ফিচার

মাঝসমুদ্রে ডিজেল নিরুদ্দেশ

অর্পণ পাল April 19, 2022 at 8:29 am ফিচার

সাল ১৯১৩, সেপ্টেম্বরের উনিশ তারিখ। বেলজিয়াম থেকে এস. এস. ড্রেসডেন নামে একটি জাহাজে চেপে বসলেন রুডলফ ডিজেল নামে এক শিল্পপতি, গন্তব্য ইংল্যান্ড।

সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল, সেদিন রাতে যথারীতি তিনি ডিনার করলেন, এবং সবাইকে বলে রাখলেন, যেন তাঁকে সকাল ছটায় ডেকে দেওয়া হয়। কিন্তু সকালে তাঁকে যখন ডেকে ডেকেও কোনো সাড়া পাওয়া গেল না, তখন তাঁর ঘরে ঢুকে দেখা যায় যে ঘর ফাঁকা। বিছানা একেবারে সুসজ্জিত, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে রাতে সেই বিছানায় কেউ থাকেননি। 

গোটা জাহাজ তন্নতন্ন করে খুঁজেও যখন রুডলফের কোনো সন্ধান মিলল না, তখন সকলেই ধরে নিলেন যে তিনি নিশ্চয়ই পথে কোথাও পড়ে গিয়েছেন।  কিন্তু আগের রাতে আবহাওয়া ছিল চমৎকার, কোনো ঝড়-ঝঞ্ঝা বা দুর্ঘটনা ঘটার কারণই নেই। তাহলে গেলেন কোথায় পঞ্চান্ন বছর বয়সী জার্মান ভদ্রলোকটি? 

বেশ কয়েক দিন অবধি বিস্তর অনুসন্ধান চালিয়েও রুডলফ সাহেবের মৃতদেহের সন্ধান পাওয়া গেল না না, একেবারে পাওয়া যায়নি তা নয়, অনেক দিন পর ছোট আকারের একটা ডাচ বোট উত্তর সাগরের কাছে একটা মৃতদেহ দেখতে পেয়েছিল বটে, কিন্তু সেটাকে ওই বোটে করে বন্দরে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি, তাই কখনওই জানা সম্ভব হয়নি সেটাই রুডলফ সাহেবের মৃতদেহ ছিল কি না। 

সব মিলিয়ে রুডলফ ডিজেলের অন্তর্ধান একটা রহস্যই হয়ে রয়ে গেল। তবে তিনি যে আত্মহত্যা করে থাকতে পারেন, এই সম্ভাবনাতেই সকলে জোর দিয়েছিলেন। আর পরের বেশ কয়েকদিন নিউ ইয়র্ক টাইমস বা অন্য সংবাদপত্রেও এরপরে দিন কয়েক খবরের শিরোনাম বা বিষয় হিসেবে বারবার উঠে এসেছিল এই ঘটনাটি, কখনও তাঁর পরিবারের আর্থিক সংকটের কথা, কখনও রুডলফ যে ব্যাঙ্করাপ্ট হয়ে গিয়েছিলেন সে খবর, আবার কখনও তাঁর দেনার পরিমাণ প্রকাশ, তা নাকি চার লাখ ডলারের কাছাকাছি। আবার মাস কয়েক পরে এমন একটি শিরোনামই এল, রুডলফ সাহেবকে নাকি কানাডায় দেখা গিয়েছে, তিনি নাকি সেখানে নতুন করে সংসার পেতেছেন। তবে এই খবরটার ভিত্তি ছিল না, আর পরেও এ নিয়ে কোথাও কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।  

এমনও একটা খবর জানা যায় যে এই সফরে রওনা দেওয়ার আগে তিনি স্ত্রীয়ের কাছে একটা স্যুটকেস রেখে যান, তাতে ছিল কুড়ি হাজার জার্মান মার্ক।  তাঁর ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট তল্লাশি করে দেখা যায় যে সঞ্চয় বলতে তাতে প্রায় কিছুই নেই। সব মিলিয়ে এই সফরে রওনা দেওয়ার আগে রুডলফ সাহেব যে আর্থিক এবং মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত অবস্থায় ছিলেন, সেটা বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু তিনি যে আত্মহত্যা করে বসবেন, এমন সম্ভাবনা কেউই টের পান নি। 

রুডলফ ডিজেল এক বিশেষ ধরনের তাপীয় ইঞ্জিন আবিষ্কার করে উনিশ শতকের প্রথম দিকে দারুণ নাম এবং অর্থ উপার্জন করতে শুরু করেন। ছোট থেকেই তিনি ভালোবাসতেন যন্ত্রপাতির কলকব্জা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে, যে কারণে জার্মানি যখন ১৮৭০ সালে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল, রুডলফের বাবা তাঁকে এক কাকার কাছে পাঠিয়ে দেন, সেখানে গিয়ে রুডলফ ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে শুরু করেন।  

পাশ করবার পর রুডলফ তাঁর শিক্ষক কার্ল লিন্ডে-র কারখানায় যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজকর্ম শুরু করেন। এখানে তিনি নানারকমের জিনিস আবিষ্কার করে সকলের তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এখানেই রুডলফ গ্যাসকে অতিরিক্ত চাপে সংকুচিত করে ইঞ্জিনে প্রয়োগ করার কাজ শুরু করেন। তিনি দেখেছিলেন যে একটা সিলিন্ডারের মধ্যে যদি বাতাসকে ভরে তারপর পিস্টনের আগুপিছু চলনের মাধ্যমে ওই বাতাসকে অত্যন্ত গরম করে ফেলা হয় (প্রায় হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট) তখন ওই পাত্রে আণবিক জ্বালানি ভরে দিলে তা প্রচুর তাপ উৎপন্ন করে। 


এই নীতির ওপর ভিত্তি করেই রুডলফ তৈরি করেন তাঁর ইঞ্জিন, যেটা তাঁরই নামে ডিজেল ইঞ্জিন নামে পরিচিতি পায়। দামে কম, আর কাজেও আগেকার সব ইঞ্জিনের চেয়ে বেশি কর্মক্ষম এই ইঞ্জিন দ্রুত জনপ্রিয়তা পায় এবং জার্মানি জুড়ে এর উৎপাদন শুরু হয়। জার্মানির সঙ্গে ব্রিটেন বা অন্য কয়েকটি দেশের মধ্যে এই ইঞ্জিনের পেটেন্ট চুক্তি হওয়ার ফলে রুডলফ প্রচুর প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। কিন্তু তাঁর খারাপ কপাল, প্রচুর উপার্জন করেও তিনি সেই অর্থ সঞ্চয় করতে পারেননি, নানা ভুল জায়গায় বিনিয়োগ করে প্রচুর ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। 

কিন্তু নানাভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হলেও তাঁর অবস্থা এতটা খারাপ হয়নি যে তাঁকে আত্মহত্যার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর তাঁর আচরণে বা কথাবার্তাতেও এমন কোনো ইঙ্গিত কেউ দেখেননি।  

তবে তাঁর এই খ্যাতির কারণে অনেকে তাঁর ওপর ঈর্ষান্বিত ছিলেন, এমন প্রমাণও আছে। কেউ কেউ বলেন, জার্মান সিক্রেট সার্ভিসের লোকেরাই নাকি তাঁকে মেরে গুম করে দিয়েছিল, কারণ রুডলফের আবিষ্কৃত ইঞ্জিন দিয়ে এক ধরনের ইউ আকৃতির বোট তৈরি করা সম্ভব হতে পারত, আর সেই বোটের ডিজাইন রুডলফ নাকি জানিয়ে দিতে চলেছিলেন ব্রিটিশদের, যা পছন্দ করেনি জার্মানেরা। প্রতিপক্ষ বিভিন্ন উদ্ভাবকদলের কর্মকর্তারাও রুডলফের এই রহস্য-নিরুদ্দেশের পিছনে দায়ী থাকতে পারেন বলেও মনে করেছিলেন অনেকে।  

রুডলফ ডিজেলের নাম আজ হয়ত খুব বেশি কেউ জানেন না, কিন্তু তাঁর আবিষ্কার আমাদের প্রতিনিয়ত নানাভাবে উপকার করে চলেছে, অথচ এরকম একজন মানুষের জীবনের শেষটুকু থেকে গেল হাজারো প্রশ্নের অন্তরালে। 

#silly point #Rudolf Diesel #diesel engine #science #technology #সিলি পয়েন্ট #অর্পণ পাল #ফিচার #ডিজেল #বাংলা পোর্টাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

142

Unique Visitors

184713