গল্প

দীপুর বন্ধু, দীপুর প্রেম

সত্যকাম ধর July 27, 2024 at 9:09 pm গল্প

খবরটা বেরিয়েছিল কয়েকদিন আগের কাগজের সাতের পাতার বাঁদিকের কোণে ‘এক নজরে’ বলে যে আধ ডজন খবর ছাপা হয়েছে, তার মধ্যে। আমার চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। বর্ণালী মেয়ের পেচ্ছাপ, পায়খানায় ভরা ন্যাপকিনটা মুড়ে ডাস্টবিনে ফেলার জন্যে একটা পুরনো কাগজ চাইল, সেটা ছিঁড়তে গিয়ে চোখে পড়ল – ‘গৃহবধূর রহস্যজনক মৃত্যু’ শিরোনামে। খবরটা কয়েক লাইনের। বলা আছে দমদম রোডের অমুক অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা ৪০ বছর বয়সী গৃহবধূ দীপমালা মুখার্জির দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে শনিবার সন্ধেবেলা। সেইসময় বাড়িতে সে একাই ছিল, কারণ বর গিয়েছিল বন্ধুর বাড়ি তাস খেলতে আর শ্বশুর-শাশুড়ি এক আত্মীয়ের বাড়িতে কী একটা পুজোয়। দীপমালার ছেলে কোথায় ছিল সেটা কাগজে লেখেনি; তবে আমার ধারণা দাদু, ঠাকুমার সঙ্গেই গিয়েছিল। কারণ দীপমালা বলত ওঁরা ছেলেটাকে কিছুতেই কাছছাড়া করতেন না। একলা দীপমালার কাছে রেখে যাওয়ার তো প্রশ্নই নেই। মৃত্যুটা কেন ‘রহস্যজনক’ তা খবরে কোথাও লেখা নেই। যা লেখা আছে তা থেকে আত্মহত্যা ছাড়া অন্য কিছু ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমিও এতে কোনো রহস্য দেখছি না। দীপমালা যে একদিন আত্মহত্যা করবেই তা নিয়ে আমার কোনো সন্দেহ ছিল না। বরং ও এতদিন কী করে বেঁচে ছিল সেটাই আমার কাছে রহস্যজনক। বোধহয় ছেলেটার মায়া কাটাতে পারছিল না।

আমার এতদিন পরে খবরটা দেখে বিচলিত হয়ে পড়ার কিছু নেই। আর বিচলিত হয়ে করবই বা কী? যা হওয়ার তো হয়েই গেছে। দীপমালার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে কাউকে ফোন করে যে শোক প্রকাশ করব, তেমন কেউও নেই। ওর ভাইবোন ছিল না; বাবা, মা বছর দশেক হল গত হয়েছেন। যৌথ পরিবারের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ জেঠু, জেঠিমা, পিসি ওর এই অবস্থার জন্যে বেশ খানিকটা দায়ী; তাঁরা তো আরও আগে কেটে পড়েছেন। দীপমালার মামাতো না মাসতুতো এক দিদির সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল। একমাত্র তার কাছেই নাকি ও মন খুলে কথা বলতে পারত। কিন্তু তার সঙ্গে ওদের বাড়িতেই বার দুয়েক দেখা হয়েছে, নম্বর-টম্বর জানি না। তাছাড়া সে বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেছে শুনেছিলাম। আমি বাল্যবন্ধু মাত্র। আমার কী-ই বা অধিকার? আমি যদি এখন থানায় গিয়ে – কী যেন বলে উকিলদের ভাষায় – আত্মহত্যায় প্ররোচনা না কী, সেই অভিযোগ করে ওর বরের চোদ্দগুষ্টির বিরুদ্ধে একটা এফআইআর করি, পুলিস কী নেবে? নেবে না বোধহয়। একে তো প্রায় এক সপ্তাহ হয়ে গেছে, তার উপর আমি তো ওর কেউ হই না। তাছাড়া আমার অভিযোগ যে সত্যি সেটাই বা প্রমাণ করব কী করে? আমার সঙ্গে দীপুর অন্তরঙ্গ চ্যাট আর কিছু ফোনালাপ ছাড়া তো তেমন কিছু নেই। সেসবেও ও একবারও বলেনি যে ওকে মেরে ফেলার চেষ্টা করছে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা। এমনকি বাঁচতে ইচ্ছে করছে না, এমনও বলেনি। তাহলে অভিযোগটা করব কিসের ভিত্তিতে?


তার উপর এরকম একটা কাণ্ড করে ফেললে আমার জীবনের উপর কী প্রভাব পড়বে ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। বর্ণালী ভাবতে পারে আমার সঙ্গে দীপুর পরকীয়া-টরকীয়া চলত। নইলে ওর মৃত্যুতে আমার এত বুক টাটাবে কেন? বর্ণালীকে না হয় হাতে-পায়ে ধরে বুঝিয়ে ফেললাম, কিন্তু ওর বাবা-মাকে কী করে বোঝাব? আমার সঙ্গে দীপুর সম্পর্ক কেমন ছিল সেটা বর্ণালী নিজের চোখে দেখেছে। আমাদের যা কথাবার্তা হত সেগুলোও অনেকসময় বলতাম, ফলে ও হয়ত বিশ্বাস করলেও করতে পারে। কিন্তু আমার শ্বশুর, শাশুড়ি দীপুর নামও শোনেননি কোনোদিন। এখন হঠাৎ জীবনে দ্বিতীয় নারী! পাড়া প্রতিবেশীও যা নয় তাই বলবে। তারা ছোটবেলা থেকে দীপুকে আমাদের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতে দেখেছে। পাড়ার কাকিমারা অনেকেই মাকে বলত ‘আপনার তো বউমা ঠিক হয়েই আছে।’ যদ্দিন না বর্ণালীর যাতায়াত শুরু হয়েছে, মা তাদের কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারেনি যে দীপু আমার প্রেমিকা নয়। এখন এসব মামলা মোকদ্দমার কথা তাদের কানে পৌঁছলে সবাই বলবে ‘আমরা কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি? তখনই বুঝেছিলাম…’। আমাদের রঘুনাথপুরে যতই কেএফসি, ডমিনোজ, হাবিবসের চুল কাটার দোকান আর সারি সারি ফ্ল্যাট গজাক, লোকের কেচ্ছার প্রতি টান এখনো গাঁয়ের মতই রয়ে গেছে। বর্ণালীর আবার কোভিডের পর থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম হয়ে গেছে। সারাদিন বাড়িতে থাকবে, পাঁচজনের পাঁচটা কথা কানে আসবে। শেষে ওরও যদি বিশ্বাস হয়ে যায়! যে আর নেই তার জন্যে গায়ে পড়ে এত ঝামেলা সহ্য করার মানে হয় না। তার উপর মিডিয়া আছে। একবার যদি কোনো রিপোর্টারের কানে যায় – একজন বালবাচ্চাওয়ালা লোক অন্য লোকের বউ গলায় দড়ি দেওয়ার সাত-দশদিন পরে কোর্টে কেস করেছে তার শ্বশুরবাড়ির লোকের বিরুদ্ধে, তাহলেই হয়েছে। সাতের পাতা থেকে সোজা একের পাতায় এনে ফেলবে, আর চ্যানেলগুলো আমার মত ছাপোষা লোককে দুদিনেই বিখ্যাত করে দেবে। তারপর কোন স্টুডেন্টের বাপ অন্য গার্ডিয়ানদের জড়ো করে প্রিন্সিপালকে গিয়ে বলবে ‘অ্যায়সা টিচার বচ্চোঁ কো কেয়া সিখায়েঙ্গে?’ ব্যাস! আমার চাকরিটি নট হয়ে যাবে।

অতএব কাগজে মোড়া ন্যাপকিনটা ডাস্টবিনে ফেলে ঢাকনা বন্ধ করেই দীপুকে ভুলে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেই স্কুলজীবন থেকে যাকে চিনি, তাকে এত সহজে ভোলা যায় কী করে? সত্যিই যদি ওর প্রেমিক হতাম, তাহলে বোধহয় সমস্যা কম হত। যেমন গত একবছর ধরে ও প্রায়ই বলত ‘দ্যাখ, আমি যার জন্যে সব ছাড়তে চেয়েছিলাম সে তো দিব্যি আছে। আমার জীবনটাই কেমন হয়ে গেল। আমারই দোষ। আমিই বোকা।’

একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেললাম ‘কী করে জানলি দিব্যি আছে? সেও হয়ত…’

‘ধুর। আমাদের কমন ফ্রেন্ড আছে না? আমি খবর রাখি।’

‘কী খবর তার?’

‘সে এখন প্রোমোশন পেতে পেতে অনেক উপরে উঠে গেছে। প্রফেসর বউ, আমার মত বাংলা মিডিয়াম স্কুলের দিদিমণি নয়। মেয়ে সাউথ পয়েন্টে পড়ে। ক্লাস নাইন। ক্লাসে স্ট্যান্ড করে। ছুটিতে ইউরোপ বেড়াতে যায় সবাই মিলে।’

‘ওব্বাবা! তুই তো একেবারে ডিটেলসে খবর নিয়েছিস দেখছি!’

‘আলাদা করে নিতে লাগে না। কলেজের হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সবাই আলোচনা করে। কিছু জিজ্ঞেস না করলেও জানা যায়।’

‘সেই গ্রুপে ও নিজে নেই?’

‘আরে ও তো আমাদের থেকে সিনিয়র। তোর মনে নেই? আমাদের ক্লাসের অনেক মেয়েরই ওর উপর টান ছিল। তারাই আলোচনা করে দেখি।’

‘গ্রুপে তুই আছিস জেনেও আলোচনা করে! এ ভারি অন্যায়।’

‘অন্যায়ের কী আছে? আমার সেন্টিমেন্ট নিয়ে আমার বাবা-মাই কোনোদিন ভাবেনি, এরা ভাববে?’

‘তুই এইসব ইনসেন্সিটিভ লোকেদের গ্রুপে থাকিস কেন? বেরিয়ে যা।’

‘কিছু একটা নিয়ে তো থাকতে হবে ভাই। আমার জীবনের ভাল সময়টার সঙ্গে ওইটুকু সম্পর্কই তো টিকে আছে। ছেলেটাকে আনলাম, ভাবলাম আর সব ভুলে ওকে নিয়েই থাকব। সেও আমার পর হয়ে গেল।’

‘ওর যেন কোন ক্লাস?’

‘থ্রি। ওর দ্বারা লেখাপড়া হবে না। ওর দাদু, ঠাকুমা, বাবার অতিরিক্ত আদরেই হবে না।’

এইসব অকিঞ্চিৎকর কথাই হত আমাদের। মানে আমার হাতে সময় থাকলে। ব্যস্ত থাকলে ফোন ধরতাম না, ব্যস্ত না থাকলেও ধরতাম না অনেকসময়। ঘুরে ফিরে সেই এক কথা কাঁহাতক ভাল লাগে। হোয়াটস্যাপ করলেও উত্তর দিতাম মেজাজ মর্জি মত। কখনো কখনো উত্তর না পেলেও ও একতরফাই লম্বা লম্বা মেসেজ পাঠাত। আমি হয়ত দু লাইনের উত্তর দিতাম তিনদিন পরে। নিশ্চয়ই দীপুর খুব রাগ হত, কিন্তু পরে কথা হলে ও নিয়ে কিছু বলত না। আসলে বোধহয় ধরেই নিয়েছিল কারোর উপরে রাগ করার কোনো অধিকার ওর নেই। আমার ওর এই ব্যাপারটাই খুব বিরক্তিকর লাগত। এই নিজেকে নিয়ে সংকুচিত হয়ে থাকা, কারোর উপর রাগ না দেখানো। এরকম করলে যে সবচেয়ে কাছের মানুষও অবহেলা করে – একথা দীপু কোনোদিন বুঝেই উঠতে পারল না। কিন্তু বর্ণালী আমার এই রাগকে পাত্তা দিত না। বলত ‘ওকে হয়ত ছোট থেকে ওরকমই শেখানো হয়েছিল। মেয়েদের তো তাই শেখানো হয়। কারোর মুখে মুখে কথা বলবে না, সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করবে…’

‘আরে বাবা শেখালেই শুনতে হবে? সকলকেই তো কতকিছু শেখানো হয় ছোটবেলায়। সবাই সব মানে? ও তো আদ্যিকালের মেয়ে নয়, আমাদের জেনারেশনের মডার্ন মেয়ে।’

‘জেনারেশন বদলালেই সব বাড়ি বদলায় না। আর ওর বাড়ির যা গল্প বলেছ তুমি…।’

কথাটা অবশ্য ঠিক। দীপুকে আমি চিনি ক্লাস সেভেন থেকে। প্রাইভেট পড়তে না গেলে আমাদের আলাপ হওয়ার কথা নয়, কারণ ও পড়ত গার্লস স্কুলে আর আমি বয়েজ স্কুলে। ইতিহাসের স্যারের নোট ডিকটেশন নিতে হত। আমি লিখতাম কচ্ছপের মত, দীপু লিখত খরগোশের মত। সেই ফাঁক ভরাট করতে দীপুর বাড়িতে যেতাম আমরা দু-একজন। প্রথম যেদিন যাব বললাম, দীপুকে দেখে মনে হয়েছিল হাত-পা পেটের ভিতর সেঁধিয়ে গেছে। আমাদের বন্ধু সুস্মিতা বলেছিল ‘বাড়ি গেলে তোর কোনো অসুবিধা আছে? তাহলে খাতাটা দে…।’

‘না না, অসুবিধা থাকবে কেন? তুই তো যেতেই পারিস…।’

‘ও, ছেলেরা গেলে তোর বাড়িতে বকবে?’ আমি খুব স্মার্টনেস দেখিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। বোধহয় সেই অভিযোগ অসত্য প্রমাণ করতেই আমাদের তৎক্ষণাৎ নিয়ে গিয়েছিল।

সেদিন ওদের বাড়িতে সত্যনারায়ণ পুজো। আমরা যখন টিউশন থেকে গেলাম, তখন পাড়া প্রতিবেশীরা সিন্নি নিয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। দীপু জ্যাঠামশাই বলে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল, তাঁর বেশভূষা দেখে বোঝা গেল সদ্য পুজো সেরে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়েছেন। সুস্মিতা বারান্দায় পা দিয়েই ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দিল, দেখাদেখি আমাকে আর সুকান্তকেও করতে হল। ভদ্রলোক প্রণাম পেয়ে সুস্মিতার মাথায় এমন প্রসন্ন হাসি নিয়ে হাত বোলালেন যে মনে হল উনি পাহাড়ি সান্যাল জাতের। কিন্তু আমি আর সুকান্ত প্রণাম করে উঠে মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি – ও মা! এ তো সাক্ষাৎ কমল মিত্র! কথাবার্তাও সেরকমই। সুস্মিতাকে ছেড়ে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন ‘কী মনে করে?’ কৈফিয়ত দেওয়া হল। নিশ্চয়ই আরও লম্বা প্রশ্নমালা তৈরি ছিল, কিন্তু দীপুর মা প্রবল উৎসাহ নিয়ে এসে পড়ে বললেন ‘লেখাপড়া পরে হবে। আগে একটু প্রসাদ খেয়ে নাও।’ বারান্দাতেই আসন পেতে আমরা বসে পড়লাম। ফল প্রসাদ আর সিন্নি মহানন্দে খেলাম বলাই যেত, যদি না দীপুর জেঠু তখন পুলিসি জেরা চালু রাখতেন। প্রথমে আমার পালা। তবে কমের উপর দিয়েই গেল, কারণ গোড়াতেই বেরিয়ে পড়ল যে আমার বাবাকে উনি চেনেন। সিন্নিটা হয়েছিল চমৎকার, কিন্তু উনি বাকি দুজনকে এমন একটা প্রশ্ন করে বসলেন যে স্বাদ নষ্ট হয়ে গেল।

‘ওরটা তো আমি জানি, তোমরা দুজন কী জাত?’

সুস্মিতার দেখলাম উচ্চবাচ্য নেই। দিব্যি সিন্নি চাটতে চাটতে বলে দিল ‘ব্রাহ্মণ। কাশ্যপ গোত্র।’ সুকান্তর মুখ দেখে ভয়ই করছিল – খিস্তি না করে দেয়। খুব গম্ভীরভাবে বলল ‘আমরা উগ্র ক্ষত্রিয়।’ জেঠু পদবিটা জিজ্ঞেস করলেন, তারপর ভারি ভালমানুষের মত মুখ করে হাত উল্টে বললেন ‘কী জানি বাপু। এসব পদবি তো শুনিনি কখনো। তাই বলতে পারব না।’ বলে বিদায় হলেন, আমরা বাঁচলাম। সুকান্ত সেদিনই আমাকে বলেছিল ‘অতি বাজে মেন্টালিটির লোক। নিজেরা ব্রাহ্মণ ঠিক আছে। তা বলে লোককে এইভাবে জাত জিজ্ঞেস করে কেউ?’ তারপর থেকে নিরুপায় না হলে সুকান্ত দীপুদের বাড়িতে যেত না। আমারই নিয়মিত যাতায়াত ছিল। আমি বামুন আর আমার বাবা জেঠুর পরিচিত বলেই বোধহয় মাঝেমধ্যে ঘরে ঢোকার লাইসেন্সও পেয়ে যেতাম। সেটা অবশ্য দোতলায় দীপুর নিজের ঘর নয়, একতলায় ওর বাবা-মা কিংবা জেঠু-জেঠিমার ঘর। চৌকিদারি খুব জোরদার ছিল। ইয়ার্কি ঠাট্টা করার বিশেষ সুযোগ পাওয়া যেত না, গোপন কথাবার্তা বলার তো নয়ই। দীপুর বাবা, মা, পিসি, জেঠু, জেঠিমা পালা করে রাউন্ড দিয়ে যেতেন। আমি স্বভাবের দোষে মাঝে মাঝে ইয়ার্কি মেরে ফেলতাম, দীপু ভয়ে ভয়ে নিঃশব্দে হাসত, কিন্তু আমি একদম হাসি চাপতে পারি না। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই জেঠু এসে বলতেন ‘পড়াশোনা কিছু হচ্ছে, নাকি শুধু আড্ডাই হচ্ছে?’ অবধারিত। একবারও অন্যথা হয়নি।

এত বাধার মধ্যে দীপুর সঙ্গে আমার অন্তরঙ্গতা কখন, কীভাবে তৈরি হল – ভাবলে এখন অবাক লাগে। ও বরাবরই চাপা স্বভাবের মেয়ে। ও যে খুব কষ্টে আছে, বাড়ির ওই পরিবেশে যে দম আটকে আসে – এসব কিন্তু তখন কোনোদিন বলেনি। গত দুবছরে বলেছে। কিন্তু আমি সেই প্রথমবার প্রেমে পড়ার সময় থেকেই ওকে হাট করে সব কথা বলতাম। ও নীরব শ্রোতা ছিল বলেই বোধহয় বলতে ভাল লাগত। কখন বলতাম? ও আমাদের বাড়িতে এলে, অথবা টিউশনি থেকে সাইকেলে ফিরতে ফিরতে। বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র আমার বাড়িতে আসারই অনুমতি পেত, কারণ ওই যে – আমার বাবাকে ওর জেঠু চিনতেন। ও কখনো সত্যিই লেখাপড়ার দরকারে আসত, কখনো মুখ দেখে বোঝা যেত মন খারাপ। আমার সঙ্গে গল্প করে হালকা হতে এসেছে। কিন্তু ওর গল্প করা মানে তো আমার বকবক শুনে যাওয়া, মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বলা। আমার সবসময় এত কথা বলার থাকত, যে ওর কিছু বলার আছে কিনা কোনোদিন জিজ্ঞেসই করিনি। আমার গলা যেহেতু অ-মাইক, ও চলে যাওয়ার পরে বাবা বলত ‘তুই-ই তো সারাক্ষণ বকবক করিস। মেয়েটাকে কথা বলতে দিস না কেন?’ আমি এমন আত্মকেন্দ্রিক যে বলতাম ‘ও তো ওরকমই। কম কথা বলে।’ দীপু কথা বলত ঠিকই, তবে বেশিরভাগটাই পরামর্শমূলক। আমার বেশ অল্প বয়স থেকেই প্রেমে পড়ার রোগ ছিল, কিন্তু প্রেম নিবেদন করার সাহস ছিল না। ও সেসব শুনত, আর পরামর্শ দিত –

‘ইশ! ওই মেয়েটাকে তোর পছন্দ হল! কী বাজে চয়েস তোর।’

‘তুই বেশি বেশি ভাবছিস। মেয়েরা একটু ভাল করে কথা বললেই তোরা ভাবিস পছন্দ করে। মানে, তোকে ও পছন্দ তো করেই। কিন্তু সেটা ওইভাবে না। তেমন হলে আমি বুঝতে পারতাম।’

‘এ রাম, আর্য! ও তো তোদের আত্মীয় হয়। কী শুরু করেছিস বল তো? এত ঘনঘন প্রেমে পড়িস কী করে?’

‘না, এই মেয়েটার মনে হচ্ছে সত্যিই তোকে পছন্দ, বুঝলি? তুই রুচিকে বল বাজিয়ে দেখতে। আমি তো এসব পারি না, নইলে তোর কোনো চিন্তাই থাকত না।’

‘শোন, এত ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। তোর তো এটা প্রথম প্রেম নয়, শেষ প্রেমও নয়। এখনো কিছুই বয়স হয়নি। জীবনে আবার প্রেম আসবে। এখন পড়াশোনা করার বয়স, মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সারাক্ষণ শুধু মেয়েদের নিয়ে চিন্তা করে যাচ্ছে। তোকে না, ধরে থাবড়ানো দরকার। কাকু, কাকিমা ভীষণ ভাল তো; তাই তুই মজা পেয়ে গেছিস। পড়তিস আমাদের বাড়ির পাল্লায়…।’

ওর বাড়ির পাল্লায় পড়লে যে কী হয় সেটা দীপু ওর নাতিদীর্ঘ জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেল। আমার সঙ্গে যোগাযোগ একটু ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল আমার হোস্টেল জীবনে। আমি হোস্টেল থেকে ওকে চিঠি লিখতাম – লম্বা লম্বা। ও উত্তরে চার কি পাঁচ লাইন। তাতে অবশ্যই থাকত একটা লাইন – ‘পার্টি করছিস, প্রেম করছিস, ঠিক আছে। পড়াশোনাটা যেন করা হয়।’ বন্ধু, না মাসিমা, বোঝা শক্ত। তবে ওই বয়সে বড়দের কথা পছন্দ হয় না। মানতেই হবে যে দীপুর দেওয়া জ্ঞান তেমন তেতো লাগত না, বরং পড়াশোনায় বাড়াবাড়ি রকমের ফাঁকি দিয়ে ফেললে বাবা-মায়ের চেয়ে ওর বকুনিই মনে পড়ত বেশি। সেটা আমার অনেক উপকার করেছে। কিন্তু ওর জন্যে আমার কোনোদিন কিছু করা হয়নি। আমার যে কিছু করার আছে তাও মনে হয়নি। এখন কাকস্য পরিবেদনা। যা-ই হোক, মোদ্দাকথা ওই চুপচাপ মেয়ের জীবনে কী ঘটছে সেটা হোস্টেলে থাকার ফলে আমার জানার সুযোগ আরও কমে গিয়েছিল। ছুটিতে বাড়ি এলে দেখা করতে যেতাম। ও বরাবর ভাল ছাত্রী, আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ও-ই প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হতে পেরেছে। তাই ওকে বেশ শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম তখন। ফার্স্ট ইয়ারের শেষদিকেই দেখলাম, ওর সাহস বেশ বেড়েছে। একদিন আমি যেতেই গলা নামিয়ে বলল ‘তোর সঙ্গে কথা আছে। চল বেরোই।’ তারপর কারোর অনুমতির তোয়াক্কা না করে চেঁচিয়ে রান্নাঘরে থাকা মাকে বলে দিল ‘আমি আর আর্য একটু বেরোচ্ছি।’ কাকিমা জিজ্ঞেস করলেন ‘কোথায়?’ দীপু কোনো উত্তর না দিয়ে সাইকেলের চাবিটা নিয়ে বারান্দা থেকে উঠোনে পা দিল।

রঘুনাথপুরে তখন সবে স্টেশনের কাছে কয়েকটা নতুন খাবারের দোকানে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসার ব্যবস্থা হয়েছে। দীপু সাইকেলে উঠেই বলল ‘চল, তোকে খাওয়াব। আমি এখন টিউশনি করছি।’ আমার প্রথমে একটু প্রেস্টিজে লেগেছিল, কারণ পকেটে পয়সা ছিল না। একটা মেয়ে আমাকে খাওয়াবে! তারপর ভাবলাম, দীপু তো আমার প্রেমিকা নয়; বন্ধু। ওর পয়সায় খেলে দোষ নেই। সেদিনই প্রথম দীপু বলল, আমি শুনলাম আর পরামর্শ দিলাম। উপায়ও ছিল না। ও তো কয়েক কামড়েই এগরোল খেয়ে নিয়েছে, আমার তো মোগলাই পরোটা খেতে সময় লাগবে।

লজ্জায় রোলে চোখ রেখে বলল ‘আমার না… একজনকে পছন্দ হয়েছে।’

‘কে কে কে?’

‘অ্যাই চুপ চুপ। চেঁচাস না। কোথায় কোন চেনা লোক শুনতে পেয়ে যাবে…।’

‘দুশো মাইলের মধ্যে কোনো চেনা লোক নেই এখানে। বল বল। নাম কী?’

‘উদ্দালক।’

‘কোথায় পেলি?’

‘আমাদের কলেজের আউটগোয়িং ব্যাচ। পলিটিকাল সাইন্স। খুব ভাল স্টুডেন্ট। ফার্স্ট ক্লাস পাবেই। আইএএস দেবে।’

‘বাঃ! তোর তো আর চিন্তা নেই তাহলে।’

‘চিন্তা নেই মানে? আমাকে চাকরি বাকরি করতে হবে না?’

‘তা বলছি না। বলছি তোর একজন জুটে গেল। কিন্তু আমার এখনো কোনো হিল্লে হল না।’

‘দাঁড়া দাঁড়া। ব্যাপারটা অত সোজা না।’

‘কেন? তার তোকে পছন্দ নয়?’

'ধ্যাৎ! নাহলে তোকে এত কথা বলতাম?’

‘তাহলে আবার কী সমস্যা? ও-ও ঘ্যামা স্টুডেন্ট, তুইও ঘ্যামা স্টুডেন্ট। লাইফে আর কী আছে?’

‘ওরা সেনগুপ্ত।’

আমি তফাতটাকে কোনো গুরুত্বই দিইনি। মোগলাইয়ের পর না চাইতেই দীপু আমাকে থামস আপও খাইয়েছিল। আমি ঢেঁকুর তুলতে তুলতে খুব সাহস দিয়েছিলাম। বলেছিলাম ‘বাড়িতে কোনো ঝামেলা করলে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করে নিবি। আমি উইটনেস থাকব। দেখি কোন শালা জেঠু আটকায়?’ সেই ছুটির পর শেষমেশ কলেজে একজনের আমাকে পছন্দ হয়ে যায়, আমি সেই নিয়ে মেতে যাই। সে আবার লেখাপড়ায় ভাল, অতএব আমাকেও লেখাপড়ায় মন দিতে হয়। তার উপর স্টুডেন্টস ইউনিয়নের নেতা হয়ে গেছি। এতকিছুর মধ্যে দীপুকে চিঠি লেখার আর সময় হত না। ছুটিতে বাড়ি এসেও কলকাতায় প্রেম করতে যেতাম। ফলে দীপুর সঙ্গে যোগাযোগ আরও ক্ষীণ হয়ে গেল। বছর দুয়েক ওকে ভুলেই গেছিলাম বললে ঠিক হয়। বাবা পর্যন্ত একদিন বলল ‘গার্লফ্রেন্ড পাইয়া তো ছোটবেলার বন্ধুরে ভুইল্যাই গ্যাছস।’ মা বলল ‘হ্যাঁ। এগুলো খুব অন্যায়। সেদিন দীপুর সঙ্গে দেখা হল। চেহারাটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। ওর তো মুখটা এমনিতেই কেমন করুণ মত, আরও করুণ দেখাচ্ছে। কী ব্যাপার কে জানে!’ বাবা-মাকে তখুনি কথা দিয়েছিলাম একদিন দীপুর বাড়ি যাব, কিন্তু সেই একদিন আর আসেনি। আমার বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট খুব সুবিধার হল না, লজ্জায় আর দীপুর রেজাল্টের খবর নিতে যাইনি। ও অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিল। মা জানাল দীপু ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। জানানোর ভঙ্গিতে আমাকে লজ্জা দেওয়ার চেষ্টা খুব পরিষ্কার ছিল। আমার গা জ্বলে গেল, ফলে দীপুর সঙ্গে যোগাযোগ করার ইচ্ছা আরও কমে গেল। কলকাতায় এমএ পড়ার মুরোদ হল না, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে হল। রোজ অনেকটা সময় রাস্তায় কাটত, প্রেমিকাটি প্রাক্তন হয়ে গিয়েছিল, লেখাপড়ায় মন দিয়েছিলাম। ফলে পার্ট ওয়ানে বেশ ভাল রেজাল্টও করেছিলাম। তখন দীপুর কথা মনেই নেই। মনে পড়ল যেদিন ওর মা ফোন করে বললেন ‘আর্য, তুমি একবার আসতে পারবে? দীপুর শরীরটা খুব খারাপ। তোমাকে খুব দরকার। ওর তো আর সেরকম বন্ধু কেউ নেই…।’

শরীর খারাপে ডাক্তার না ডেকে বন্ধুকে ডাকছেন শুনেই বুঝলাম ব্যাপারটা গুরুতর। কাকিমা আবার হিসাব করে এমন একদিন যেতে বললেন যেদিন দীপু বাড়ি থাকবে না। দীপু গিয়েছিল ওর বাবা আর জেঠুর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে। তবু কাকিমা গলা একেবারে খাদে নামিয়ে আমার সঙ্গে কথা বললেন, বলতে বলতে বারবার দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখে এলেন কেউ ধারেকাছে আছে কিনা। দীপুর জেঠিমা আর অবিবাহিত পিসিকে যে বিশ্বাস করা যায় না তা বুঝতে পারলাম।

দীপুর অসুখটা আসলে মনের। এতটাই গেড়ে বসেছে যে পরীক্ষায় বসতে পারেনি। কিন্তু অসুখটা কী? কাকিমা বেশিদূর লেখাপড়া করেননি, ওঁকে দীপুর বাবা আর জ্যাঠা সব কথা বলার প্রয়োজনও বোধ করেন না। তাই উনি কেবল রোগের লক্ষণগুলো বলতে পারলেন – বিছানা ছেড়ে উঠতে না চাওয়া, ঘন্টার পর ঘন্টা এক জায়গায় ঠায় বসে থাকা, কারোর সঙ্গে কথা না বলা, খেতে না চাওয়া, হঠাৎ অকারণে কেঁদে ফেলা। এই হাসিখুশি ছিল, আবার এই নিঝুম হয়ে গেল। মাঝে মাঝে অঝোরে কাঁদা – এইসব আর কি। কিন্তু কেন হল এরকম? কবে হল?

‘গতবছর থেকেই একটু একটু করে হচ্ছিল, বুঝলে? মাস তিনেক হল খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে। তারপর থেকেই তোমার কাকু ডাক্তার দেখাচ্ছে। প্রথমে তো ভেবেছিলাম শরীরেই কিছু হয়েছে। তাই বিশু ডাক্তারবাবুই দেখছিলেন। তারপর উনিই বললেন, এটা মনের রোগ। মনের ডাক্তার দেখাতে হবে। শুনে দীপুর জেঠু তো রেগে আগুন। বলে মনের রোগ আবার কী? এত বড় বংশের মেয়ে কি পাগল ছাগল? তা যা-ই হোক, বিশুবাবু তো ওনার থেকেও বয়সে বড়। তাই ওনার কথা না শুনে উপায় নেই। উনিই বকেঝকে ওনার চেনা কোন বড় ডাক্তারের কাছে পাঠিয়েছেন কলকাতায়।’

‘কোনো বড় আঘাত-টাঘাত পেয়েছিল? এমনি এমনি তো এরকম…।’

কাকিমা আমার হাত দুটো ধরে কেঁদে ফেললেন। ‘তুমি আমার পেটের ছেলের মত বলে তোমায় বলছি বাবা, কেউ যেন জানতে না পারে…।’

কাকে আর বলতে যাব এসব কথা।

‘দীপুর একটা ছেলের সাথে প্রেম হয়েছিল। ভাল ছেলে। বিএ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস, এমএ পরীক্ষায় ফার্স্ট ক্লাস। কী একটা বড় পরীক্ষায় নাকি একবারে প্রথম ধাপ পেরিয়ে গেছে। দোষের মধ্যে বামুন নয়, বদ্যি।’

‘উদ্দালক সেনগুপ্ত?’

‘ও, তুমি জানতে!’

‘নামটুকুই। দীপুই বলেছিল আমাকে বছর দুয়েক আগে। তারপর তো আর কথাবার্তা হয়নি…।’

‘হ্যাঁ সেই ছেলেটাই। সে একদিন এসেছিল এই বাড়িতে। মানে এখনই বিয়ে করবে বলে নয়, বাড়িতে জানিয়ে যেতে আর কি। দীপুর জেঠু তো এমএ পরীক্ষা হয়ে গেলেই ওর বিয়ে দেবেন ঠিক করছিলেন, সেই শুনেই হবে। তা উনি তো কিছুতেই রাজি হলেন না। তারপর থেকেই মেয়েটা…।’

‘রাজি হলেন না মানে? উনি রাজি হওয়ার কে? বিয়ে তো করবে দীপু। বড়জোর আপনার আর কাকুর একটা মত থাকতে পারে। জেঠু কে?’

কাকিমা জিভ-টিভ কেটে আমার মুখ চেপে ধরলেন প্রায়। ‘আস্তে বলো, আস্তে! এ বাড়িতে বড়কত্তার কথা ছাড়া গাছের একটা পাতা পর্যন্ত নড়ে না। আমাকেও তো উনিই পছন্দ করে এনেছিলেন।'

‘কী মুশকিল! আপনার তো বিয়ে হয়েছে আজ থেকে তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে। যুগ তো পাল্টে গেছে। এখনো মেয়ে কাকে বিয়ে করবে সেটা তার বাড়ির লোক ঠিক করবে নাকি? আপনারা আশপাশের খবর রাখেন না? আমার জ্যাঠতুতো দিদি তো আজ থেকে দশ বছর আগেই লাভ ম্যারেজ করেছে। আপনাদের আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কেউ প্রেম করে বিয়ে করেনি?’

‘করেছে তো। তোমার কাকুর খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরাই তো করেছে। কিন্তু এই ছেলেটার তো জাত আলাদা, না? কী করে রাজি হওয়া যায়, বলো?’

আমার মাথাটা অনেকক্ষণ থেকে গরম হচ্ছিল, এরপর আর সামলাতে পারলাম না।

‘তাহলে তো ঠিকই আছে। আপনাদের কাছে মেয়ের সুখের থেকে জাতপাত বেশি জরুরি, তাই ওর মনে দাগা দিয়েছেন। এখন ফল ভোগ করুন। এতে আমার কী করার আছে?’ বলে উঠে পড়েছিলাম। কাকিমা হাত ধরে আটকে দিলেন।

‘তুমি একটু আমার কথাটা শুনে যাও, বাবা। আমার কিন্তু মত ছিল। একটু কেমন লাগে ঠিকই, কিন্তু আজকাল তো এরকম হয়ই। আমি দীপুর বাবাকে অনেক করে বলেছিলাম। কিন্তু বাড়ির ছেলেরা রাজি না হলে কি হয়, বলো? মেয়েমানুষের কথা তো কেউ শোনে না। তাছাড়া আমি আর মেয়েটা একলা পড়ে গেলাম। আমার জা আর ননদ পর্যন্ত… ছেলেটাকে দল বেঁধে সবাই মিলে অপমান করল, জানো? কটা মিষ্টি খেতে দিয়েছিলাম। ছেলেটা ছুঁয়ে দেখল না পর্যন্ত। উঠে চলে গেল।’

‘ব্যাস! এতেই হয়ে গেল? দীপু পালিয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রি করল না কেন? আমি তো ওকে প্রথম শুনেই বলেছিলাম দরকার হলে তাই করতে। বলেছিলাম আমাকে পাশে পাবি। এইটুকু করতে পারল না? কীরকম প্রেম তাহলে?’

‘কার সঙ্গে পালাবে, বাবা? সেই ছেলে সেই যে হনহন করে হেঁটে চলে গেল, ফিরে তো আর একটা ফোনও করেনি দীপুকে।’

এবার কার উপর রাগ করব বুঝতে না পেরে আবার বসে পড়লাম। কাকিমা তখন আমাকে যে জন্যে ডেকেছেন সেটা বললেন। ডাক্তারের কাছে দিন দশেক অন্তর একবার করে যেতে হয়। কাকিমা প্রতিবারই সঙ্গে যেতে চান, কিন্তু দীপুর জেঠু কিছুতেই যেতে দেন না। একবার ডাক্তারই ডেকে পাঠিয়েছিলেন বলে যাওয়া হয়েছিল। তখন ডাক্তার কাকিমাকে বলেছেন দীপুর বন্ধুদের সাহায্য নিতে। বন্ধুরা যেন এসে ওর সঙ্গে গল্পগুজব করে, তাহলে ওর মন হালকা হবে। প্রথম প্রথম হয়ত কোনো প্রতিক্রিয়া হবে না। কিন্তু ধৈর্য ধরতে হবে, ধীরে ধীরে ফল ফলবে। ওকে পাঁচজনের সঙ্গে মেলামেশা করাতে না পারলে কেবল কাউন্সেলিং আর ওষুধ দিয়ে লাভ হবে না। দীপুর বন্ধুর সংখ্যা এমনিতেই কম, যা-ও বা আছে তারা প্রেসিডেন্সির বন্ধু। তাদের কাকিমা রঘুনাথপুরে পাবেন কোথায়? তাই আমার আর সুস্মিতার শরণাপন্ন হয়েছেন।

কাজটা আমরা মন দিয়েই করেছিলাম। প্রায় একবছর প্রত্যেক রবিবার বিকেলে আমি আর সুস্মিতা চলে যেতাম দীপুদের বাড়ি। আমরা বারান্দার বেঞ্চে গিয়ে বসলে কাকিমা দীপুকে পাত্রপক্ষের সামনে পাত্রীকে যেভাবে এনে বসানো হয়, সেভাবে বসিয়ে দিয়ে যেতেন। কোনো পাহারা থাকত না। কিন্তু তাতে লাভ কী? আমরা দুজনেই বকে মরতাম, দীপু পাথরের মূর্তির মত বসে থাকত। ওকে হাসানোর চেষ্টা করতে গিয়ে কখনো কখনো আমাদের চোখে জল এসে যেত, ও কিন্তু নীরব। অনেক কষ্টে হয়ত একটা কি দুটো কথা বলত। মাঝে মাঝে সন্দেহ হত – আমাদের আদৌ চিনতে পারছে কিনা। একটা সময়ের পর সুস্মিতা চাকরি নিয়ে ব্যাঙ্গালোর চলে গেল, আমিও ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বলে কয়ে যাওয়া বন্ধ করিনি, বন্ধ করার ইচ্ছাও ছিল না। তবে ভিতরে ভিতরে হয়ত হতাশ হয়ে পড়ছিলাম দীপুর কোনো উন্নতি না দেখে। আমার বাবা-মাও আর দীপুর কথা মনে করায়নি। আসলে তখন আমার বাবার রিটায়ারমেন্ট সামনে। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে বলে বাবা এক দিক থেকে নিশ্চিন্ত, কিন্তু চাইছিল নিজের চাকরি থাকতে থাকতে আমি একটা চাকরি পেয়ে যাই। বাবা খোলামেলা লোক, আমাকে পরিষ্কার বলেছিল ‘বড্ড বেশি বয়সে তোকে জন্ম দিয়ে ফেলেছি রে। তুই নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছিস এটা যতক্ষণ না দেখতে পারছি, নিজেকে কেমন অপরাধী লাগে।’ তা বাবা অবসর নেওয়ার আগে না হলেও, তার বছরখানেকের মধ্যেই আমি এই প্রাইভেট স্কুলের চাকরিটা পেয়ে গেলাম। ইচ্ছা ছিল চাকরিটা না নিয়ে সরকারি চাকরির পরীক্ষাগুলো দেব পরপর। কিন্তু বাবা বলল ‘হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতে নেই।’ এখন মনে হয় বাবার কথা শুনে ভুল করিনি। তা এইসব করতে গিয়ে দীপু আবার আমার জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। চাকরি পাওয়ার বেশ কিছুদিন পরে এক সন্ধেবেলা স্কুল থেকে ফিরে দেখি, বাইরের ঘরে বাবার সঙ্গে বসে গল্প করছে দীপুর জেঠু। আমাকে দেখে অত চওড়া হাসি আগে কোনোদিন হাসেনি। বাবা আমার দিকে একটা কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল ‘তোর বন্ধুর বিয়ে।’

সুস্মিতা ফোন করে বলল ‘আমি ছুটিতে বাড়ি এসছি। দীপমালার বিয়েতে যাচ্ছিস?’ তা একসাথেই গেলাম দুজনে। আমার সেদিন ফিরতে একটু দেরি হয়েছিল, তাই যখন গিয়ে পৌঁছলাম তখন দীপু বিয়ে করতে বসে গেছে। আমাদের দেখে হাত নাড়ল, ওর বরকে কানে কানে আমাদের কথা বলল, সে-ও হাত নাড়ল। সুস্মিতা বলল ‘বেশ মানিয়েছে কিন্তু।’ একদম বাজে কথা। মোটেই মানায়নি। দীপু সুন্দরী নয়, কিন্তু কুৎসিতও নয়। অন্তত দুবার দেখা না হলে মনে থাকবে না – এরকম চেহারা। কিন্তু চেহারার মধ্যে যে বুদ্ধির দীপ্তি আছে সেটা বুদ্ধিমান লোকের চোখে কয়েক সেকেন্ডেই ধরা পড়ে যাবে। তার পাশে যে কুমড়োপটাশকে দেখলাম, তাকে দেখলেই মনে হয় মাথায় মারলে ঠং করে আওয়াজ হবে। মোটা অনেকেই হয়, কিন্তু দেখলেই সকলকে মাথামোটা মনে হয় না। তবে এসব কথা বিয়েবাড়িতে দাঁড়িয়ে বলতে নেই। তাছাড়া সুস্মিতার সঙ্গে আমার অত অন্তরঙ্গতাও নেই। তাই সায় দিলাম। দীপুর জ্যাঠামশাই দেখলাম জব্বর ধুতি পাঞ্জাবি পরে বেশ রেলা নিয়ে অতিথি আপ্যায়ন করে বেড়াচ্ছেন। নেমন্তন্ন করতে গিয়ে আমাদের বাড়িতে বলছিলেন ‘তোমরা তো জানো সবই। মেয়েটাকে নিয়ে কয়েকটা দিন যা গেছে… পাত্রস্থ করতে পারব কিনা খুব চিন্তা ছিল। আজকাল উপযুক্ত পাত্র কি সহজে পাওয়া যায়?’ বাবা জিজ্ঞেস করল ‘ছেলে কী করে?’ বত্রিশ পাটি বার করে বললেন ‘এলআইসির ফিল্ড অফিসার হয়ে গেছে এই বয়সেই। চাট্টিখানি কথা, বলো?’ আমার বাবা যে কীরকম ফিচেল, সে তো আমি জানি। ভাবছিলাম এরপর একটা বিশ্রী খোঁচা-টোচা দেবে। ঠিক তাই। জিজ্ঞেস করল ‘দীপু শেষ অব্দি এমএ পরীক্ষাটা পাস করেছিল তো?’ জ্যাঠামশাই একেবারে আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললেন ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। চার নম্বরের জন্যে ফার্স্ট ক্লাস মিস করল। এসএসসি পরীক্ষাতেও তো একবারে পাস।’ বাবা ফস করে বলে দিল ‘হ্যাঁ সেরকমই শুনেছিলাম। সোনার টুকরো মেয়ে। চাইলে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইএএস, আইপিএস, যেমন খুশি বর পেত।’ জ্যাঠার অমনি মনে পড়ে গেল যে আরও অনেকগুলো বাড়িতে যেতে হবে, তাই কেটে পড়লেন। কিন্তু বিয়েবাড়িতে দেখলাম আর্কিমিডিসের মত মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।

দীপুকে কনের সাজে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল, যেমন শতকরা একশোটা বাঙালি হিন্দু মেয়েকে দেখায়। তার চেয়েও বড় কথা, ওকে অতদিন পরে দেখে মনে হল বিয়েটা খুশিমনেই করছে। আমি তাই হৃষ্টচিত্তে মটন বিরিয়ানি আর চিকেন চাঁপ সাঁটালাম। ভাপা সন্দেশটার স্বাদ অভূতপূর্ব ছিল। আয়োজন এত নিখুঁত যে মিষ্টি পানটা পর্যন্ত এখনো মুখে লেগে আছে। হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে ঢেঁকুর তুলছিলাম আর ভাবছিলাম – যাক, মেয়েটা ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। ওই সম্পর্কটার কথা প্রথম দিকে কয়েক বছর নিশ্চয়ই মনে থাকবে, কিন্তু ধীরে ধীরে দাগ মিলিয়ে যাবে। বরকে ভালবেসে ফেলবে, ছেলেপুলে হবে, তার উপর চাকরির ব্যস্ততা আছে। জীবনে স্বপ্নের সঙ্গে দুঃস্বপ্ন তো থাকেই। উদ্দালক সেনগুপ্তকে আর কয়েক বছর পরেই একটা দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু মনে হবে না দীপুর।

ভেবেছিলাম এরপর আর ওর সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে না। বিয়ের আগেই তেমন যোগাযোগ ছিল না, পরে আর নতুন করে কি হবে? কিন্তু ও নিজেই, কেন কে জানে, আমার মোবাইল নম্বর জোগাড় করে যোগাযোগটা বজায় রাখল। প্রথম কয়েক বছর তো কথাবার্তা শুনে মনে হত সুখী গৃহকোণ পেয়েছে।

‘তোর বরটা কেমন রে? সত্যি কথা বলবি।’

‘ভাল। খুব ভদ্রলোক।’

‘শাশুড়ি?'

‘খুব ভাল। উনি তো পুজোআচ্চা নিয়েই থাকেন, বাড়িতে মন্দির আছে তো। ওনাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই।’

‘আর শ্বশুর?’

‘মাটির মানুষ।’

‘বাঃ! তাহলে বেশ ভাল আছিস, বল?’

‘একটাই অসুবিধা রে। আমার স্কুলটা এত দূরে… সারা সপ্তাহ ওখানে থাকতে হয়, শনিবারে আসি আবার সোমবার চলে যেতে হয়।’

‘তা তোর স্কুল যেখানে তার আশেপাশে সম্বন্ধ দেখলেই তো হত। লন্ডনে স্কুল আর টোকিওতে শ্বশুরবাড়ির বুদ্ধিটা কার? নির্ঘাত তোর জেঠুর?’

‘যাঃ! ওরকম করে বলিস না। জেঠু কি আমার খারাপ চেয়ে বিয়ে ঠিক করেছে? ওরকম রাজযোটক কি পাওয়া যায় সবসময়?’

‘সে যা-ই হোক। তুই আবার বরের বিরহে পাগল হয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে আসিস না।’

‘ভ্যাট। আমি অত ওরকম না।’

‘আর তোর বর?’

‘ও মাঝে মাঝে বলে… ট্রান্সফারের চেষ্টা করতে। দেখি, কয়েকটা বছর না গেলে তো ট্রান্সফার চাওয়া যাবে না।’

‘তাহলে তোর বরেরই টান বেশি?’

‘হুম।’

দীপু যা লাজুক, তাতে ওই ‘হুম’ থেকেই আমি ধরে নিয়েছিলাম বর ওর জন্যে একেবারে আছাড়ি পিছাড়ি। বিয়ের পর প্রায় দশ বছর ফোনে আর হোয়াটস্যাপে আমাকে এই মিথ্যে সুখের গপ্প শুনিয়ে গেছে দীপু। আমি খেয়ালই করিনি যে আমার বিয়েতে, আমার বাবার শ্রাদ্ধে ও একা এসেছিল। দুবারই বলেছিল ফিল্ড অফিসারবাবুর ‘বছরের এই সময়টায় খুব চাপ থাকে’। অথচ আমি বিয়ে করেছিলাম জানুয়ারি মাসে, আর বাবা মারা গেল এক অগাস্টে। তারপর কবে যেন হঠাৎ গলগল করে দীপু সব বলে ফেলল। ততদিনে ট্রান্সফার নিয়ে শ্বশুরবাড়ির কাছের স্কুলে এসে পড়েছে। বিয়ের আট-ন বছর হয়ে গেছে, অথচ বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। তাই উঠতে বসতে শ্বশুর-শাশুড়ির গঞ্জনা শুনতে হচ্ছে। গোড়ার দিকে বলত স্বামীটা গোবেচারা, তাই প্রতিবাদ করতে পারে না। ক্রমশ ওর কথা থেকেই বুঝলাম, গো শিং দিয়ে যথেষ্ট ঢুঁ মারে। মোটেই বেচারা নয়। মাঝে কিছুদিন মেয়েটা খুব খুশিয়াল হয়ে উঠেছিল, কারণ শ্বশুরবাড়ির সবাই দত্তক নিতে রাজি হয়েছে। একটা ফুটফুটে ছেলেকে দত্তক নেওয়ার পর থেকে ফোনে কথা বলতে গিয়ে দেখতাম দীপুর গলার স্বরই বদলে গেছে। একদিন তো বলল ‘আমার জীবনটার আবার একটা মানে খুঁজে পেয়েছি, বুঝলি?’ কিন্তু সে আনন্দও যে বেশিদিন টেকেনি তা তো আগেই বলেছি।

আমার ধারণা দীপু জীবনে খুব বেশিবার হাউহাউ করে কাঁদেনি। ওকে কান্না চেপে রাখতে শেখানো হয়েছিল, সেই শিক্ষাই ও আজীবন পালন করে গেছে। যদি গলা ছেড়ে কাঁদার অভ্যাস থাকত, যদি ৬৫ ডেসিবেলের উপর গলা তুলে ঝগড়া করতে পারত, তাহলে ওকে মরে বাঁচতে হত না। যখন আমাকে মন খুলে সব বলতে শুরু করেছে, তখন একদিন বলেছিলাম ‘ডিভোর্সের কথা ভাবছিস না কেন? তুই তো চাকরি করিস। তোদের বাড়িটাও তো সবাই মারা যাওয়ার পর খালিই পড়ে আছে। মানে নিজের রোজগার আছে, মাথা গোঁজার ঠাঁইও আছে।’

‘ভাবি না যে তা নয়। কিন্তু ছেলেটার কী হবে বল তো?’

‘ছেলেকে তোর সঙ্গে নিয়ে যাবি। উকিলকে বলবি সেইভাবেই মামলা করতে।’

‘ওরে বাবা! আমি এতসব পারব না রে আর্য। তাছাড়া ছেলেটার মনের উপর কী চাপ পড়বে ভাব তো?’

‘আর তোর মনের উপর যে চাপটা পড়ছে তার কী হবে?’

‘আমার আর কী? আমার তো আদ্ধেক জীবন কেটেই গেল। এখন তো ওর জন্যেই বাঁচা।’

‘তা বলে একটা রাস্কেল আর তার বাপ-মা তোর সঙ্গে এই ব্যবহারটা চালিয়ে যাবে আর তুই একটা শিক্ষিত, স্বাধীন মেয়ে হয়ে মেনে নিবি?’

'মেনে না নিয়ে কী করব বল? চিরকাল তো মেনেই নিয়েছি। মেনে নিতে নিতেই তো এই অবস্থা হল। জেঠু শুধু কাস্ট মিলল না বলে আমার জীবনটা শেষ করে দিল। আমি কি কিছু করতে পেরেছি তখন? আমার বাবা-মা পর্যন্ত কিছু করল না। অবশ্য একদিকে হয়ত ভালই হয়েছে। যে ছেলে আমাকে আর ফোন পর্যন্ত করল না, দিব্যি নিজের জীবন তৈরি করে নিয়ে সুখে আছে তার সাথে বিয়ে হলে কি ভাল হত? কে জানে…।’

‘হ্যাঁ। ওই আরেক শুয়োরের বাচ্চা।’

‘না রে। আসলে আমারই কপাল খারাপ। আমাকে কেন বিয়ে করবে বল? আমি সুন্দরী নই, সামান্য স্কুলমাস্টারি করি। আইএএস অফিসারের এরকম বউ হলে চলে?’

এইসব কথার কয়েকদিন পরেই হঠাৎ আমার স্কুলের টিফিনের সময়ে মেসেজ -

‘একটা সত্যি কথা বলবি?’

‘কবে আবার তোকে মিথ্যে কথা বললাম?’

‘আমাকে কি খুব খারাপ দেখতে?’

‘আদৌ খারাপ দেখতে নয়।’

‘তেল দিচ্ছিস না তো?’

‘তোকে তেল দিয়ে আমার লাভ?’

তারপর চুপচাপ। আমি আলোচনাটা ভুলে গিয়েছিলাম, হঠাৎ দিন তিনেক পরে আবার -

‘আর্য, আমার জীবনটা তো মরুভূমির মত, বল?’

‘সে তো বটেই। ’

‘এই ভদ্রলোককে তুই চিনিস?’

(স্বদেশ ভট্টাচার্য বলে একজনের ফেসবুক প্রোফাইলের স্ক্রিনশট)

‘না। কে রে?’

‘সময় করে প্রোফাইলটা দেখিস।’

প্রোফাইল ঘেঁটে যা বুঝলাম, স্বদেশবাবু উত্তরবঙ্গের এক স্কুলের বাংলার মাস্টার। মানে দীপুর বিষয়েরই লোক। তবে দীপুর মুগ্ধতার কারণ বোধহয় সেটা নয়। ভদ্রলোকের, যাকে বলে, রমণীমোহন চেহারা। তার উপর কবিতা লেখেন, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করেন। কখনো চোখে না দেখলেও আমি জানি, আমার বন্ধুর জীবনে আসা একমাত্র প্রেমিকটির ওরকম রূপ এবং ওই দুটো গুণই ছিল। ব্যাপারটা কদ্দূর এগিয়েছে জানার জন্যে রাতের দিকে ফোন করলাম। দীপু সলজ্জ কণ্ঠে বলল ‘কিছু এগোয়নি। ওই মেসেঞ্জারে কথা হয় আর কি।’

‘কী কথা হয়?’ আমিও ছাড়ার পাত্র নই।

‘ওই কবিতা-টবিতা নিয়েই কথা হয়।’

‘তুই যে অনুরক্ত সে তো বোঝাই যাচ্ছে, লোকটির কী ব্যাপার?’

কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা, তারপর ‘জানি না যা’।

‘দ্যাখ, এত লজ্জা পাওয়ার বয়স তোরও নেই, আমারও নেই। বলে ফ্যাল।’

‘আমি একদিন বলেছিলাম – আপনাকে আমার ভাল লাগে। তাতে উনি শুধু লিখলেন – আমারও।’

‘অতঃপর?’

‘কী?’

‘আরে তারপর আর কিছু বলেনি?’

‘হুম।’

দীপুর এই ‘হুম’ আর সেই ‘হুম’ যে আলাদা তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু শালীনতা বজায় রেখে এর বেশি জিজ্ঞেস করা যায় না। দীপুর অবশ্য শালীন-অশালীন, ন্যায়-অন্যায়, বৈধ-অবৈধ – এসব নিয়ে চিন্তা আমার চেয়ে ঢের বেশি। তাই কদিন ধরে ও নিজের সঙ্গে ঝগড়া করে গেল, আর আমাকে সেই ঝগড়ায় বিচারকের আসনে বসতে হল। অন্য কেউ হলে কী বলতাম জানি না, কিন্তু দীপুকে সমর্থন করতে আমার সমস্ত মন চাইল। আমি পরিষ্কার বলে দিলাম – দীপু বিবাহিত হলেও ওর অন্য কারোর সঙ্গে প্রেম করায় কোনো দোষ নেই। কারণ ওর বিয়েটা অর্থহীন। যারা বউয়ের সঙ্গে ওরকম ব্যবহার করে, তাদের বউয়ের অন্যের সঙ্গে প্রেম করাই উচিত। একদিন তো খুব উত্তেজিত হয়ে বলে বসলাম ‘একটা মানুষের তো শারীরিক চাহিদাও থাকে। স্বামীর থেকে সেটা পাওয়া তোর অধিকার। সেই অধিকার থেকে যদি বঞ্চিত হোস, অন্য জায়গায় খুঁজবি না-ই বা কেন?’ বলে ফেলেই মনে হল, এটা খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেল। দীপু হাজার হোক একটা মেয়ে। তার সঙ্গে কি এসব কথা আলোচনা করা উচিত? ও অবশ্য রাগ-টাগ করেনি। শুধু বলল ‘ধুর। এখনো দেখাই হল না…’

তারপর একদিন ওদের দেখা করার পরিকল্পনা হল। দীপু আমাকে মেসেজ করল ‘সম্পাদকমশাই কলকাতা বইমেলায় আসবেন। ওনাদের নাকি একটা স্টল হয়েছে। আমাকে যেতে লিখেছেন।’ মেসেজটা পেয়ে আমার বুক কেঁপে উঠল। মনে পড়ে গেল – আমি একটা মেয়ের বাবা। সেই মেয়েকে কি বিয়ের পর অন্য কারোর সঙ্গে প্রেম করতে উৎসাহ দিতাম? তাহলে দীপুর ব্যাপারে আমার কোনো দায়িত্ব নেই বলেই কি ওকে অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হতে উস্কাচ্ছি? সারাদিন মনটা খচখচ করছিল। তাই রাতে খাওয়ার পর ফোনে ফেসবুক খুলে ভটচায্যিমশায়ের পোস্ট ঘাঁটতে শুরু করলাম। কবিতাগুলো মোটেই উচ্চমানের নয়, তবে দীপুর মত একটু ভালবাসার জন্যে কাঙাল হৃদয়ে ঢেউ তোলার পক্ষে যথেষ্ট। তারপর একটু পিছোতেই দেখি স্বদেশবাবুর গিন্নীর ছবি। নানা কোণ থেকে বউয়ের ছবি তুলেছেন তিনি, কাব্যিক ক্যাপশনও দিয়েছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে বউটিকে দেখলে যে কোনো ফটোগ্রাফারেরই হাত নিশপিশ করবে। কিন্তু আমার রক্তচাপ বেড়ে গেল। এর তো বউয়ের সঙ্গে কোনো গোলমাল আছে বলে মনে হচ্ছে না! অবশ্য একটা কথা চালু আছে – ফেসবুকে সবাই সুখী আর ইনস্টাগ্রামে সবাই ধনী। ফলে বাস্তব অন্যরকমও হতে পারে। তার সন্ধানে স্বদেশি ম্যাডামের প্রোফাইলও আগাপাশতলা দেখলাম। কোথাও কোনো অসন্তোষের চিহ্ন নেই। বরং উনি স্বামীর পোস্টগুলোই শেয়ার করেন মোটামুটি, নিজে তেমন কিছু পোস্ট করেন না। স্বামী একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন, সেসবের ছবিও স্বাভাবিক গর্বে পোস্ট করেছেন। স্বামী অন্তপ্রাণ মহিলা বলেই মনে হয়। ছেলেমেয়ে নেই মনে হল। তা নিয়ে দুজনের মধ্যে অশান্তি থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তো অন্য মহিলার সঙ্গে প্রেম করার অজুহাত হতে পারে না। লোকটা তাহলে নির্ঘাত বদ। বউ ভাবছে, বর আমায় কত্ত ভালবাসে! এদিকে ইনি ফেসবুকে প্রেম করছেন। ভাবতে ভাবতে মনে হল, দীপুর মত সরল এবং দুঃখী মেয়ের সংখ্যা তো কম নয়। কে বলতে পারে, ইনি ওরকম একাধিক মহিলার সঙ্গে মেসেঞ্জারে প্রেম করেন কিনা? অথচ দীপু ভাবছে এতদিনে ও একটা আশ্রয় পেয়েছে! পরপর দুটো সিগারেট খেলাম, দুর্ভাবনা কমল না। মনে হল সেই রাতেই দীপুকে জানানো উচিত। কিন্তু ঘড়িতে তখন সাড়ে দশটা। তখন ফোন করা মানে রক্ষণশীল শ্বশুরবাড়িতে মেয়েটাকে আরও বিপদে ফেলা। কিন্তু কাউকে বলতে না পারলে ঘুম আসবে না বুঝতে পারছি। অগত্যা মশারির ভিতর ঢুকে পড়ে বর্ণালীর আধ ঘুম ভাঙিয়ে ওকেই বললাম। ও লাফিয়ে উঠে বসল।

‘মানে! তোমার বন্ধু নিজে ম্যারেড, আরেকজন ম্যারেড লোকের সঙ্গে প্রেম করছে। তুমি সেটাকে সাপোর্ট করছিলে এতদিন? কাল যদি আমি কারোর সাথে প্রেম করি? সাপোর্ট করবে তো?’

ভাগ্যিস অন্ধকারে আমার মুখটা দেখা যাচ্ছিল না! ভিজে বেড়ালের মত পাশ ফিরে শুলাম।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে ফোন অন করতেই দেখি দীপুর মেসেজ ‘তোকে বলেছিলাম না আমার কপালটাই খারাপ? আমার একটু ভালবাসা পাওয়ার ইচ্ছেও করতে নেই। ভগবানের সহ্য হয় না।’ বর্ণালী কটমটিয়ে তাকাচ্ছে দেখেও ফোন করতেই হল। আগেরদিন রাতে হঠাৎ বৃষ্টি নেমেছিল রঘুনাথপুরে, দীপু বলল কলকাতাতেও। তখন ওরা সবে খেতে বসেছে, মনে পড়ে যায় ছাদে মেলা জামাকাপড় তোলা হয়নি। দৌড়ে উঠতে গিয়ে সিঁড়িতে পড়ে বাঁ পা ভেঙেছে, ওই রাতে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে বলে বাড়িসুদ্ধ লোকের অভিশাপও হজম করেছে। এদিকে দুদিন পর থেকেই বইমেলা।

পায়ের সঙ্গে সঙ্গে দীপুর প্রেমটাও ভেঙে গেল। স্বদেশবাবু নাকি ও বইমেলায় যেতে পারবে না জেনে উত্তর দিয়েছিলেন ‘তাহলে আর দেখা হবে কী করে?’ কেন যেতে পারবে না তাও জিজ্ঞেস করেননি। দীপু তখন পা ভেঙে বিছানায়, ফলে আরও একা এবং হাতে প্রচুর সময়। আমার ঠিক উল্টো। স্কুলের সিলভার জুবিলি সেলিব্রেশন শুরু হবে, আমার ঘাড়েই মূল দায়িত্ব। প্রতি মুহূর্তে প্রিন্সিপাল ডেকে পাঠাচ্ছেন, স্কুল ছুটির পরেও সন্ধে পর্যন্ত থেকে কাজ করতে হচ্ছে, আরও নানা ঝামেলা। ফোনটা টুং টুং করে বেজেই চলেছে, চোখ ফেরালেই দেখতে পাচ্ছি দীপুর মেসেজ। কিন্তু আমার পড়ার সময় পর্যন্ত নেই। হয় আমার ব্যস্ততা আন্দাজ করে, নয় তো বুক ফাটলেও মুখ না ফোটানোর অভ্যাসে দীপু আমাকে সেসময় ফোনও করেনি। একবার শুধু দেখেছিলাম, লিখেছে ‘আমার তো আলাপ করা হল না। তুই একবার যাস ওনাদের স্টলে। যেদিন যাবি আমাকে বলিস, স্টল নম্বর বলে দেব। আমার কথা কিছু বলিস না কিন্তু। শুধু দেখে আসিস লোকটাকে সামনাসামনি কেমন লাগে। একটু বলিস। আমার তো এরকম বন্ধু আর কেউ নেই যাকে এই রিকোয়েস্ট করতে পারি।’ স্কুলের ব্যস্ততায় সেবার বইমেলায় যাব না ঠিক করেছিলাম। বর্ণালী খুব রাগারাগি করায় শেষের আগেরদিন গেলাম দুজনে। কিন্তু দীপুকে জিজ্ঞেস করার কথা আর খেয়াল ছিল না। তাছাড়া এই সম্পর্কে প্রশ্রয় দেওয়ার ব্যাপারে বর্ণালীর আপত্তিটাও যুক্তিযুক্ত।

দীপু ফোনটা করল, বইমেলা শেষ হওয়ার পর।

‘জানিস, উনি আর আমার সঙ্গে কথা বলছেন না।’

‘কবে থেকে?’

‘সেই বইমেলার সময় থেকেই। ওই যে বলেছিলাম যেতে পারছি না? বোধহয় তাতেই রাগ করেছেন।’

‘রাগ করার কী আছে? তুই কি ইচ্ছে করে যাসনি?’

‘সেটা তো উনি জানেন না, না?’

‘জিজ্ঞেস করলেই জানত। শোন, আসলে লোকটা সুবিধের নয়। আমি ওর প্রোফাইল দেখেছি। তুই জানিস তো, লোকটা বিবাহিত?’

‘হ্যাঁ। বউয়ের ছবি আছে তো।’

‘হুম। বউয়ের সাথে তো ভালই ভাব মনে হয়। এদিকে তোকে প্রেম দেখাচ্ছিল। যেই দেখা পাওয়া যাবে না শুনল, অমনি প্রেম উবে গেল। বাজে লোক। তুই এসবের মধ্যে যাস না। ফেসবুকে এরকম ফেরেব্বাজ অনেক থাকে। হয়ত তোর মত করে আরও পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলে।’

দীপুর দীর্ঘশ্বাস পরিষ্কার শোনা গেল। তারপর বলল ‘আমিও তাই ভাবছিলাম। যে বয়সের যা। এখন আমি ছেলের মা। এসব কি মানায়? সবাই তো জীবনে সব পায় না, আমিও প্রেম পাইনি। মেনে নেওয়াই ভাল, বল?’

এর উত্তর আমার কাছে ছিল না, বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার মেয়ে। দেখি হামা দিয়ে তরতর করে খোলা দরজার দিকে এগোচ্ছে। না আটকালে একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসত। তাই ‘এখন রাখছি রে, মেয়েটা কেলেঙ্কারি করতে যাচ্ছে’ বলে ফোন রেখে দিতে পেরেছিলাম। তারপর আর কথা হয়নি, মেসেজ চালাচালি হয়েছিল কিছু। নিজেকে নানারকম প্রবোধ দিচ্ছিল, আর সেগুলো আমাকে দিয়ে যেন অ্যাটেস্ট করাচ্ছিল। যা বলছিল, আমি সবেতেই সায় দিচ্ছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, এফআইআর করতে হলে ওই স্বদেশ ভটচাযের নামেও করা যায়। উদ্দালক সেনগুপ্তের নামেই বা নয় কেন? কেউ যদি আমার নামে করে? সেটাও নেহাত ভুল হবে কি?

........................... 


#গল্প #bengali story

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

30

Unique Visitors

210303