয় তাঁর এই ক্লাস। তাঁর নিজের কথায় - “আমি বিজ্ঞানী না হলে আর্ট হিস্টোরিয়ান হতাম। ... নিজের প্যাশানকে কখনও প্রফেশনের জন্যে ছেড়ে দিতে নেই। আমি কবিতা এবং আর্ট হিস্ট্রিতে প্যাশোনেট ছিলাম। আর হ্যাঁ, আমি রসায়নবিদ হয়েছি, এই বিভাগে প্যাশনেট থেকেছি, যা আমার পক্ষে সঠিক পথ হয়েছে। কিন্তু আমি কবিতা আর আর্ট হিস্ট্রিতে আগ্রহ ও অনুরাগ বজায় রেখেছি”। বৈজ্ঞানিকসত্তার সঙ্গে কবি সত্তার এক অসম্ভব সুন্দর সহবস্থানের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রোয়াল্ড হফম্যান। আজও বিজ্ঞান, কবিতা ও শিল্পের গভীরতম সৌন্দর্যের মৌন সংলাপ লিখে চলেছেন বিশ্ববন্দিত এই বিজ্ঞানী ও শিক্ষক।