ব্যক্তিত্ব

ভারতবর্ষে আধুনিক দন্তচিকিৎসার অগ্রদূত ডঃ রফিউদ্দিন আহমেদ

টিম সিলি পয়েন্ট May 7, 2021 at 6:13 am ব্যক্তিত্ব

ডাক্তার আর. আহমেদের নাম শুনলে আমাদের সবার আগে মনে পড়ে কলকাতার মৌলালির মোড়ের দাঁতের চিকিৎসার হাসপাতালের নাম। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না, এই ডাক্তার রফিউদ্দিন আহমেদের নাম শুধু একটি হাসপাতাল বা মেডিকেল কলেজেই সীমাবদ্ধ নয়। ভারতবর্ষে আধুনিক দন্তচিকিৎসার অগ্রদূত ডঃ রফিউদ্দিন আহমেদ।

রফিউদ্দিন আহমেদের জন্ম হয় ১৮৯০ সালের ২৪শে ডিসেম্বর, বাংলাদেশের ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ থানার বর্ধনপাড়া গ্রামে। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা নবাবগঞ্জেই। তারপর আলিগড় মহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজ থেকে খুবই ভালো ফল নিয়ে আই.এস.সি. পাশ করেন। এই সময় একটি পারিবারিক দুর্ঘটনায় তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হতে বসেছিল। রফিউদ্দিনের বাবার আকস্মিক মৃত্যুর ধাক্কা মেনে নিতে পারেননি তাঁর পরিবারের কেউই। ছোটোবেলা থেকে অত্যন্ত মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও এই সময়ে চরম অর্থকষ্টের ফলে রফিউদ্দিনের উচ্চশিক্ষা বাধাপ্রাপ্ত হয়। এই পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তিনি পড়াশোনা ছেড়ে জাহাজ কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে লন্ডন যান। কিছুদিন পর চাকরিসূত্রেই যেতে হয় আমেরিকা। জীবনধারণ এবং পরিবার প্রতিপালনের তাগিদে চাকরি করলেও আরও পড়াশোনা করার ইচ্ছে তাঁর কখনওই স্তিমিত হয়নি। তাই কিছুদিন চাকরি করে বেশ কিছু টাকা উপার্জন ও সঞ্চয় করে আবার পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। আমেরিকার আইওয়া ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হন রফিউদ্দিন। ১৯১৫ সালে এই কলেজ থেকে দন্ত-চিকিৎসাবিদ্যায় স্নাতক হন রফিউদ্দিন। কলেজে পড়াকালীন তাঁর মেধা এবং পাণ্ডিত্যের ফলে অধ্যাপকদের সুনজরে আসেন তিনি। পড়া শেষে একজন অধ্যাপকের সহায়তাতেই কাজের সুযোগ আসে ম্যাসাচুসেটস শহরের 'ফোরসিথ ডেন্টাল ইনফর্মারি ফর চিলড্রেন ইন বোস্টন' নামে একটি সংস্থায়।

বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন, পড়াশোনা, ডাক্তারি পেশায় পসার ও নামডাক হলেও মনে মনে দেশের মাটির প্রতি টান বিন্দুমাত্রও কমেনি রফিউদ্দিনের। তাছাড়া তিনি চেয়েছিলেন তাঁর অধীত বিদ্যা দেশের মানুষের উপকারে কাজে লাগাতে এবং দেশের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে। সেই স্বপ্ন পূরণের উদ্দেশ্যে বিদেশ থেকে বিদ্যা আর অভিজ্ঞতা অর্জন করে ১৯১৯ সালে দেশে ফিরে এলেন রফিউদ্দিন। কলকাতা শহরে তিনি আধুনিক পদ্ধতিতে দাঁতের চিকিৎসা শুরু করেন। এক্ষেত্রে কোনওরকম সরকারি সাহায্য তিনি পাননি। নিউ ইয়র্কের সোডা ফাউন্ডেশনের সাহায্যে ১৯২০ সালে কলকাতায় ভারতের প্রথম ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। গতবছর সেই প্রতিষ্ঠান শতবর্ষ পূর্ণ করেছে। সমাজের সব স্তরের ছেলেমেয়েরা যাতে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে, তাই এই কলেজে দুঃস্থ ছাত্রদের শিক্ষার সিংহভাগ খরচ তিনি নিজে দিতেন। তার পাশাপাশি হাসপাতাল চালানোর খরচের একটা বড়ো অংশ আসত তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগে। কলকাতায় রফিউদ্দিন একটি আধুনিক আইসক্রিম পার্লার চালু করেন। এই ব্যবসা থেকে সেই সময়ে প্রচুর আয় হত, আর তার অধিকাংশই ব্যয় হত হাসপাতাল চালানোর কাজে।

কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তিরিশ বছর রফিউদ্দিন এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। কলেজে অধ্যাপনাকালেই তিনি 'হ্যান্ডবুক অফ অপারেটিভ ডেন্টিস্ট্রি' নামক একটি বই লেখেন, এই বইটি এখনও দন্ত চিকিৎসার শিক্ষার্থীদের অবশ্যপাঠ্য। দেশে আধুনিক দন্ত-চিকিৎসার প্রসারের জন্য ১৯২৫ সালে রফিউদ্দিন 'বেঙ্গল ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠা করেন, পরে এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই 'ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন' প্রতিষ্ঠা হয়। দীর্ঘদিন তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর পরিকল্পনায় 'ইন্ডিয়ান ডেন্টাল জার্নাল' প্রকাশিত হউ এবং ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত তিনি এর সম্পাদক ছিলেন। অধ্যাপনা এবং চিকিৎসার পাশাপাশি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। স্বাধীনতার পর মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়ের মন্ত্রিসভায় তিনি পশ্চিমবঙ্গের কৃষি, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন। তিনি দু'বছরের জন্য পুরসভার নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভারও সদস্য হয়েছিলেন।

দন্তচিকিৎসার প্রসারের জন্য রফিউদ্দিন তাঁর মৌলালির বাড়ি এবং সংলগ্ন জমি সরকারকে দান করে দেন। সেখানেই স্থানান্তরিত হয় ডেন্টাল কলেজ, বর্তমানে যা রাজ্যের শীর্ষস্থানীয় সরকারি ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল। রফিউদ্দিনের মৃত্যুর পর কলেজটির নাম পরিবর্তন করে হয় ডাক্তার আর. আহমেদ ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল। এখন তা কলকাতা ডেন্টাল কলেজ নামে পরিচিত।

সারাজীবন অক্লান্তভাবে দেশের মানুষের সেবা করেছেন রফিউদ্দিন। কখনও চিকিৎসা করে, আবার কখনও রাজনৈতিক পদাধিকার বলে। বেশ কিছু পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন তাঁর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে। ১৯৭৭ সালে 'ইন্ডিয়ান ডেন্টাল অ্যাসোসিয়েশন' তাদের বাৎসরিক 'ইন্ডিয়ান ডেন্টাল কনফারেন্সে' রফিউদ্দিনের নামে পদক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারতীয় দন্তচিকিৎসায় তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেন। আমেরিকার আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ডেন্টিস্ট্রি অ্যালামনি অ্যাসোসিয়েশন' তাঁদের বিশিষ্ট প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে রফিউদ্দিনকে সম্মানিত করে। ভারতবর্ষে আধুনিক দন্তচিকিৎসার জনক ডাক্তার রফিউদ্দিন আহমেদকে তাঁর পেশাগত ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬৪ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মভূষণ' উপাধি দেন। ১৯৬৫ সালে কর্মবীর এই মানুষটির মৃত্যু হয়। ভারতীয় দন্তচিকিৎসার ইতিহাসে তাঁর অসামান্য অবদানের কথা স্মরণে রেখে কয়েক বছর আগে থেকে তাঁর জন্মদিন ২৪ শে ডিসেম্বর তারিখটিকে 'ন্যাশানাল ডেন্টিস্ট ডে' হিসেবে পালন করা হয়।

আরও পড়ুন : বাঙালিকে ‘অন্ত্রপ্রনর’ হবার পথ দেখিয়েছিলেন স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখার্জী / অহনা বড়াল 

............................................

#সিলি পয়েন্ট #web portal #silly পয়েন্ট #রফিউদ্দিন আহমেদ #Dentist #Dental Hospital #Rafiuddin Ahmed #The Calcutta Dental College

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

70

Unique Visitors

212736