চিলতে আয়নায় ধরা এক পৃথিবী
““It is a truth universally acknowledged, that a single man in possession of a good fortune must be in want of a wife.”
উপরের বাক্যটি যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, সেই জেন অস্টেনের নাম শোনেননি, পৃথিবীতে ইংরেজি সাহিত্যের এমন পাঠক বোধহয় খুব কমই আছেন। ইংল্যান্ডের জনপ্রিয়তম সাহিত্যিকদের একজন, জেন অস্টেনের জন্ম হয় ১৭৭৫ সালের ১৬ ডিসেম্বর, হ্যাম্পশায়ার কাউন্টির স্টিভেন্টন অঞ্চলে। তাঁর পিতা জর্জ অস্টেন ছিলেন স্টিভেন্টন ও ডিন অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত অ্যাংলিকান যাজক। মূলত রক্ষণশীল আবহাওয়ায় বড় হয়ে ওঠা জেনের সর্বাপেক্ষা ঘনিষ্ঠ ছিলেন দিদি ক্যাসান্ড্রা, অল্প কিছুদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভ করলেও তাঁর মূল শিক্ষা পরিবারের সান্নিধ্যে, ঘরোয়া আবহাওয়ায় পঠনপাঠনের মাধ্যমেই। ছোটবেলা থেকেই ছিল লেখালেখির ঝোঁক, অন্তত এগারো বছর বয়স থেকেই তিনি নিজের ও পরিবারের সকলের মনোরঞ্জনের জন্য বানিয়ে বানিয়ে কবিতা বা গল্প লিখতেন। তাঁল অপরিণত বয়সে রচনার পরিমাণ নেহাত কম নয়, জুভেনিলিয়া নামের সেইসব রচনার সংকলন এখন গবেষকদের বিষয়বস্তু।
অস্টেন যে সময় লিখছেন, ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে সেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময়। দিকে দিকে ধীরে ধীরে বিকাশ ঘটছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের, কৃষিনির্ভর ব্রিটেন ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে বাণিজ্যিক রাষ্ট্রে, সামন্ততান্ত্রিক জমিদারশ্রেণির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে আসছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। প্রেমকাহিনির মোড়কে অস্টেনের সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস প্রাইড অ্যান্ড প্রেজুডিস যেন এই সামাজিক পরিবর্তনেরই গল্প বলে, উচ্চবিত্ত জমিদারবংশের ছেলে ফিৎজউইলিয়াম ডার্সির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধে মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে এলিজাবেথ বেনেট। তথাকথিত অশিক্ষিত ব্যবসায়ী গার্ডিনার দম্পতির সৌজন্যে মুগ্ধ হয় ডার্সি, লেডি ক্যাথারিনের সামন্ততান্ত্রিক দর্প চূর্ণ হয়ে যায় এলিজাবেথের ব্যক্তিত্বের সম্মুখে। তবে ভুললে চলবে না, অস্টেনের কাহিনিগুলির মূল উৎস অষ্টাদশ শতাব্দীর জনপ্রিয় কন্ডাক্ট বুকস, যেখানে ভদ্র পরিবারের কিশোরীদের সমাজের উপযুক্ত ‘রমণী’ হয়ে ওঠার নীতিশিক্ষা দেওয়া হত। অস্টেনের উপন্যাসে তাই পাওয়া যায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সামাজিক সচেতনতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের শিক্ষা, যা বার বার দেখা যায় তাঁর নায়িকা এলিজাবেথ, এলিনর, বা অ্যান এলিয়টের ক্ষেত্রে। অস্টেন জানতেন তাঁর পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থা মূলত পুরুষতান্ত্রিক, এখানে সম্মান রক্ষার জন্য মহিলাদের বাড়তি সচেতন হওয়া ছাড়া উপায় নেই। নিজের কাহিনিগুলিতে লিডিয়া বেনেট, মেরিঅ্যান ও এম্মা উডহাউসের মত চরিত্রগুলির মাধ্যমে তিনি বারংবার নারীদের অসতর্কতাজনিত দুর্গতির দিকটি তুলে ধরেছেন।
অনেকে বলে থাকেন, অস্টেনের রচনায় বৈচিত্র্য নেই, তাঁর পূর্ণাঙ্গ ছয়টি উপন্যাস জুড়েই সেই একঘেয়ে ব্রিটেনের গ্রামাঞ্চলের ভদ্রবিত্ত সমাজের উপাখ্যান। মনে রাখতে হবে, অস্টেনের সমাজে ভদ্র পরিবারের নারীদের জীবন ছিল গৃহবদ্ধ, সেই আবহে তাঁর থেকে বহির্জগত সম্বন্ধীয় রচনা আশা করা শুধু অনুচিত নয়, অবিবেচকের কাজ। তবে অস্টেন বৃহত্তর পৃথিবী সম্পর্কে মোটেই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলেন না, ভারতবর্ষের বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস ছিলেন তাঁদের অন্তরঙ্গ পারিবারিক বন্ধু। তাঁর কাহিনিতে আমরা পাই ইঙ্গ-ফরাসী যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত অথবা প্রাক্তন ঔপনিবেশিক মিলিটারি অফিসারদের। এডওয়ার্ড সঈদ তাঁর কালচার অ্যান্ড ইম্পিরিয়ালিজম গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে অস্টেন তাঁর ম্যান্সফিল্ড পার্ক উপন্যাসে পরোক্ষে জামাইকার দাসবিদ্রোহের উল্লেখ অবধি করেছিলেন। কিন্তু অস্টেনের প্রধান দক্ষতা প্রশ্নাতীতভাবে ছিল তাঁর চেনা ঘরোয়া পরিমণ্ডলের চরিত্র চিত্রায়ণে, কন্যাদায়গ্রস্ত শ্রীমতী বেনেট, মেরুদণ্ডহীন মিঃ কলিন্স, সাদাসিধে এডওয়ার্ড ফেরার্স, কোপনস্বভাবা শ্রীমতী নরিস প্রভৃতি সত্তাগুলি তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, গভীর বিশ্লেষণ ও চমৎকার রসবোধের মিশেলে জীবন্ত হয়ে উঠেছে তাঁর কলমে। ১৮১৭ সালে ১৮ জুলাই মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে এই ক্ষণজন্মা নারী উইনচেস্টারে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজীবন অবিবাহিত থেকেছেন, শোনা যায় কুড়ি বছর বয়সে একবার টম লেফ্রয় নামক এক যুবকের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন, কিন্তু বরাবর তাঁর প্রথম প্রেম ছিল একটিই, সাহিত্যচর্চা। তৎকালীন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নিয়ম মেনে কখনও স্বনামে লেখা প্রকাশ করতে পারেননি, কিন্তু তাঁর রচনার ঘোষিত অনুরাগী ছিলেন রাজপ্রতিনিধি যুবরাজ চতুর্থ জর্জ স্বয়ং। পারিপার্শ্বিক সমাজব্যবস্থার রক্ষণশীলতা তাঁর গতিবিধি সীমিত করলেও খর্ব করতে পারেনি অস্টেনের সৃজনশীলতা, লেখনীর এক চিলতে আয়নায় তিনি আমাদের জন্য ধরে রেখে গিয়েছেন একটা গোটা সময়, একটা আস্ত পৃথিবী। তাই যেসব তেতোমুখো সমালোচকের দল তাঁর সৃষ্টিকে ইঞ্চি দুয়েকের গজদন্ত বাক্স বলে ঠাট্টা করেন, তাঁদের প্রতি একটু রাগ তো হতেই পারে, তাই না?
#ফিচার