দিন ও লিপি (তৃতীয় কিস্তি)
আমাদের এক মাস্টারমশাই ছিলেন। ইস্কুলের। শান্ত মানুষ। বেঁটেখাটো। ভারী সুন্দর করে হাসতে পারতেন । শুনেছিলাম তাঁর ছোটোবেলা কেটেছিল নদীতীরের এক গ্রামে। খুব অল্প বয়সেই কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিল অনেক দায়িত্ব। চটকলের বদলি শ্রমিক হয়ে সামান্য উপার্জন। তাতেই নিজের এম এ পড়ার খরচ চালানো। সঙ্গে টিউশনি। আবার কম্পাউন্ডারি শিক্ষা। মানুষ যে কত লড়াই করে এক চিলতে মাটির জন্য! তারপর সেই মাটিতে এসে পড়ে রোদ। বীজ, সার, জলের আদর। মাটি ভরে ওঠে।
আবার কখনো ভরেও না। তবু লড়াইগুলো থেকে যায়। আমার এক বন্ধুর বাবা রিটায়ার করেন তাঁর ইস্কুল বয়সে। সুতরাং এক পাঁচতারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝলমলে কলেজজীবন কাটাতে কাটাতেই তাকে ঢুকে পড়তে হয় ভোরের চাকরিতে। সাড়ে চারটেয় ঘুম থেকে ওঠা। খেয়েদেয়ে রেডি হয়ে সাড়ে পাঁচটার ট্রেন। সে সমস্ত পেরিয়ে চাকরি। দু মুঠো রোদ, এক আঁজলা বৃষ্টি। এবং সেখান থেকে হা ক্লান্ত ছুটে আসা কলেজের ক্লাস। সব মিলিয়ে আশ্চর্য দিন গুজরান। দিনশেষের সূর্য তবু পকেটে ভরে দিত নুন বাদাম। ঘুমের অভাব মাথায় এঁকে রাখত ব্যথার আলপনা। সন্ধে-শুরুর নিয়নে একা কোনো চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে সে নিজেই সন্ধে হয়ে যেত।
অথবা আরেকবন্ধু! ছোটোবেলা থেকেই যার বাবা ছিলেন ভীষণ অসুস্থ। এবং তিনি চলে যান কলেজবেলাতেই। সেই বন্ধুটার ঘাড়েও এসে পড়ে রাত জাগার চাকরি। দূরের ভিড় ট্রেন। হারিয়ে যাওয়া বন্ধু। গল্পের বই।
মানুষের একটা বয়স থাকে। যখন তার পিঠে জুড়ে যায় আশ্চর্য ডানা। যখন পুরো আকাশটাই তার নিজের মনে হয়। মানুষের একটা বয়স থাকে। যখন সেই ডানায় এসে লাগে ঝড়ের হাওয়া। উড়ে বেড়ানোর আকাশ ঢেকে দেয় ইন্দ্রমেঘ। তবু, সেই মেঘ-রোদের দিনগুলোর ওপর এসে পড়ে এক আশ্চর্য শরৎ। ঢাক বেজে ওঠে। আগমনী আর বিসর্জনের সুর আলাদা করা যায় না।
সেই যে ছিল ইস্কুল বয়স। জলপাই রঙের হাফপ্যান্ট। সাদা জামা। কালো বুট। ব্যাগের মধ্যে যত্নে রাখা মাসিক শুকতারা। সময়ে সময়ে একটু করে খুলে দেখে নেওয়া। ইলাস্টিক লুজ হয়ে গিয়ে নেমে আসা মোজা। আর জুতো। যার ফিতে বাঁধা শিখতে আমার লেগে গেছিল অনেকদিন।
স্কুলে কোনো অনুষ্ঠান চলছে। আমি হয়ত কিছু করব। অথবা করব না। ক্লাসঘর থেকে যাচ্ছি হলঘরে। হঠাৎ কোত্থেকে ছুটে এলেন নন্দিতাদি। আমাদের আঁকার দিদিমণি। দিদি নিচু হয়ে আমার খুলে যাওয়া জুতোর ফিতে বেঁধে দিচ্ছেন । আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
সেদিনই বাড়ি ফিরে আমি অনেকবার প্র্যাকটিস করব ফিতে বাঁধা। আর তারপর আস্তে আস্তে নিজের ফিতে নিজেই বাঁধতে শিখব। শুধু প্রত্যেকবার ফিতে বাঁধার সময় আমার সামনে ভেসে উঠবে দিদির নিচু হয়ে বসে ফিতে বেঁধে দেওয়ার ছবি। আমার মাথা নিচু হয়ে আসবে।
জীবনের ফিতে বাঁধা শিখতে মানুষের অনেক সময় লেগে যায়। তবু মানুষ চেষ্টা করে। আর সেইসব চেষ্টার ওপরে এসে পড়ে কিছু আশ্চর্য রোদ। এলোমেলো মেঘ। শিউলি। আর মানুষের ছায়া।
আকাশ জুড়ে শরৎ বেজে ওঠে।
[কভার পোস্টার : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র]
#silly point #মুক্তগদ্য #discourse #ডিসকোর্স #বিবস্বান দত্ত #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র