উন্নয়ন বনাম ‘পবিত্রতা’ : পিয়ের রাভির অ্যাগ্রো - ইকোলজির দর্শন
ফরাসি ভাষায় De Croissance ও Simplicite Volontaire। ইংরেজিতে যথাক্রমে De Growth ও Simple Living। এককথায় এই দুটো শব্দই পিয়ের রাভির দর্শনের মূল নির্যাস। গোটা পৃথিবী ঊর্ধ্বশ্বাসে যেদিকে ছুটছে, তার উল্টো পথটাই তাঁর। আত্মভুক সময়ের মুখব্যাদানের সামনে আশ্চর্য এক বিকল্প কৃষি- পরিকল্পনার ব্লু প্রিন্ট পকেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভদ্রলোক। ফলিতভাবেও চূড়ান্ত সফল। প্রচুর স্বীকৃতি। পাশাপাশি বিতর্কও প্রচুর।
রাভি নিজেকে বলেন Agro - Ecologist। বাংলা করলে দাঁড়ায় কৃষি - বাস্তুতন্ত্রবিদ। শব্দবন্ধটির বিশদ ব্যাখ্যায় যাবার আগে সংক্ষেপে রাভির জীবন ও কার্যকলাপের রূপরেখাটুকু দেখে নেওয়া যাক। জন্ম ১৯৩৮ সালে আলজিরিয়ার এক শ্রমিক পরিবারে। বড় হয়ে ওঠা মূলত ফ্রান্সে। জন্মসূত্রে মুসলিম রাভি পরে খ্রিস্টান ধর্ম নেন। আরও অনেক পরে অবশ্য প্রাতিষ্ঠানিক সমস্ত ধর্মকেই ঘোষিতভাবে অস্বীকার করেন। পরিবেশবিদ পিয়ের রিচারডের সঙ্গে ফ্রান্সের শেভাঁ ন্যাশনাল পার্কের পরিকল্পনার সুযোগ পাবার পর রাভি পরিবেশবান্ধব কৃষির নানা সম্ভাবনার দিক নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। প্রচলিত কৃষিব্যবস্থার অন্ধ উৎপাদনমুখী মডেলটির প্রতি তিনি একরকম বিমুখতা অনুভব করতে শুরু করেছিলেন। স্ত্রী মিশেলের সহায়তায় রাভি পরিবেশ ও কৃষি নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করতে থাকেন। অচিরেই তাঁর অভিনব চর্চার স্বীকৃতি আসে। ১৯৮১ সালে ফরাসি সরকারের অনুরোধে আফ্রিকার বুরকিনা ফাসো নামে একটি দেশে, তারপর ক্রমে মরক্কো, তিউনিশিয়া, সেনেগাল, টোগো, বেনিন, পোল্যান্ড, ইউক্রেনের মতো দেশে তিনি কৃষি - বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেন। তিউনিশিয়ার শেনিনি গাবেস মরুভূমির পুনরুজ্জীবনে ম্যাজিকের মতো কাজ করেছিল তাঁর পরিকল্পনা। ১৯৯৪ সাল থেকে তাঁর নেতৃত্বে একটি পরিবেশমুখী কৃষি- আন্দোলন জন্ম নেয়, মূল ফরাসি ভাষায় যার নাম Oasis en tous lieux (বাংলা অনুবাদে, সর্বত্রই মরুদ্যান)। ভূমির মরুকরণ রোধের জন্য রাভির পরিকল্পনা বিশ্বের বহু দেশ থেকে স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘও।
রাভির এই Agro - Ecology কিন্তু নিছক জৈব কৃষির একটা গালভরা উপস্থাপনা নয়। তার থেকে অনেক ব্যাপ্ত, গভীরতর একটি ধারণা। বলা যায়, রাভির ভাবনায় জৈব কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যবোধ, ভালোবাসা, দায়িত্ব, এবং রাভির নিজের ভাষায় একটি ‘পবিত্রতা’র বোধ। আধুনিক কৃষিব্যবস্থা, সে ‘জৈব’ বা অন্যতর যে নামই ধারণ করুক না কেন, আসলে ধনতান্ত্রিক দর্শনের অনুসারী। প্রকৃতি ও প্রাণচক্র তার কাছে নিছক কাঁচামাল ছাড়া কিছুই না। এর বিপরীতে রাভি দাঁড় করাতে চেয়েছেন তাঁর এই ‘পবিত্রতা’কে। অবশ্য এই শব্দটিই তাঁর দর্শনকে নানা প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। অধ্যাত্মবোধের বিষয়টিকে আক্রমণ করে অনেকেই রাভির ভাবনাকে ‘ছদ্ম বিজ্ঞান’ বলে ব্যঙ্গ করেছেন। পুঁজিবাদী উন্নয়নের পক্ষে থাকা কৃষিবিদেরা, বলাই বাহুল্য, এই সুযোগটির পরিপূর্ণ সদ্বব্যবহার করতে চেয়েছেন। ‘পবিত্রতা’ বিষয়টিকে Parole de terre গ্রন্থের (ইংরেজি নাম As in the heart, so in the earth) মুখবন্ধে রাভি ব্যাখ্যা করেছেন এইভাবে - “A Sense of humility, where gratitude, knowledge, wonder, respect and mystery all come together to inspire ad enlighten our actions”। প্রশ্ন হতে পারে, কার কাছে এই নতজানু হবার কথা রাভি বলছেন? কোন বিস্ময়ের কাছে এই বিনম্র প্রণিপাত, এই কৃতজ্ঞতা চাইছেন তিনি?
জোসেফ রয়ের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে রাভি স্পষ্ট জানান, এই ‘পবিত্রতা’র সঙ্গে মানুষের ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসের কোনও সম্পর্ক নেই। আসলে রাভি এমন একজন কৃষিবিদ যিনি এক অখণ্ড সামগ্রিক অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন। পঞ্চভূত ও প্রাণচক্র মিলে যে সজীব প্রকাণ্ড সত্য, তাতে জোর দিতে চান তিনি। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার নির্মম, নির্বিচার লুণ্ঠনের হাত থেকে পৃথিবীর স্বাভাবিক গতিমুখকে রক্ষা করার এই একটিই উপায় বলে তাঁর বিশ্বাস। রয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাভি জানান, শুষ্ক যুক্তিসর্বস্বতার মধ্যেই আধুনিক পরিবেশবাদীদের ধারাবাহিক ব্যর্থতার আসল কারণ নিহিত। যুক্তিকে বিস্ময় ও সৌন্দর্যবোধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা কমে যায়। রাভির ভাষায় - “They can inform you quite well about what is wrong, but they have no visionthat engages true enthusiasm. Of course we must speak of what is wrong, of the terrible damage weare doing to the Earth. But if we do so without a sense of the sacred, and without the courage to let it show, let it be heard and felt by others, we ultimately fall prey to negative emotions”।
ভোগের ভয়ঙ্কর হাতছানি আমাদের মস্তিষ্ক ও ইন্দ্রিয়কে যেভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলছে, তার ওষুধ হতে পারে একমাত্র মিসটিক চেতনা, এমনই মনে করেন রাভি। অস্ট্রিয়ান চিন্তাবিদ রুডলফ স্টেইনারের অ্যানথ্রোপোজফি বা বায়োডায়নামিক কৃষির ধারণা দ্বারা রাভি ব্যাপকভাবে প্রভাবিত। বলা যায়, স্টেইনারের পরিবেশভাবনার একটি সম্প্রসারিত রূপকে তিনি অসাধারণভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছিলেন। কৃষিবিদ হিসেবে তিনি মনে করেন, মাটির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিই আসল কথা। নির্ভেজাল জৈব চাষ রাসায়নিক চাষের চেয়ে অনেক ভালো কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু তার সঙ্গে ওই পবিত্রতার বোধটি যদি না থাকে, তার মানে জৈব চাষও মাটিকে কাঁচামাল ছাড়া আর কিচ্ছু ভাবছে না। আর এই পবিত্রতার বোধ শুধু মাটির প্রতি নয়, থাকতে হবে মাটির ওপর নির্ভরশীল অন্যান্য জীবের প্রতিও। পড়শিদের প্রতি যথোচিত সম্মান ও সহ - অনুভূতিও এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবাই মিলেমিশে থাকার একটি প্রস্তাবকেই আধুনিক কৃষিবিদ্যার দিক থেকে দেখাতে চেয়েছেন রাভি।
Parole de terre গ্রন্থে গল্পের ছলে রাভি আমাদের জানাতে চান, লোকায়ত জীবনের মধ্যেই ছিল এই দর্শন। আমাদের আদিপুরুষেরা পৃথিবীকে মনে করতেন মা। প্রতিটি প্রাকৃতিক উপাদানের মধ্যে তাঁরা দৈব এক উদ্ভাস দেখতেন। জীব বা অজীব সমস্ত কিছু মিলিয়ে যে নিবিড় ঐক্যের সূত্র, তাতে শ্রদ্ধা ছিল তাঁদের। বিপুল নিরবধি প্রাণচক্রের অংশ হিসেবে দেখতে পেতেন তাঁরা নিজেদের। প্রচণ্ডগতির সভ্যতা কবেই পিছনে ফেলে এসেছে সেসব ইতিহাস। আজ ফের আমাদের পিছন ফিরে দেখার সময় এসেছে। অতীতের ধ্বংসস্তূপ ঘেঁটে খুঁজে নেবার সময় এসেছে হারিয়ে যাওয়া সেই লোকবিশ্বাস ও লোকপ্রজ্ঞাকে। কাহিনির প্রধান চরিত্র বৃদ্ধ তাইমোরোর কথাসূত্রে রাভি সেই ইস্তেহারই বুনে তোলেন। প্রকৃতপ্রস্তাবে তাঁর দর্শন যৌথ যাপনের কথা বলে। চারপাশের সবকিছুকে মূল্য দিতে চাওয়া, ভালবাসতে চাওয়া - এই হল তাঁর দর্শনের মূল কথা। অনন্ত লোভ আর আপাদমস্তক ভোগের বিপ্রতীপে রাভির বহু বিতর্কিত ‘পবিত্রতা’ আসলে পৃথিবীর দিকে মানুষকে ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিতে বলে। ভালোবাসারই সম্প্রসারিত রূপ এই ‘পবিত্রতা’। ভালোবাসা ছাড়া আর কী। আমাদের বাঙালি কবিবর তো কবেই ‘পুণ্যের হিসাব’ কবিতায় লিখেই গেছেন, “যারে বলে ভালোবাসা, তারে বলে পূজা।” পিয়ের রাভি রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন কিনা সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে, পড়ুন বা না পড়ুন, তাঁরও অবিকল এটাই বক্তব্য।
ঋণ : ১) A New Shade of Green : Interview with Pierre Rabhi by Joseph Rowe (এই লেখাটি সংযোজিত হয়েছে রাভির Parole de terre গ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদ As in the heart, so in the earth-এর appendix অংশে। মূল ফরাসি থেকে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন জোসেফ রোয়ে)।
২) দেবাশিস তরফদার / জানালা : একটি এককপত্র / তৃতীয় সংখ্যা, আশ্বিন ১৪২৫ / ভাষালিপি।
ফিচারহেড : অর্পণ দাস।
#পরিবেশ ও প্রাণচক্র