নিবন্ধ

রহস্যের দুনিয়ায় হাসির জোগান দেন গোয়েন্দা বরদাচরণ

সৃজিতা সান্যাল June 12, 2021 at 9:38 am নিবন্ধ

বাংলা গোয়েন্দা গল্পের দুনিয়ায় হাস্যরস এবং রহস্যের ঘনঘটা – এই দুই ব্যাপারের এক সুতোয় গাঁথা পড়াটা ‘Once in a blue moon’ ঘটে থাকে। আর সেই বিরলতার উত্তরাধিকার নিয়েই সাতের দশকের মাঝামাঝি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় তাঁর কিশোর গল্পে এনে ফেলেছিলেন গোয়েন্দা বরদাচরণকে। তবে তাঁর উত্তরসূরি শিবরামের কমিক গোয়েন্দা কল্কেকাশি যেমন বেশি গল্পে আত্মপ্রকাশ করতে চাননি, তেমনি বরদাচরণও খুব বেশি সংখ্যক গল্প জুড়ে গোয়েন্দাগিরির সুযোগ পাননি। ১৯৭৬ সালে তাঁর ডেবিউ ঘটে পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায়, ‘গোয়েন্দা বরদাচরণ’ গল্পে। তারপর যে যে গল্পে তাঁকে দেখা যায় সেগুলো হল, ‘গয়াপতির বিপদ’, ‘তাহলে’, ‘বহুরূপী বরদাচরণ’, ‘কুস্তির প্যাঁচ’, ‘নয়নচাঁদ’ আর ‘পটলবাবুর বিপদ’। উপন্যাসের মধ্যে তাঁর দেখা মেলে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’তে। লেখকের মুনশিয়ানায় মাত্র এই কটা গল্পেই কিন্তু বরদাচরণের বেশ স্পষ্ট একটা ছাঁদ আমরা পাঠকেরা পেয়ে যেতে থাকি।

প্রথম গল্পে বরদাচরণের বয়স ত্রিশ বত্রিশ। অন্যান্য গল্পে তাঁর বয়েস বেড়েছে কি না তার হদিশ তেমন পাওয়া যায় না। তবে ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’তে তাঁর দেয়াল থেকে লাফানোর প্রসঙ্গে বলা হয় “এ বয়সে লাফ-টাফ দিলে হাত-পা ভাঙতে পারে।” শারীরিক ফিটনেস গোয়েন্দাদের পক্ষে প্রায় অপরিহার্য– এই চলতি নিয়ম মেনে বরদাচরণ কুস্তি, জুডো, বক্সিং ইত্যাদি শিখেছেন। শরীরচর্চা করা রীতিমতো স্বাস্থ্যবান চেহারা তাঁর। ‘মোটাসোটা’, ‘দশাসই’ ইত্যাদি বিশেষণ প্রয়োগ করা হয়েছে তাঁর সম্বন্ধে। তা ছাড়া মনে রাখতে হবে, নামকরা কুস্তিগির অম্বিকাচরণের নাতি তিনি। পঁচাশি বছর বয়সেও যে লোক কুয়ো থেকে ত্রিশ-বত্রিশ বালতি জল তোলেন, কুড়ুল চালিয়ে দু-মন করে কাঠ কাটেন, কুংফু-ক্যারাটে অভ্যেস করেন রোজ, ভোররাতে উঠে দেড়শো বুকডন আর তিনশো বৈঠক, তাঁরই রক্ত বইছে কিনা বরদাচরণের দেহে। আর সেইজন্যই বোধহয় মনোজদের কুখ্যাত গোরু হারিকেনের সঙ্গে বুলফাইটের পরেও টিকে যান তিনি। ঝালুরামের খপ্পরে পড়ার পর উতরে যান রণপায়ে চড়ে পাঁচ ক্রোশ পথ হাঁটার বা বিশ হাত ওপর থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ার মতো দুঃসাহসিক কাজেও। 

প্রথমে বুড়ি মা-কেই তাঁর বাড়ির একমাত্র সদস্য বলে মনে হলেও ‘বহুরূপী বরদাচরণ’ গল্পে তাঁর বাবা এবং বুড়ি পিসিকে দেখা যায়। ‘কুস্তির প্যাঁচ’ গল্পে আবার দেখি, দাদু অম্বিকাচরণের সঙ্গে নিয়মিত মর্নিং ওয়াকে যেতে হয় তাঁকে। প্রথম গল্পে আর ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’ উপন্যাসে তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট ভাগ্নে চাক্কু। চতুর্থ গল্প ‘তাহলে’-তে চাক্কুর জায়গায় আসে ভাগ্নে কঞ্চি। বাকি গল্পগুলোয় অবশ্য একাই কাজ করতে দেখি তাঁকে। মোটামুটি নামডাকসম্পন্ন ডিটেকটিভদের একজন করে নির্ভরযোগ্য অ্যাসিস্ট্যান্ট থাকাটাই মূলধারার গোয়েন্দা গল্পের দস্তুর। এ বাবদে বরদাচরণের ভাগ্য বিশেষ সুবিধের ছিল না বলেই মনে হয়। 

তবে বরদাচরণের মধ্যে একাধিক টিপিকাল গোয়েন্দালক্ষণের সমাবেশ ঘটিয়েছেন তাঁর স্রষ্টা। গোয়েন্দাগিরির পদ্ধতিতে তিনি ক্লাসিক পথেরই পথিক। ব্যোমকেশ-ফেলুদার মতো প্রাইভেট ডিটেকটিভদের প্রধান সম্বল ছিল তাঁদের মগজাস্ত্র, তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা (Observation and Deduction)। বরদাচরণও কিন্তু তার ব্যতিক্রম নন। ক্লু খোঁজার উপকরণ হিসেবে তাঁর সঙ্গে সর্বদা মজুত থাকে আতশকাচ, বাইনোকুলার, দড়ি, ক্যামেরা, টেপ-রেকর্ডার ইত্যাদি। আত্মরক্ষার জন্য থাকে পিস্তল। সেটা নাকি তাঁর “হাতের আঙুলের মতো অচ্ছেদ্য।” সবসময় সতর্ক থাকতে হয় বলে ‘তাঁর ঘুম কুকুরের ঘুমের মতো পাতলা’। কেস সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট তিনি টুকে রাখেন কেস-ডায়রিতে। অপরাধীকে কখনও বুঝতে দেন না যে সে-ই সন্দেহের টার্গেট। ‘গোয়েন্দা বরদাচরণ’ গল্পে অম্বুজাক্ষের কাকাতুয়ার খাবারে বা জলে বিষ মেশানো ছিল কি না তা জানার জন্য তিনি যে পদ্ধতি নেন তাও মূলত পর্যবেক্ষণনির্ভর। একইসঙ্গে লাউচুরি-নারকোল চুরি-কাকাতুয়া নিরুদ্দেশ ও কাকাতুয়া মৃত্যুর মতো জড়িয়ে যাওয়া জটিল সমস্যার সমাধানে কাজে আসে তাঁর যুক্তি ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা। জমিদার বজ্রকুণ্ডলের ঠাকুরদার আমলের সোনার ঘড়ির খোঁজে বরদাচরণ অন্তত পঞ্চাশটা আলমারির মাথায় ওঠেন, কুড়িটা খাটের তলায় ঢোকেন এবং কমপক্ষে পঁচিশটা ঘরে আঁতিপাঁতি করে সন্ধান চালান। এ থেকেই প্রমাণ হয়ে যায় পর্যবেক্ষণ নিয়ে তাঁর চূড়ান্ত অবসেশন। 




কমিক ডিটেকটিভ হলেও যে গুণগুলো বরদাচরণ চরিত্রকে উজ্জ্বল করে তোলে তার মধ্যে অন্যতম, কাজে তাঁর চূড়ান্ত নিষ্ঠা, তাঁর একাগ্রতা, প্যাশন এবং একবগ্‌গা স্বভাব। এর বাড়াবাড়ি গল্পে তৈরি করে একধরনের মক-সিরিয়াসনেস। সিরিয়াস গোয়েন্দাগল্পে কমিক রিলিফের প্রয়োজন পড়লে স্বয়ং গোয়েন্দা ছাড়া এক বা একাধিক চরিত্র সচরাচর তার জোগান দিয়ে থাকে। বরদাচরণ কিন্তু নিজেই তাঁর গল্পে একাধারে নায়ক ও কমিক রিলিফ। সারাক্ষণই তাঁর মাথায় নানারকম কেসের চিন্তা ঘোরে। কাজে একবার নেমে পড়লে কেস সলভ করা ছাড়া আর-কিছুতেই তাঁর হুঁশ থাকে না। তাঁর নিজের কথায় “ডিউটি ইজ ডিউটি”। তাই খেয়ে নেওয়ার জন্য মায়ের ব্যাকুল ডাক কানে না তুলেই তিনি বেরিয়ে যান অকুস্থলে। মৃত কিংবা নিরুদ্দিষ্ট জনার্দনের বউ-ছেলে-মেয়ের খোঁজ নিয়ে যখন ফেরত আসেন ক্লায়েন্ট নয়নচাঁদের কাছে, তখন দেখা যায় টানা তিনদিন অনিয়ম-অত্যাচারের ফলস্বরূপ তাঁর চুল উশকোখুশকো, গায়ে ধুলো, চোখ লাল। ঘড়ি খোঁজার তদন্তে নেমে গা-ভর্তি ধুলো-ঝুল, পকেটভর্তি ইঁদুর, এমনকি কাঁধে টিকটিকি মিললেও পরোয়া করেন না তিনি। মনোজদের গোরু তাঁকে চার হাত দূরে ছিটকে ফেললেও, তদন্তের স্বার্থে গুরুতর আঘাত নিয়েই সরোজ-মনোজকে জেরা করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বজ্রকুণ্ডলের ঘড়ি খুঁজতে গিয়ে তার বদলে বরদাচরণ খুঁজে পান পুকুরের তলার গোপন সুড়ঙ্গ, যেখানে লুকোনো আছে লাখ-লাখ টাকার হিরে-জহরত। এহেন অভাবনীয় প্রাপ্তিতেও কিন্তু তাঁর বিশেষ দোলাচল লক্ষ করা যায় না, কারণ তাঁর কেসের ক্ষেত্রে ওসব অবান্তর! বজ্রকুণ্ডল তাঁকে দশ লাখ টাকা দেবেন এ কথা শুনে ঘোষণা করেন, ঘড়ি খুঁজে পেলে তবেই তিনি টাকা নেবেন, তাও তাঁর নিয়মিত ফিজ একশো টাকার বেশি নয়।   

এই একটা ঘটনা থেকেই বোধহয় বরদাচরণের চরিত্রের আরও একটা দিক উঠে আসে। তা হল তাঁর সৎ নির্লোভ মানসিকতা, নৈতিক কম্পাস। কমিক আবহে গড়ে তুললেও বরদাচরণের মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় কোনও খামতি রাখেননি শীর্ষেন্দু। সামাজিক প্রতিপত্তি বা অর্থের প্রাচুর্যকে পাত্তা না দিয়ে তিনি যে-কোনো লোকের বিচ্যুতি বা অন্যায়কে দেখিয়ে দেন চোখে আঙুল দিয়ে। সে দারোগা গয়াপতিই হোন, বা নিজের মক্কেল গদাধরবাবু বা নয়নচাঁদ! কঠিন স্বরে গয়াপতিকে তিনি জানিয়ে দেন, “ডাকাতরা তো রাতে ডাকাতি করে, কিন্তু এখানকার লোক জানে যে আপনি এখানে দিনে ডাকাতি করতেন। রোজ মাছ, দুধ, পাঁঠা, মুর্গি ভেট নিতেন। প্রতি মাসে নগদ টাকায় নিয়মিত ঘুষ খেয়েছেন।” ধনী মক্কেল নয়নচাঁদকে “যাচ্ছেতাই রকমের কৃপণ”, “পৃথিবীর সবচেয়ে কৃপণ লোক”, কিপটেমিতে “চ্যাম্পিয়ন”-এর মতো কথা একাধিকবার শোনাতে কসুর করেন না। 

গোয়েন্দা বরদাচরণ গল্পে দেখা যায় বরদাচরণের কাছে ছোটোখাটো যে কেসগুলো পর পর এসেছে, সবকটার ক্ষেত্রেই আসল অপরাধী তাঁর ভাগ্নে চাক্কু। মনোজদের অদ্ভুত বাড়িতেও রাখোবাবুর মুখে শোনা যায়, সরস্বতীপুজোর আগের দিন থেকে তাঁদের বাড়ি থেকে ফলফুল চুরি করার ব্যাপারেও চাক্কুর হাত ছিল। এইসব কারণেই কি তাহলে অ্যাসিস্ট্যান্ট পদ থেকে ডিমোশন ঘটল চাক্কুর? কারণ, এর পর থেকে আর কোনও গল্পেই তাকে সহকারী হিসেবে দেখা যায় না। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে সেক্ষেত্রেও, বরদাচরণের অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার মনোভাবই জারি ছিল ধরে নেওয়া যেতে পারে।     

নৈতিক কারণেই সম্ভবত, বরদাচরণ এক-একজন মক্কেলের থেকে এক-একরকম দক্ষিণা নিয়েছেন। গরীব জমিদার বজ্রকুণ্ডলের কাছে তাঁর ফি একশো টাকা। অথচ টাকার পাহাড়ের ওপরে বসে থাকা নয়নচাঁদের কাছে তিনি ফি হিসেবে পাঁচশো টাকা চেয়েছিলেন। আবার হরিণগড়ের রাজা তাঁকে নিরুদ্দিষ্ট ছেলের ছবি খোঁজার কাজে নিয়োগ করেন মাসে পাঁচশো টাকা বেতন দিয়ে।   

আরও একটা বিষয় উল্লেখ করার মতো। অধিকাংশ ডিটেকটিভের মতো শুধু অপরাধী কে তা চিহ্নিত করার দায়িত্ব পালন করেই হাত ধুয়ে ফেলেন না বরদাচরণ। যাতে অন্যায় নিবারণ হয় এবং অপরাধী যাতে অপরাধ স্থালনের একটা সুযোগ পায় সেই চেষ্টা করেন আপ্রাণ-- যদিও এই কাজ সরাসরি গোয়েন্দাগিরির আওতায় পড়ে না। ‘পটলবাবুর বিপদ’ গল্পে সুদের কারবারি পটলবাবু পাঁচশো টাকার বদলে গরিব শ্রীমন্তের কাছ থেকে সুদে-আসলে পাঁচ লাখ টাকা উসুল করেছিলেন। এদিকে এই পটলবাবুই ছিলেন বরদাচরণের ক্লায়েন্ট। বরদাচরণ সেই পাঁচ লাখ ও আরও দশ হাজার টাকা ফেরত দিতে রাজি করান পটলবাবুকে। এর বিনিময়ে ‘দক্ষ গোয়েন্দা’-র সার্টিফিকেট মেলে ভিমরুলের মতো দুর্ধর্ষ অপরাধীর কাছ থেকে। ‘নয়নচাঁদ’-এর বেলাতে প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখি আমরা। সুদের কারবারি নয়নচাঁদ দেনার দায়ে পথে বসিয়েছিল জনার্দনকে। শোনা যায় ক্ষোভে-দুঃখে আত্মহত্যা করেছিল জনার্দন। দীর্ঘদিন পর এক ভূতের হুমকি পেয়ে গোয়েন্দার শরণাপন্ন হয় নয়নচাঁদ। জনার্দন বেঁচে আছে কি না সে তর্কের নিষ্পত্তি হয় না বটে, কিন্তু নয়নচাঁদের পূর্বকৃত অপরাধ লাঘব করতে তার বউ-ছেলেমেয়ে এবং আরও দশটি পরিবারের থেকে কেড়ে নেওয়া সবকিছু ফেরত দিতে বাধ্য করেন বরদাচরণ। শুধু তাই নয়, ভিখারিদের নিয়মিত দান ধ্যান এবং কিপটেমি বাদ দিয়ে ভালোমন্দ খাওয়াদাওয়াকেও নয়নচাঁদের অভ্যেসে পরিণত করার দায়িত্ব নিয়েছিলেন বরদাচরণ। আবার, কুমার কন্দর্পনারায়ণকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে কিশোর মনোজের কৃতিত্বও বিনা দ্বিধায় স্বীকার করেছিলেন তিনি।          

বরদাচরণ কিন্তু ঠিক আর্বান গোয়েন্দা নন। গল্প পড়ে আন্দাজ করা যায় তাঁর বিচরণক্ষেত্র মুখ্যত তাঁর নিজের গ্রাম এবং আশেপাশের অঞ্চল। বাংলা সাহিত্যের নামকরা গোয়েন্দারা প্রায় সকলেই শহরকেন্দ্রিক যাপনে অভ্যস্ত। সেদিক থেকে বরদাচরণের শুরুটা বেশ অন্যরকম। প্রথমদিকে নিজের এলাকার লাউচুরি নারকোলচুরি ফুলচুরি বা পোষা কাকাতুয়ার মৃত্যুর মতো তুচ্ছ ব্যাপারেও তাঁকে প্রচণ্ড অভিনিবেশ নিয়ে কাজ করতে দেখা যায়। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’-তে শোনা যায়, ওই অঞ্চলের সমস্ত গোরুচুরির কেসের সমাধানে বরদাচরণের খুব নামডাক। ‘গয়াপতির বিপদ’ গল্পে অবশ্য বরদাচরণ দাবি করেন তিনি আর লাউচুরি বা গোরুচুরির মতো এলেবেলে কেস নেন না। এখন তাঁর কাছে আসে পুকুরচুরির মতো চরম রহস্যময় কেস। শুধু তাই নয়, এভারেস্ট চুরি এবং তাজমহলের চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত দুটি আন্তর্জাতিক পাচার চক্রকেও নাকি ধরেছেন তিনি। ‘কুস্তির প্যাঁচ’ গল্প থেকে জানা যায়, খুনির পিস্তলের মুখে পড়া বা কুখ্যাত হাইজ্যাকারদের পিছু নিয়ে বোয়িং বিমানের কেবিনের মধ্যে দুর্দান্ত ‘ফাইট’ করে তাদের ঘায়েল করা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। মোট কথা, পরের গল্পগুলোয় বরদাচরণের কেরিয়ার গ্রাফ যে ঊর্ধ্বমুখী সে নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বোঝা যায়, বদল এসেছে গোয়েন্দাগিরির চারিত্র্যেও। গ্রামীণ আবহে থাকা গোয়েন্দা একটু বিখ্যাত হতেই এবার ঝুঁকে পড়ছেন আর্বানাইজেশনের দিকে। মোক্ষদা পিসি বা অম্বুজাক্ষবাবুর মতো গ্রামের গরিব বা মধ্যবিত্ত মক্কেলের জায়গায় দেখা যায় নয়নচাঁদ, গদাধরবাবু বা পটলবাবুর মতো বড়োলোক কারবারিদের, অথবা গোবিন্দনারায়ণ, বজ্রকুণ্ডলের মতো হৃতগৌরব রাজা বা জমিদারকে। মজার কথা হল, বরদাচরণের বেশিরভাগ গল্পেই ‘সর্ষের মধ্যে ভূত’ অর্থাৎ এই বড়োলোক মক্কেলরাই আসল অপরাধী বলে প্রমাণিত হন।           

বরদাচরণের যে বিশেষত্বের কথা না বললে তাঁকে নিয়ে লেখা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়, তা হল তাঁর অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা। গোয়েন্দাগিরির থ্রিল সহজে হাতছাড়া করতে চান না বলেই তিনি সচরাচর সদর দরজা দিয়ে মক্কেল-বাড়িতে ঢোকেন না। তাঁর মতে, “গোয়েন্দাদের আচার আচরণে একটা রহস্যময়তা না থাকলে লোকে সেই গোয়েন্দাকে মানবেই বা কেন?” তাই কোনও দরকার না থাকলেও পাঁচিল ডিঙনো, দেয়াল টপকানো, গাছ বেয়ে ওঠা, জানলার শিক বাঁকানো, জানলা ভাঙা– ইত্যাদি নানা অভাবনীয় মৌলিক উপায় তিনি মক্কেল-বাড়িতে ঢোকার জন্য উদ্ভাবন করেছেন। নয়নচাঁদের বাড়িতে বরদা ঢোকেন টারজানের কায়দায়। বটগাছের ঝুরি ধরে দোল খেয়ে যথাক্রমে পাশের জাম ও চালতাগাছে লাফিয়ে পড়ে, পাঁচিল ডিঙিয়ে, রেইন পাইপ ধরে উঠে যখন বরদাচরণ নয়নচাঁদের তিনতলার জানলায় উঁকি দেন, তখন ভয় পেয়ে আঁতকে উঠে ভিরমি খেয়েছিলেন তাঁর ক্লায়েন্ট। শোনা যায় এক বাড়িতে নাকি সিঁধ কেটেও ঢুকেছিলেন তিনি। এইভাবে গোয়েন্দাগল্পের পপুলার বা পাল্প ধারাকে ঈষৎ ব্যঙ্গ করতেই যেন বরদার চরিত্রে অহেতুক উত্তেজনা পোহানোর অভ্যেস ঢুকিয়ে দেন শীর্ষেন্দু।  

বরদাচরণের তদন্তের পদ্ধতিও অন্যদের থেকে আলাদা। চোর বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে ঢুকে থাকলে তিনি তদন্ত শুরু করেন বাড়ির উত্তর দিক থেকে। যত দুঃসাহসিক কাজই হোক না কেন, বরদাচরণকে দমানো যায় না কিছুতেই। গোয়েন্দাগিরির কাজেই সিমলায় একবার পাহাড় থেকে লাফ দিয়েছিলেন তিনি। আলিপুরের টাঁকশালে ঢুকে গিয়েছিলেন সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে। আর কারণে অকারণে চলন্ত ট্রেন বা মোটর থেকে লাফ দেওয়া তো তাঁর কাছে জলভাত। 

অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তার কারণেই তাঁর বহু তদন্তে ছদ্মবেশ ধারণের খুব গুরুতর একটা ভূমিকা থাকে। গয়াপতির বিপদ গল্পে একেকবার একেকরকম ছদ্মবেশ নিয়ে পুলিশকে বোকা বানিয়েছে ডাকাত ঝালুরাম। ‘বহুরূপী বরদাচরণ’ গল্পে ঠিক সেই কাজটাই করেছেন বরদাচরণ স্বয়ং। তবে পুলিশকে বোকা বানাতে নয়, অপরাধীকে ধরতে। এই কাহিনিতে দেখি, ছদ্মবেশে বরদার পারদর্শিতা প্রায় মিথ-হয়ে-যাওয়া একটা ব্যাপার! ঘন ঘন ছদ্মবেশ ধারণের জেরে তার আসল চেহারা যে ঠিক কেমন ছিল তাই-ই বহু লোকে ভুলতে বসেছে, মায় তাঁর মা-বাবা। কখনও তাঁর পাকানো গোঁফ, কখনও ঝোলা। কখনও ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি, কখনও বাবরি চুল, কখনও আবার ঝাঁকড়া চুল। চশমার রং কখনও লাল, কখনও কালো, কখনও নীল। কখনও তিনি পাগড়িওলা শিখ, কখনও লাঠি হাতে ফোকলা বুড়ো, আবার কখনও জটাজূটধারী সন্ন্যাসী। এমনকি তিনি গোরু হয়ে কারও গোয়ালে লুকিয়ে আছেন বা তালগাছ হয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে আছেন, এহেন কথাও তাঁর সম্পর্কে শোনা যায়। তবে, অপরাধী নিজেও ছদ্মবেশের টেকনিক প্রয়োগ করতে শুরু করায় প্রথমদিকে একটু বেকায়দায় পড়েছিলেন বরদাচরণ। শেষে মক্কেলের ড্রাইভার সেজে কেস সলভ করেন এই ডিটেকটিভ।   

আসলে কমিক গোয়েন্দা বলেই সর্বাত্মকভাবে নিখুঁত ও সর্বদাই চূড়ান্ত স্মার্ট কোনও আইকন হয়ে ওঠার দায় তাঁর ছিল না। তাই শের সিং তাঁকে ‘খোকা’ বা ‘শিশু’ বলে সম্বোধন করলেও তাঁর ইমেজের বিশেষ হেরফের হয় না। দাদু অম্বিকাচরণ তাঁকে হাত ধরে নর্দমা পার করান, ব্যস্ত রাস্তায় গাড়িঘোড়া দেখে সরিয়ে আনেন, আর বরদাচরণ তা মেনেও নেন চুপচাপ! তদন্ত চলাকালীন হামেশাই তিনি বেকায়দাতেও পড়েন। ডাকাত ঝালুরামকে ধরাতে গিয়ে দারোগা গয়াপতি ও বরদাচরণ দুজনে উল্টে তারই হাতে ধরা পড়েন। হুকুম হয়, তাঁদের দুজনকে চাটুজ্যে বাড়ির হংসেশ্বরীর সোনার মূর্তি চুরি করে আনতে হবে। নিজেরই মক্কেল-বাড়িতে ডাকাতি করার অভিজ্ঞতা, বলা বাহুল্য, বরদাচরণের পক্ষে খুব সুখের হয়নি। ছদ্মবেশ ধারণে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির ফলে তাঁর বাবা পর্যন্ত, নকল চুলদাড়ি আর কালিঝুলি বাদেও, তাঁকে চিনতে পারেননি। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’তে পেঁপেগাছের ডগা ধরে পাঁচিল থেকে নামার সময় কাকের ঠোক্কর খেয়ে মাটিতে পড়ে তাঁর মাথার ঘিলু নড়ে গিয়েছিল, কোমরেও আঘাত লেগেছিল। সঙ্গে খোয়া গিয়েছিল পিস্তল। “নিতান্ত গোয়েন্দাদের অজ্ঞান হতে নেই বলে তিনি অজ্ঞান হননি।” মনোজকে জেরা করার জন্য ক্রিকেট-মাঠে অপেক্ষা করার সময় তো রীতিমতো নাকাল হয়েছেন জনতার হাতে। কেউ তাঁর ফাঁকা পিস্তলের খাপ নিয়ে ব্যঙ্গ করেছে, কেউ সিটি দিয়েছে, কেউ কেড়ে নিয়েছে দূরবিন-সানগ্লাস। তারপরেই হারিকেনের সঙ্গে বুল ফাইটে ঘায়েল হয়েছেন। পরে রাজবাড়িতে ডাকাতরূপী ভজহরির হাত থেকে পালাতে গিয়ে উপর্যুপরি ধাক্কা খেয়েছেন সিংহাসন আর দেওয়ালে। 

যদিও এতকিছুর পরেও কুমার কন্দর্পনারায়ণকে খুঁজে না পাওয়া অবধি গোয়েন্দার কর্তব্য থেকে একচুল নড়েননি তিনি। এতেই লুকিয়ে আছে বরদাচরণের শেষতম ইউ এস পি। বাস্তবের মাটিতে আমাদের নায়কোচিত মুহূর্তের পাশাপাশিই থাকে চূড়ান্ত অপ্রস্তুত হওয়ার মুহূর্ত। দুঃসাহসের সঙ্গে মিশে থাকে ভয়ভীতি। সাফল্যের সঙ্গে রয়ে যায় ব্যর্থতার স্বাদও। কখনও-ভুল-না-করা, ঐশ্বরিক আই-কিউ-সম্পন্ন গোয়েন্দাদের প্রায়-দৈব ইমেজ পাঠকসমাজে জনপ্রিয় হয় বটে। কিন্তু তার বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা কমিক গোয়েন্দা বরদাচরণ হয়ে ওঠেন আমাদের কাছের মানুষ।




[পোস্টার: অর্পণ দাস]

#বাংলা #নিবন্ধ #গোয়েন্দা #ডিটেক্টit #শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় #বরদাচরণ #মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি #সৃজিতা সান্যাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

33

Unique Visitors

217849