ফিচার

চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Aug 15, 2024 at 1:54 pm ফিচার

আর জি কর হাসপাতালের নৃশংস ঘটনা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষোভে ফেটে পড়ছে গোটা রাজ্য। প্রতিবাদ হচ্ছে বিভিন্ন স্তরে, উঠে আসছে সমাজের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা হেনস্থার নানা বয়ান। আমি নেশা এবং পেশাগতভাবে যে জগতের সঙ্গে যুক্ত, তা হল অ্যাকাডেমিয়া, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র। এখানে প্রতি মুহূর্তে লিঙ্গবৈষম্য সম্বন্ধে চলে আলোচনা, সেমিনার। সুললিত ভাষায় সুচিন্তিত বয়ানে অনুষ্ঠিত হয় বক্তৃতা, পর্যালোচনা, প্রতিবাদ। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, লিঙ্গবৈষম্যজনিত বিভাজন ও অত্যাচার সম্পর্কে সচেতনতা এবং প্রতিবাদের ভাষ্য তৈরি করতে অ্যাকাডেমিয়ার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আচরণে প্রতিফলন দেখা না গেলে শুষ্ক আলোচনা মূল্যহীন হয়ে পড়ে। অপ্রিয় শোনালেও সত্যি, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভারতীয় তথা বঙ্গীয় সারস্বতচর্চার ক্ষেত্রে যৌন-শোষণ ও নিপীড়নের ঘটনা বিরল নয়, বরং রীতিমতো পরিচিত। কয়েক বছর আগে যখন সমাজমাধ্যমে মিটু আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন বিভিন্ন স্বীকারোক্তির বয়ানে অকাট্য প্রমাণসমেত যেসব তথ্য সামনে এসেছিল, তা যথেষ্ট আঁতকে ওঠার মতো। নাম জড়িয়েছিল এমন বেশ কিছু ব্যক্তির, যাঁরা অ্যাকাডেমিক জগতে সুপরিচিত এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র। মুখোশের আড়ালে তাঁদের ঘৃণ্য চেহারা দেখে কষ্ট পেয়েছিলেন অনেক নবীন ছাত্রছাত্রী, মোহভঙ্গ ঘটেছিল অ্যাকাডেমিয়ার আদর্শ সম্বন্ধে।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, সংশ্লিষ্ট মহলে এ নিয়ে সাময়িক হইচই হলেও শেষ অবধি লাভ হয়নি তেমন। কিছু ক্ষেত্রে তদন্ত শুরুই হতে দেওয়া হয়নি, কয়েক জায়গায় আরম্ভ হলেও অভিযুক্ত ব্যক্তি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ বৃত্ত প্রভাব খাটিয়ে মাঝপথেই তা থামিয়ে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার, অপরাধীকে পেশাগত বা সামাজিক জগতে কোনোরকম সামগ্রিক বয়কটের সম্মুখীন অবধি হতে হয়নি। অনেকেই সাময়িকভাবে নিন্দা করলেও তাঁর বৃত্ত ত্যাগ করেননি, প্রয়োজন পড়লে কেরিয়ার গুছোনোর জন্য আবার গুটিগুটি গিয়ে সেই নরদানবের ছাতার তলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাই আজ ঘটনার কয়েক বছর কেটে যাবার পরে দেখতে পাই, সেইসব আঁতকে ওঠার মতো কাহিনির নায়কেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বহাল তলিয়ে রীতিমতো বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এতটুকু ফারাক হয়নি তাঁদের সামাজিক স্থানের। তাঁরা মহানন্দে পেপার ছাপছেন, নামী পত্রিকায় লেখালিখি করছেন, বিদেশ ভ্রমণ করছেন, নিত্যনতুন পালক যোগ করে চলেছেন নিজেদের রত্নখচিত কেরিয়ার গ্রাফে। কেউ কেউ আবার গলা মিলিয়ে আর জি কর কাণ্ডের বিচার অবধি চাইছেন! 

এবং শোষণ করছেন, করেই চলেছেন। অ্যাকাডেমিক জগতে কান পাতলেই শোনা যায় নানারকম ফিসফাস, অমুক রীতিমতো বাগানবাড়ি স্টাইলে আলাদা ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে তোলেন ছাত্রীদের, কেউ আবার গভীর রাতে ফোন বা মেসেজ করে তাদের উত্যক্ত করেন। সম্মত না হলে আসে হুমকি, কখনও মিঠে কখনও বা কড়া ভাষায়। জায়গামতো কলমের এক আঁচড়ে ধ্বংস হয়ে যায় গবেষণার স্বপ্ন, হাতছাড়া হয় চাকরি, খতম হয়ে যায় কেরিয়ার। অত্যন্ত সুচারুভাবে কাজ করেন এঁরা, কেউ টের পায় না অথচ আঘাত ঠিক পৌঁছে যায় মর্মস্থানে। সিস্টেমের প্রতিটি স্তরে সহযোগিতা না থাকলে এত মসৃণভাবে কাজ চালানো অসম্ভব। আমাদের বুঝতে হবে, ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গের মতো দরিদ্র জায়গায় অনেকেই নিজের সীমিত ক্ষমতার সর্বস্ব বাজি রেখে উচ্চশিক্ষায় আসেন, চাকরির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত জেনেও পড়াশোনাকে ভালোবেসেই আসেন। তারপর ক্ষমতার এই নগ্ন চেহারা দেখে অনেকেই ইচ্ছে থাকলেও পারেন না প্রতিবাদে ফেটে পড়তে, পায়ের তলায় ন্যূনতম জমিটুকু না থাকায়। তাই ভিক্টিমের ঘাড়ে দোষ চাপানোর আগে আমরা যেন সামগ্রিক পরিস্থিতির এই ভয়াবহ অবস্থার কথা ভুলে না যাই। 

আবার তুলনায় সামান্য হলেও এর উল্টো পিঠও রয়েছে। কেউ কেউ এখন মিটুকে অপব্যবহার করতেও শিখে গিয়েছেন, তাঁর অন্যায় দাবি মেনে না নিলে প্রবীণ অধ্যাপকের নাম পাঁকে টেনে আনতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করছেন না। মনে রাখতে হবে, একের পর এক যৌন হেনস্থা ও নিপীড়নের ঘটনা গোটা অ্যাকাডেমিয়া জুড়ে যে সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বিষয় বাতাবরণ তৈরি করেছে, তার ফায়দাই কিন্তু লুটছেন এইসব অসৎ সুযোগসন্ধানীরা।

আর জি কর তাই অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো আমাদের অ্যাকাডেমিক জগৎকেও দাঁড় করিয়ে দেয় আয়নার সামনে। মনে করিয়ে দেয় বিদ্যার সঠিক অর্থ, বিবেকের কাছে পরিষ্কার থাকার গুরুত্ব, এবং ফিসফাসের বদলে সংগঠিত এবং লাগাতার প্রতিবাদের প্রয়োজনীয়তা। তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতরাই যদি এই ধরনের ঘৃণ্য আচরণে লিপ্ত থাকেন এবং উপযুক্ত প্রমাণ সত্ত্বেও বারবার পার পেয়ে যান, তবে সাধারণ সমাজে বিচার জিনিসটার কোনও অস্তিত্ব আদৌ থাকবে কি? 

#wewantjustice #rgkarmedicalcollege #স্পর্ধা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

1

Unique Visitors

206711