রাজনৈতিক কার্টুন আঁকার দায়ে চাকরি গেছিল কার্টুনিস্ট নরেন্দ্রনাথ রায় ওরফে ‘সুফি’-র
কার্টুনের সঙ্গে ক্ষমতার বিরুদ্ধাচরণের সম্পর্ক বহুকালের। ভারতীয় রাজনৈতিক কার্টুনের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। কে. পিল্লাই, আর কে লক্ষ্মণ, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের বিজয় নারায়ণ শেঠ, অমল চক্রবর্তী, সুধীর তৈলাং পর্যন্ত বহু গুণী শিল্পীকে আমরা এই ধারায় পেয়েছি। নতুন প্রজন্মেও অনেকে উল্লেখযোগ্য কাজ করে চলেছেন। স্বাভাবিক কারণেই ব্যঙ্গচিত্র-শিল্পীদের নানা সময় শাসকের রক্তচক্ষু সহ্য করতে হয়েছে। এখনও হচ্ছে। ব্যঙ্গচিত্র আঁকার দায়ে অবিভক্ত ভারতবর্ষের এক প্রবাদপ্রতিম বাঙালি কার্টুনিস্ট সরকারি চাকরি পর্যন্ত খুইয়েছিলেন। আমরা তাঁকে চিনি ‘সুফি’ নামে। প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ রায়।
১৯৩৬ সালে তাঁর জন্ম। জন্মভিটে পূর্ববঙ্গে। নিতান্ত কমবয়েসেই তাঁর পরিবার চলে আসে হাওড়ার শিবপুরে। স্কুলে পড়ার সময় থেকে কার্টুন আঁকার প্রতি আগ্রহ জন্মায়। প্রবল আর্থিক সমস্যার কারণে কলেজে ভর্তি হয়েও পড়া শেষ করতে পারেননি, কিন্তু কার্টুন আঁকা ছাড়েননি। পেশাদার হিসেবে তাঁর প্রথম প্রকাশিত কার্টুন ছিল ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের ফুটবল ম্যাচ বিষয়ক। ‘গড়ের মাঠ’ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি কমিউনিস্ট পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’-র জন্য নিয়মিত কাজ করতে শুরু করেন। অবশ্য স্কুলে পড়তে পড়তে ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার ছোটদের পাতা ‘কিশোর সভা’-র সদস্য হবার সূত্রে সেখানে কিছু কার্টুন প্রকাশ পেয়েছিল। স্বাধীনতা পত্রিকার বিশিষ্ট সাংবাদিক অরুণ রায় তাঁকে স্বাধীনতা পত্রিকায় রাজনৈতিক কার্টুন আঁকতে অনুপ্রাণিত করেন। কংগ্রেস-শসিত পশ্চিমবঙ্গে সে সময়ে বামপন্থী রাজনীতির সপক্ষে কিছু বলা বা করায় ছিল ভীষণ বাধাবিপত্তি। তাই অরুণবাবু তাঁকে ছদ্মনাম ব্যবহার করতে বলেন। ‘সুফি’ নামটি তাঁরই ঠিক করে দেওয়া। এছাড়া বিনি, প্রমীলা রায়, সঞ্জয়, শ্রীগুপ্ত, বিরিঞ্চি ইত্যাদি ছদ্মনামও তিনি ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসে তিনি ছিলেন বামপন্থী। তাঁর আঁকায় সেই ভাবধারা গোপন থাকত না। স্বাধীনতা পত্রিকায় ‘কৌতুকী’ শিরোনামে নিয়মিত বের হত তাঁর কার্টুন। এর পাশাপাশি গণশক্তি পত্রিকাতেও নিয়মিত কার্টুন আঁকতেন। ইতিমধ্যে চাকরি নিয়েছিলেন হাওড়া জেলা স্কুলে। কিন্তু ছদ্মনাম তাঁকে বাঁচাতে পারেনি। স্বাধীনতা পত্রিকায় সরকার-বিরোধী কার্টুন আঁকার কারণেই কর্মচ্যুত হতে হল। এরপর তিনি কোনও চাকরি নেননি। ব্যঙ্গচিত্রকেই পূর্ণ সময়ের পেশা হিসেবে বেছে নেন। ইলাসট্রেশনের কাজও করেছেন।
কাফি খাঁ (প্রফুল্লচন্দ্র লাহিড়ী)-র পরবর্তী প্রজন্মের সবচেয়ে বিখ্যাত ও দক্ষ বাঙালি কার্টুনিস্টদের মধ্যে সুফির নাম একেবারে শুরুর দিকেই থাকবে। কমিউনিস্ট পত্রিকাগুলি ছাড়াও স্বাধীনতা, যুগান্তর, গণশক্তি, দৈনিক ও মাসিক বসুমতী, সচিত্র ভারত, যষ্টিমধু, সরস কার্টুন, প্রহরী, সচিত্র তোমার জীবন, জলসা, মঞ্চকথা, খেলার মাঠ, স্টেডিয়াম, মহিলা, সন্দেশ, শুকতারা, কিশোর ভারতী, শিশুসাথী ইত্যাদি বহু পত্রিকায় তিনি কার্টুন এঁকেছেন। তবে রাজনৈতিক কার্টুনই তাঁর সবচেয়ে জোরের জায়গা ছিল। চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোর, অহিভূষণ মালিক, রেবতীভূষণের মতো শিল্পীদের তীক্ষ্ণধী রাজনৈতিক কার্টুনের পাশাপাশি তিনি নিজের একটা মেধাবী ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন। কার্টুনিস্ট হিসেবে সর্বভারতীয় পরিচিতি ছিল তাঁর। কে. শংকর পিল্লাইয়ের বিখ্যাত কার্টুন পত্রিকা 'Shankar's Weekly'-তে তাঁর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে। নিজে ‘রঙ্গব্যঙ্গ’ নামে কার্টুনের পত্রিকা প্রকাশ করতেন। পরে পত্রিকাটি নাম বদলে হয় ‘ব্যঙ্গজগৎ’। তিনি কার্টুন আঁকা শেখানোর একটি স্কুলও খুলেছিলেন। ২০০৩ সালে এই গুণী শিল্পীর মৃত্যু হয়। বাংলায় শিল্প হিসেবে কার্টুনের তেমন কৌলীন্য নেই। ফলে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করে যাওয়া সত্ত্বেও বাঙালি কার্টুনশিল্পীদের নিয়ে সেভাবে চর্চা বা গবেষণা হয় না। অতি সম্প্রতি কার্টুনপত্তর ওয়েবসাইট বা বুক ফার্ম, লালমাটি ইত্যাদি প্রকাশনার ইতিবাচক উদ্যোগ কিছুটা আশার সঞ্চার করেছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে সুফি-র মতো শিল্পীর সারাজীবনের কাজের পূর্ণাঙ্গ একটি সংকলন আমরা পাব এবং তাঁকে নিয়ে নিষ্ঠ গবেষণাও হবে।
ঋণ : www.cartoonpattor.in