ড্যাশ ড্যাশ, বিপ বিপ...
আমার এক সহকর্মী তার ঊর্ধ্বতনের হাতে কিঞ্চিৎ ঝাড় খাবার পর একটি বেশ মজার কথা বলেছিল। বলেছিল, ইংরেজিতে গালাগাল দিলে তার নাকি খুব একটা খারাপ লাগে না! কথাটা শুনে যদিও খুব হেসেছিলাম, কিন্তু এটা অস্বীকার করার দম আমার নেই যে বর্তমানে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক আমরা আমাদের জীবনে কিন্তু গালাগাল দেওয়াটাকে দারুণভাবে ভ্যালিডেট করে ফেলেছি। এ-কথাটাও অবশ্য ভেবে দেখার মতো। গালাগাল কি আগে লোকে দিত না? নিশ্চয়ই দিত। তবে সেটার একটা Social Rejection ছিল, যেটা এখন আর সেভাবে নেই। বাবা সন্তানের সামনে ভুলবশত একটু গাল দিয়ে ফেললে নিজেই লজ্জিত হতেন এবং মা তাঁর দিকে ভর্ৎসনাপূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেন। আমার নিজের স্কুলের এক বন্ধুর থেকে আমি রোজ টিফিন ভাগ নিতাম তার সামান্য গালাগালের কথা টিচারকে বলে দেব, এই ভয় দেখিয়ে। কিন্তু আজকের OTT যুগে, আমরা গালাগালের সাথে এমন অনায়াস আপোস করে নিয়েছে যে বেশ কিছু গালাগাল কার্যত আমাদের দৈনন্দিন অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। 'হিন্দুস্তানি ভাউ' নামক এক ইউটিউবারের নাকি লক্ষ লক্ষ ভিউয়ার শুধুমাত্র তার কুকথা শোনার জন্য। তার কাজের ক্ষেত্রে গালাগালি না কোনো রূপক আর না কোনো প্রতিবাদের ভাষা। স্রেফ সস্তার হাততালি পাওয়ার মাধ্যম। তাতেই জনতা তাকে মাথায় তুলে নাচছে।
আর একটা মজার জিনিস দেখলাম সেদিন রাস্তায়। গণেশপুজো উপলক্ষ্যে এক ভদ্রলোক গণেশের মূর্তি কিনে সপরিবারে গাড়ি চড়ে ফিরছেন ভক্তিভরে। সামনের চালকের সিটে ভদ্রলোক ও তার ঠিক পাশে তাঁর ছয়-সাত বছরের কন্যা। এবার জ্যামের মধ্যে তাঁর সঙ্গে ঝগড়া লাগল এক বাইক আরোহীর। ঝগড়ার উত্তাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির ভদ্রলোক ড্যাশ ড্যাশ বিপ বিপের প্রয়োগ শুরু করলেন। আর তার গিন্নির নির্দেশে বেচারি পুচকি মেয়েটি কানে আঙুল দিয়ে রেখেছে। বেশ মজার লাগল ব্যাপারটা। কিন্তু মেয়েটির শিশুমনে এর ঠিক কী প্রভাব পড়বে কে জানে?
এই কিছুদিন আগের কথা। রুদ্ধশ্বাস ভারত-পাক ম্যাচ চলছে। শেষে ভারত জিতল। এরম একটা ম্যাচ দেখলে যে-কোনো ক্রিকেটপ্রেমীর উত্তেজনা বাড়তে বাধ্য। কিন্তু এই ম্যাচে যে প্লেয়াররা খেলছেন তাদের পরস্পরের প্রতি ব্যবহারটাও আমার মনে থাকবে। ট্রু স্পোর্টসম্যান স্পিরিট যাকে বলে। বর্তমান সময় এটা খুব দরকারি। আসল কথায় আসি। এই ম্যাচের পর মধ্যরাতে আমার এক বন্ধুর প্রোফাইলে একটি ভিডিও দেখতে পাই । সে আর তার এক বন্ধু সম্পূর্ণ মদ্যপ অবস্থায় লাইভ এসে অশ্লীল গালিগালাজ করছে পাকিস্তানকে। তাদের মূল বক্তব্য, দু-বল থাকতে যারা ম্যাচ জিততে পারে না, সেই 'ড্যাশ ড্যাশ' পাকিস্তানিরা কাশ্মীর কী করে নেবে? কথাটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল কিন্তু আজকাল সোশাল মিডিয়াতে সামান্য মতভেদ মানেই বচসা, আর বচসা মানেই আকথা-কুকথার পসরা। 'Troll' নামক এক বিচিত্র কর্মকাণ্ড ধীরে ধীরে বিনোদন থেকে আয়ের মাধ্যমে পরিণত হচ্ছে। ফিল্ম দুনিয়া থেকে রাজনীতি থেকে ক্রীড়াজগৎ - সবকিছুকে গ্রাস করে নিচ্ছে এই ট্রোল-সংস্কৃতি। ভাষায় সৌজন্য বলে কোনোকিছু থাকছে না।
কিন্তু এটা ভেবে দেখেছেন কি, যে আমরা কেন গালাগাল দিচ্ছি? স্বাভাবিক নিয়মে গালাগালি হচ্ছে রাগ ও হিংসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু আমাদের উন্মত্ত রিপু কি স্বাভাবিক সীমায় কি থাকছে? দেখেশুনে মনে হয় যেন আমরা পিছনপানে ফিরে প্রস্তরযুগের দিকেই ছুটে চলেছি প্রবল বেগে। ট্রোল-সংস্কৃতিতে আপনার যোগ্যতা আপনাকে বিখ্যাত করে না,আপনার ভিতরের নোংরা কালো বিষ সর্বসমক্ষে উগড়ে দিলেই আপনি হিরো। 'Parched' নামে ছবিটির একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে যেখানে একটি পাহাড়ের উপর উঠে তিন মহিলা সমস্ত নারীকেন্দ্রিক গালাগালগুলোকে পুরুষকেন্দ্রিক করে চেঁচিয়ে বলছে। আমাদের প্রচলিত প্রায় একশো শতাংশ গালাগালিই যে পুরুষতান্ত্রিক সমাজেরই একটি অনিবার্য ফসল, সেটা টের পেলে আপনি 'হিন্দুস্তানি ভাউ'-কে নিয়ে নাচতে পারবেন বলে মনে হয় না।
তবু আজ গালাগাল জিনিসটা বাচ্চা থেকে বুড়ো সবার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। একদা সঙ্গোপনে উচ্চারিত কথাগুলো আজ সকলের কাছে 'Cool' সাজার হাতিয়ার। 'ট্রোল' জিনিসটা আসলে রূপকথার বিকট রাক্ষসের মতো। নীরবে যে বসে থাকে আমাদেরই ভিতরে। তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার অঙ্গীকারই তো সভ্যতার পথে বাকিদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল মানুষকে। আজকাল মনে হয়, সেই রাক্ষসটাকেই আমরা জাগিয়ে তুলে ছেড়ে দিচ্ছি প্রকাশ্যে। তাকেই জিতিয়ে দিচ্ছি ক্রমশ।
......................
#social media #psychology #silly পয়েন্ট