দিন ও লিপি (পঞ্চম কিস্তি)
এখন দীপাবলি ব্যাপারটা খুব বেশি করে দিওয়ালি হয়ে যাচ্ছে। বাড়িতে বাড়িতে ইলেকট্রিক নিয়নের সাজ। প্রদীপ এখন সংখ্যালঘু। তবে কালীপুজো বললেই আমার মনে পড়ে যায় একটা ভাঙাচোরা বাড়ি। যার পাঁচিলের ওপর কাঁপা কাঁপা হাতে মোমবাতি লাগাচ্ছেন সাদা শাড়ি কালো পাড়। ছোটো ছোটো আলোর ফোঁটা চন্দনের মত সেজে উঠছে।
এইরকম বাড়ি দেখা যেত ছোটোবেলার শহরতলিতে। একতলা। একটা ভাঙা গ্রিলের গেট। বেড়ার ঘর। ওপরে টালি। সীমান্ত পেরিয়ে আসা বিধবা। ঘাটে ঘাটে ঠেকে ঠেকে অবশেষে এই বাড়ি। অবশ্যই ভাড়ায়। মাঝে বয়ে গিয়েছে সময়। এবং স্বামী। সঙ্গে কটি মেয়ে। বিনুনি। ছোটোটি তেমন ছোটো নয়। তবু ফ্রক। বাকি চুড়িদার।
এবং হলুদ রঙের গোল বাল্ব। বাথরুম আর রান্নাঘরে টিমটিমে। বাকি শোয়ার ঘরে চল্লিশ পাওয়ার। একটা। তবে ও কতক্ষণই বা জ্বলে। নব্বইয়ের শহরতলি। এবং হ্যারিকেন। সন্ধেয় গোল হয়ে বসা। একটা খবরের কাগজে চুড়ো করে মেখে নেওয়া মুড়ি , লঙ্কা, কাঁচা তেল। স্টিলের গেলাসে চা। এবং ওই-ই অনেকসময় রাতখাবার। সঙ্গে অন্ধের যষ্ঠি সেলাই মেশিন। ভাগ করে করে খুটুর খুটুর। সংসার বুনে তুলছে ছিন্নমূল পরপ্রজন্ম। তারা দেখেনি ওপারবাংলা। দেশভাগ। তারা জন্মেছে এপারে। বয়ে আসা উদ্বাস্তু পা শিকড় জমাতে পারেনি। অবশেষে কলোনি। কলপাড়। এবং ছোটদের টিউশনি।
আরও পড়ুন : দিন ও লিপি (চতুর্থ কিস্তি)
পড়াতে যাওয়ার বিকেলে ওদের কারও অঙ্গে গোধূলি লাগে। ঝটিতি সাইকেল পাশে থামে আস্তে হয়ে। আবার হয়ত চলেও যায়। খেলার মাঠে সন্ধে নামে।
এদের বাড়িতে দীপাবলি আসত। গুনে গুনে চলা সংসারে একটু বাড়তি মোমবাতি। হয়ত পাড়ার মোড় থেকে কিনে আনা সস্তার এগরোল। উৎসব।
অথবা এক প্রাইমারি ইস্কুলমাস্টারের পরিবার। মানে বউ, এবং ছেলে। বউটি বলা বাহুল্য, জুড়ে বসেছেন সেই দীপাবলি বাড়ি থেকে। কালিপুজোয় চারটে চরকি, এক প্যাকেট ফুলঝুরি, একটা রংমশাল আর দুটো তুবড়ি। তুবড়ি আর রংমশাল কিন্তু কেনা নয়। পাশের বাড়িতে বানানো হত ওইসব। ছোটো ছেলেটি পেত। চেয়েই।
আরও পড়ুন : দিন ও লিপি (তৃতীয় কিস্তি)
ওদের বাড়িতেও সন্ধেবেলা মোমবাতি। এবং বাজি পোড়ানোর জন্য একটা মোম বাঁচিয়ে রাখা। তা দিয়ে ধরানো হবে ফুলঝুরি। ফুলঝুরি দিয়ে চরকি। তুবড়িদুটো বড়ো লোভের। ভয়েরও। বাবা এসে হাত ধরবে ছেলেটির। পেছন থেকে। সেই হাতে ফুলঝুরি। এরপর, আনন্দ উজিয়ে উঠবে আকাশে।
ওদের বাড়িতেও দীপাবলি আসত। তখনও। তারপর একদিন সেই ছেলেটি বড়ো হবে। দীপাবলি বাড়ির সমস্ত মেয়ে বিয়ে করে এদিক ওদিক। সাদা শাড়ি কালো পাড় ঠাঁই নিয়েছেন ফটোফ্রেমে। শহরতলি বদলে গেছে। বাহারি টুনি। মেটাল।
বড়ো আলো। বড়ো আলো চারিদিকে। অন্ধকার না থাকলে, দীপাবলি কি আসতে পারে?
[কভার পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]