<b>ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড ও এক অলীক মানুষের গল্প</b>
রাজ্য সরকারের কাছে ইস্ট কলকাতা জলাভূমির জলের বিশুদ্ধতা প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ডঃ ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ নিজে এই জল পান করেছিলেন। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্বয়ং সাক্ষী ছিলেন এই অবাক জলপানের। দৃশ্যটি অতীব ফিল্মি। তবে গেঁয়ো যোগী যদি ফিল্মস্টার বা ক্রিকেটার না হন, তবে এ দেশে তাঁর ভিখ পাওয়া মুশকিলই শুধু না, একরকম অসম্ভব। সকলেই জানেন এ দেশে যে কাজ জরুরি, তা জনপ্রিয় নয় এবং যা জনপ্রিয় তা নিঃসন্দেহে জরুরি নয়। তাই এ লেখার শুরুতেই, পাঠক, আসুন আপনার আলাপ করিয়ে দিই ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের সঙ্গে। ধ্রুবজ্যোতিবাবু একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাস্তুতন্ত্রবিদ। জীবনের সিংহভাগ তিনি নিয়োজিত করেছিলেন পূর্ব কলকাতার জলাভূমি বা ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডের জন্য। তাঁর নিরলস চেষ্টায় এই জলাভূমি প্রকৃত অর্থে পরিণত হয়েছে প্রাকৃতিক সুয়ারেজ সিস্টেম প্ল্যান্টে৷ তিনিই সম্ভবত ভারতের প্রথম ইকোলজিস্ট এঞ্জিনিয়ার। পেশায় ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্যানিটেশন দপ্তরের এঞ্জিনিয়ার। পরে রাজ্য সরকারের পরিবেশ দপ্তরের প্রধান ছিলেন দীর্ঘদিন। ভারতের খুব কম সংখ্যক UN গ্লোবাল ৫০০ লরিয়েটদের মধ্যে তিনি ছিলেন একজন। United Nations Environment Programme (UNEP) ১৯৮৭ সালে পরিবেশচর্চায় বিশেষ কৃতিত্বকে সম্মান দিতে Global 500 Roll of Honour চালু করে। ধ্রুবজ্যোতিবাবু ১৯৯০ সালে এই বিরল সম্মান পান।
আরও পড়ুন
বিশ্বের বৃহত্তম ‘ম্যানগ্রোভ-সংরক্ষণ’ প্রকল্প : নেতৃত্বে সেনেগালের মৎস্যদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী
নব্বইয়ের পর ‘Sustainable Development’ বলে যে শব্দবন্ধটি আধুনিক পরিবেশ-চর্চার একেবারে কেন্দ্রে চলে আসে, তার অর্থ এ বাংলায় যদি কেউ হাতেকলমে বুঝিয়ে থাকেন তিনি ডঃ ঘোষ। ঘরে বসে পরিবেশ নিয়ে বুলি কপচানোর লোক ছিলেন না তিনি। ইকোসিস্টেম নিয়ে মোটা মোটা রিসার্চ পেপার লিখেও দিন কাটাননি। মাঠে-ঘাটে নেমে চিনেছেন নিজের দেশকে, নিজের শিকড়কে। থিওরির বিলাস-প্রবণতাকে ঘাড় ধরে ব্যবহারিক চর্চার ধুলোমাটিতে এনে ফেলেছিলেন। আর সে কারণেই প্রকৃতি আর প্রাণচক্রের সঙ্গে মানুষের অন্তর্গূঢ় সম্পর্কের গুরুত্ব তিনি টের পেয়েছিলেন। তার মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলেন ভবিষ্যতের ত্রাণের সূত্র। ফলে ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক চমৎকারকে চিনে নিতে তিনি ভুল করেননি।
এই ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড ঠিক কী? কেনই বা বিষয়টা এত গুরুত্বপূর্ণ? সামান্য পিছনে ফিরে তাকাতে হবে। শহর কলকাতার পূর্বদিকে সল্টলেক উপনগরীর উপকণ্ঠে ধাপার মাঠ সংলগ্ন অঞ্চলটি আসলে এক নিবিড় জলাভূমি এলাকা। কত প্রাচীন এই জলাভূমি? ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, নগরীর বর্জ্য জল পূর্বপ্রান্ত দিয়ে নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করেছিল ইংরেজরা। একসময় ওই অঞ্চলে স্বাদু জলের নদী ছিল, তার প্রমাণ মেলে বিখ্যাত দুই ইংরেজ কার্টোগ্রাফার (মানচিত্র- নির্মাতা) John Andrews ও Andrew Dury-র তৈরি করা এক মানচিত্রে। সে সময় সে অঞ্চল ছিল অরণ্যময় ও বসতিহীন। তাই বর্জ্য ফেলার জন্য ইংরেজরা সেই দিকটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই এলাকাতে কিছু মানুষ বসতি স্থাপন করলেন। এবং তাঁদের হাতেই একটা ম্যাজিক ঘটে গেল। গালভরা ডিগ্রি আর ভারী ভারী ডেজিগনেশন যা পারে না, প্রথাগত শিক্ষাহীন এই মানুষগুলো সেটাই করে ফেললেন। শহর কলকাতা থেকে নির্গত সভ্যতার বিষাক্ত জলধারাকে তাঁরা বইয়ে দিলেন স্বল্প ঢালে। সূর্যতাপে এই জলে জন্ম নিল অ্যালগি। পৃথিবীর আদি-প্রাণ এই অ্যালগি ক্রমে গ্রাস করল বর্জ্য-বিষ। পরিবর্তে পাওয়া গেল পরিশুদ্ধ জল। সমস্ত বর্জ্য-মিশ্রিত জল পরিশ্রুত হয়ে সেখানে কৃষি ও মাছচাষের অনুকূল বাস্তুতন্ত্র তৈরি হল। দেশীয় এই চমৎকারিত্ব দীর্ঘদিন আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে ছিল। দৈনিক ৭৫০ মিলিয়ন লিটার জল কোথায় যাচ্ছে, তা নিয়ে অনুসন্ধান শুরু হয় ১৯৮১ সালে। ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ ছিলেন সেই অনুসন্ধান-দলের অন্যতম সদস্য। যে কোনও জলাশয় বা ওয়াটার বডি তার ক্ষমতাসীমা অনুযায়ী প্রকৃতির বৃক্কের কাজ করে। ডঃ ঘোষ দেখলেন, কলকাতার পূর্বের এই জলাভূমি ঠিক সেই কাজটাই করছে গোটা কলকাতার জন্য। কলকাতাকে দূষণ ও বন্যা থেকে রক্ষা করছে, জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্যও রক্ষা করছে। তিনি খতিয়ে দেখে বুঝলেন, শুধু প্রকৃতি না, এর পিছনে রয়েছে দেশীয় মানুষের বহু প্রাচীন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান। যন্ত্রবিপ্লবের বহু আগে ইতিহাসের এক অজানা ধূসর বাঁকে নিহিত রয়েছে সে লোক-প্রজ্ঞার শিকড়। এই জলাভূমি কলকাতার জন্য কতটা জরুরি সেটা বোঝাতে কতটা বেগ তাঁকে পেতে হয়েছিল তার নমুনা লেখার শুরুতেই দিয়েছি। বলতে গেলে প্রায় একার দায়িত্বে তিনি শুধু রাজ্য সরকার নয়, গোটা বিশ্বের মনোযোগ ছিনিয়ে নিলেন। শুধু পূর্ব কলকাতার জলাভূমি না, সেখানের মানুষের বিস্ময়কর লোক-প্রজ্ঞাকেও বিশ্বের দরবারে নিয়ে এলেন ধ্রুবজ্যোতি ঘোষ৷ ২০০২ সালের ১৯ অক্টোবর এই জলাভূমি পেল ‘আন্তর্জাতিক রামসার সাইট’-এর তকমা।
প্রোমোটার- রাজের উৎপাত রোখাও অত্যন্ত জরুরি ছিল। ডঃ ঘোষের উদ্যোগে এবং কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে ২০০৬ সালে পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে জমি কেনা- বেচা ও তার বাস্তুতন্ত্র অক্ষুণ্ণ রাখার আইন পাশ হল। স্থাপিত হল ইস্ট কলকাতা ম্যানেজমেন্ট অথরিটি। পরিবেশগতভাবে এই জলাভূমির গুরুত্ব তো অপরিসীম বটেই, পাশাপাশি অর্থনীতির দিকটায় যদি তাকানো যায়, চমকে যেতেই হবে। বর্জ্য জল যদি এভাবে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে পরিশুদ্ধ না হত, এক ধাক্কায় শহর কলকাতার বর্জ্য পরিশ্রুতকরণ বাবদ খরচ বহুগুণ বেড়ে যেত। প্রায় একইরকম বাস্তুতন্ত্র রয়েছে সাংহাই শহরে। কিন্তু কলকাতার waste management-এর খরচ সাংহাইয়ের এক শতাংশ মাত্র। বোঝাই যাচ্ছে, কোমরভাঙা অর্থনীতির এই রাজ্যে প্রায় অঞ্জন চৌধুরীর ছবির বড়দার দায়িত্ব পালন করছে পূর্ব কলকাতার জলাভূমি। আর তাকেই গডফাদারের মতো আগলেছেন ডঃ ঘোষ। রিয়েল এস্টেটের লোভী শকুন- চোখ থেকে একে বাঁচানোর জন্য প্রতি বছর নতুন করে এই গোটা ১২৫ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের ম্যাপ তৈরি করতেন। এই অতিমানবিক কাজের জন্য ধ্রুবজ্যোতিবাবু দেশে বিদেশে অসংখ্য সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন৷ ২০১৬ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে পেয়েছেন CEM Luc Hoffmann সম্মান। কিন্তু পুরস্কারে আত্মতুষ্ট না হয়ে আমৃত্যু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকেছেন তিনি। একজন প্রকৃত দ্রষ্টার মতো আত্মধ্বংসী এ সভ্যতার আসন্ন সর্বনাশকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বলেই বৃদ্ধ অশক্ত শরীর নিয়েও তিনি বালকের উৎসাহ আর যুবকের উদ্যমে ছুটে বেড়িয়েছেন।
ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ড সংরক্ষণের মতো অতিমানবিক কাজের পাশাপাশি ধ্রুবজ্যোতিবাবুর পরিবেশ- চর্চার নিহিত ভাবনাটি মনে রাখাও জরুরি। আমাদের আধুনিক পরিবেশ-চর্চা দাঁড়িয়েই আছে ধ্বংস আর ভয়ের অনুষঙ্গের ওপর। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত দেশেই আবহমান কাল ধরে পরিবেশ আর বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে এক নিবিড় সহাবস্থানের সম্পর্কে জড়িয়ে থেকেছে মানবসভ্যতা। আর সেই সহাবস্থানের উৎসমূল থেকেই প্রাচীন লোক- চেতনায় ধরা দিয়েছিল কিছু কারিগরি- বিদ্যা, আধুনিক বিদ্যাচর্চার জগৎ পরবর্তীকালে যার নাগাল পেয়ে চমকিত হয়েছে বারবার। ধ্রুবজ্যোতিবাবু পরিবেশ- চর্চার এই দিকটির প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন। ‘Ecosystem Management : Towards merging theory and Practice’ ‘Ecology and Traditional Wetland Practice’ এর মতো বইতে খুব সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা করেছেন বাস্তুতন্ত্রের মূল সূত্রগুলি। ২০১৮ সালে তাঁর মৃত্যুর পর আবারও প্রশ্নচিহ্ন উঠে গেছে ইস্ট কলকাতা ওয়েটল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এত জরুরি বিষয়ে আমরা যথাযথ কোনও সমষ্টিগত উদ্যোগ পাইনি। ডঃ ঘোষের মতো সুপারহিরোর দরকার পড়ে আমাদের। তবু আমরা তাঁর নাম জানি না।
ডঃ ঘোষ আসলে সেই সুপারহিরো যাকে কলকাতার দরকার, কিন্তু কলকাতা ডিজার্ভ করেনা মোটেই।
গলা অবধি ভোগে
ডুবে থাকা এই দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘আরও
চাই’ সভ্যতা ধ্রুবজ্যোতি ঘোষের মতো মানুষের অবদানকে মাথায় করে রাখল না, সে দুর্ভাগ্য তাঁর নয়। আমাদেরই।