পৃথিবী কি তাঁকে সেভাবে চায় আর?
বই : পৃথিবী আমারে চায় (সত্য চৌধুরী)
সংকলন : পরমানন্দ চৌধুরী
সম্পাদনা : বিভাষ রায়চৌধুরী
প্রকাশনা : দে'জ
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর, ২০২১
পঞ্চাশোর্ধ বাদে সত্য চৌধুরীর নাম চট করে মনে করতে পারবেন না অনেক বাঙালিই। অথচ ১৯৩৯ সালের ইন্টার কলেজ সংগীত প্রতিযোগিতায় সত্য চৌধুরী হয়েছিলেন প্রথম, তৃতীয় যিনি হয়েছিলেন তাঁর নাম মান্না দে। তার পরে অন্তত দেড় দশক বাংলা গানের সবচেয়ে জনপ্রিয় কণ্ঠ ছিলেন তিনিই। ১৯৪৫ সালে তৈরি হয় সেই বিখ্যাত গান 'পৃথিবী আমারে চায়, রেখো না বেঁধে আমায়' - বাংলা আধুনিক গানের অলটাইম ক্লাসিকগুলোর মধ্যে একটা। ঝুলিতে ছিল আরও অজস্র স্মরণীয় গান। কাজ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম, দিলীপকুমার রায়, অনুপম ঘটক, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, কমল দাশগুপ্তের মতো ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে। নজরুলের দুটি গানে সুরও দিয়েছিলেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ-কে মুগ্ধ করেছিল তাঁর কণ্ঠ। বিশেষত ভক্তিমূলক গান ও ভজনের জন্য সারা দেশ তাঁকে চিনত। উচ্চাঙ্গ সংগীতের তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ মহম্মদ দবীর খাঁ-র কাছে। সেই সত্য চৌধুরী কেন পাঁচের দশকের মাঝামাঝি আচমকা রেকর্ড ও ফিল্মি গানের দুনিয়া থেকে সরে গেলেন?
শিল্পী হিসেবে সত্য চৌধুরীর মূল্যায়নের প্রয়াস এ বই করেনি। কোনও ক্রিটিকাল বিচার-বিবেচনার পথে হাঁটেনি। সংকলক পরমানন্দ চৌধুরী সত্যবাবুর নিজের ভাইপো। সত্য চৌধুরীকে নিয়ে এই বিশেষ স্মারক গ্রন্থ বিচ্ছিন্ন কিছু লেখাকে দুই মলাটে ধরে তাঁকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেছে। লেখাগুলি তিনটি অংশে বিন্যস্ত - জীবনী, স্মৃতিকথা ও সাক্ষাৎকার। লেখাগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাবে বইটি জায়গায়-জায়গায় পুনরুক্তি-জর্জরিত। জীবনীমূলক লেখাগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিস্তারিত লেখাটি শৌনক গুপ্তের। যথার্থ নৈর্ব্যক্তিক জীবনী এই একটিই। মিহির বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখাটিও মূল্যবান, তবে লেখাটিকে 'স্মৃতিকথা' অংশে রাখলেও ক্ষতি ছিল না। প্রতিমা দেব রায়ের লেখাটিও কার্যত ব্যক্তিগত মুগ্ধতার ধারাবিবরণী।
সম্পাদনার দৈন্য প্রকট। বস্তুত সম্পাদনার কিছু প্রাথমিক শর্তই এখানে লঙ্ঘিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারের সময়কাল উল্লেখ না করলে তার মূল্য অর্ধেকেরও নিচে নেমে আসে। এই বইয়ের দুটি সাক্ষাৎকারের একটিতেও সময়কাল উল্লেখ করা হয়নি। তিন নম্বর সাক্ষাৎকারটি বকচ্ছপ গোছের - পাদটীকায় সাক্ষাৎকারমূলক নিবন্ধ বলে দাবি করা হয়েছে। লেখাটি বেশ দিশাহীন। বইয়ে অনেকগুলি অনুলিখন রয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকটি আরেকটু সুবিন্যস্ত হলে ভালো হত। প্রিয়জনেদের স্মৃতিচারণাগুলি বরং উপভোগ্য। সত্যবাবুর গাওয়া গানের সম্পূর্ণ তালিকাটি এই বইয়ের সবচেয়ে বড় সম্পদ। অনেক ফটোগ্রাফও সংকলিত হয়েছে। রয়েছে সত্য চৌধুরীর একটি বংশতালিকাও।
যে সময় পৃথিবী তাঁকে চাইছিল, সত্যবাবু ঠিক সে সময় ছেড়ে দিলেন রাজ্যপাট। ফর্মের তুঙ্গে থাকতে থাকতেই । অবশ্য রেকর্ড না করলেও মঞ্চে বা বেতারে গান পরিবেশন করেছেন আরও অনেক বছর, কিন্তু মানুষের স্মৃতি থেকে ক্রমশই ফিকে হয়েছেন। তা সত্ত্বেও কালজয়ী হওয়া উচিত ছিল হয়তো। হননি। ফিল্মি গান সে সময় সংগীত জগতের মূলস্রোত হয়ে উঠছিল। তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানে কার্যত হারাকিরি। সত্য চৌধুরী সজ্ঞানেই সাংসারিক দায়দায়িত্বকে বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৯৩ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তিনি এক্সপায়ারি ডেট পেরিয়েছেন দৈহিক মৃত্যুর অনেক আগেই। তাঁর সমসাময়িক মান্না দে বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অমরত্ব পেয়েছেন। তাঁদের খ্যাতির পিছনে হয়তো মুম্বই ইন্ডাস্ট্রির অবদান অনেকটা। কিন্তু সত্য চৌধুরী যে আজ বাঙালির স্মৃতি থেকে প্রায় লুপ্ত, সেজন্য তাঁর নিজের অকালে স্বেচ্ছা-অবসরে যাওয়াই বোধহয় বেশি দায়ী। 'বিস্মৃতপ্রায়' কথাটার যতটা বাজারমূল্য, তার চেয়ে বেশি তাঁকে মনে রাখতে প্রস্তুত কি বাঙালি? ২০১৮ সালে প্রায় নিঃশব্দে জন্মশতবর্ষ পেরোলেন সত্য চৌধুরী। নিছক মাঝারি মানের একটি স্মারক গ্রন্থ হলেও এক অনন্য শিল্পীর স্মৃতি আরেকবার খুঁড়ে তোলার জন্যই প্রয়োজন ছিল এই বই।
..................
#সত্য চৌধুরী #পৃথিবী আমারে চায় #বই রিভিউ #silly পয়েন্ট