কলকাতা, আত্মঘাত আর দিনের কড়চা
একেকদিন উজ্জ্বল সকালবেলা চোখ যায় আকাশের দিকে। মনে হয় এই শহরের জন্য বড়ো বেশি নীল হয়ে আছে সে। বারান্দা থেকে মেঘের খেলা দেখি। খেলা খেলা দিয়ে শুরু। খেলতে খেলতে শেষ। খেলা! কলকাতা শহরে খেলার অভাব নেই মোটে। কিন্তু 'মৃত্যু মৃত্যু খেলা'! মনে পড়ে এক কবির বড়ো প্রিয় ছিল এই খেলা। দুপুরের রোদে পুড়ে চলন্ত গাড়ির ফাঁকে ছুটে ছুটে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়া রাজার মতো। বাংলা কবিতার 'ব্যাণ্ডমাস্টার' তুষার রায়। "হাতের ক্ষুরকে কোনো সময় বেহালার ছড় ভাবলে" যার হাতের রেজারখানা সেসময় পিছলে যাচ্ছিল "সেফটি থেকে"। বইয়ের তাক থেকে কাব্যসংগ্রহ নামিয়ে এনে খুলে বসি 'পাঁচ তারিখে' কবিতাটা। " আমি অকস্মাৎ পাঁচ তারিখে মরে যাব ভেবে/ এই পশ্চিমের বারান্দায় ঝুঁকে আছি দ্যাখো,"... মায়ের কথা মনে পড়ে। বাড়ি যাই না কতকাল!
একের পর এক পাতা ওলটাই। একটা পাতায় এসে থমকাই। 'আত্মহননের গান'। "রেল রাস্তায় ফ্লাই ওভারে অযুত হাজার/ রনন ঝনন আত্মহনন সম্মেলন উদাত্ত গান"... সম্মিলিত আওয়াজ তুলে হারাকিরির ইচ্ছেও তবে থাকে কারও কারও। নিজেই নিজের শবযাত্রায় হরিধ্বনির ইচ্ছে নিয়ে তুষার রায় দেখেছিলেন এই কলকাতা জোগান দেয় "ফাঁসেরো রশি"। 'পথভোলা সন্ন্যাসী' ভাস্কর আর 'দুঃখী রাজকুমার' শামসেরের বন্ধু ছিলেন তুষার। মনে সুখ ছিল না মোটে। বুঝেছিলেন "পৃথিবীর লোকেদের কবিতার জন্যে মমতা নেই আর।" তাইই হয়তো কান ঘেঁষে দুনম্বর ডবল ডেকার চলে যাবার পর তাঁর মনে পড়ত " দু'পাশে আমার মৃত্যু ও জীবন/ কে নেবে আমায় জোর প্রতিযোগিতা/ আমার কিছু ক্ষতি বা লাভ নেই/ কেননা জীবন ও মৃত্যু দুইই আমার প্রেমিকা।" এইসব পংক্তির পাশে আপাতত চুপচাপ কিছু না বলে বসে থাকার এক মানে খুঁজতে গিয়ে নাকের কাছে হাত নিয়ে একবার দেখে নিই ঠিক পড়ছে কিনা! বসি আরও দু মুহূর্ত। সারা সকাল ধরে বুঝি "কেবলই তুষার ঝরছে, শুধুই তুষার।"
এক বই থেকে আরেক বই। শামসেরের কবিতার কাছে যাই। কলকাতা আর নিঃসঙ্গ বিছানা ছাড়া অন্য কোনো সত্যের অপেক্ষা যার ছিল না। ফেঁসে যাওয়া হৃৎপিণ্ড দুহাতে চেপে ধরে রোজ রাতে বাড়ি ফেরার পথে যিনি বলতে পারতেন "প্রেম আর স্মৃতি আমি উড়িয়ে দিয়েছি সিগারেটের ধোঁয়ায়... খোলা ব্লেড দেখলেই তৃষ্ণায় আমার বুক জ্বলে/ পাখার হুক দেখলে মনে পড়ে যায় সোনালি ফাঁসের কথা "। নিজেরই ছায়ার আগুনে সারাক্ষণ পুড়তে পুড়তে যিনি টের পেয়েছিলেন অহেতুক থাকা আসলে অহেতুক না থাকার প্রতিভায় বাঁচে। আর "মৃত্যু? সেও থেকে যায় মৃত্যুর আপ্রাণ কালো দূরে"। এমন এক সময়ের মাঝখানে আজকাল দাঁড়িয়ে আছি যে, এসব পংক্তির গা থেকে আলো ঠিকরে এসে পড়ে। খানিকক্ষণের জন্য অন্ধ করে ভুলিয়ে রাখে মহামারীর ভয়। আরও কিছুক্ষণ তাই শামসেরকে বালির উপর দুপায়ের চিহ্ন ফেলে রেখে কবিতার শিকল ভেঙে পালাতে দেখি, সকাল তখন সবে দুপুরের দিকে মুখ ফেরাচ্ছে।
আরও পড়ুন
দুপুরের কথা খেয়াল হতেই মনে পড়ে ভাস্করের কবিতার সেইসব দুপুরের কথা, যেখানে উৎকীর্ণ দিনে উপমাও দূরে সরে যায়। "খুব জোরে হেসে উঠলে, দুপুরবেলায়, দূরের দেয়াল থেকে চূণ বালি খসে পড়ে-" আর আমিও এমন নিঃস্ব দুপুরে ভাবি, বসে বসে সকলকে চিঠি লিখব কিনা! ভালো আছি কিনা অসংশয়ে জানি না বলে চিঠি লিখতেও মন ওঠে না! অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে একের পর এক পাতা উলটে দেয় হাওয়া। চোখে পড়ে "একদিন/ আমি অদ্ভুত নির্বাসনে চলে যাবো - গ্রীষ্মের দুপুরে".. মহামারীর কালে এই দীর্ঘ ছমাসের বন্দীজীবনে এতদিন পর আমারও আর কিছুই মনে পড়ে না। "সত্যি, ইদানীং আত্মহত্যার কথাও ভাবি! নোংরা মশারির নিচে কাণ্ডজ্ঞানহীন শুয়ে আছি দুমাস তিন মাস। সন্ধে হলেই ঘরের ভেতর প্রতিদিন হলুদ একটা আলো জ্বলে ওঠে, আর জানায় যে, বেঁচে আছি আমি।... আজকাল একটুও আর কষ্ট পাই না।" ঠোঁটের কোনে পাতলা হাসি ফুটেছে বুঝতে পারি। ভেতর থেকে ঘূর্ণির মতো এক প্রশ্ন ছিটকে বেরোতে চায় যেন - "ওগো কলকাতা, তুমিও কি আমাকে আর চিনতে পারো না এখন?" যেভাবে পাশ থেকে শব্দহীন উঠে যায় মানুষ তারও চেয়ে নিঃসাড়ে দুপুর গড়িয়ে যায় বিকেলের দিকে। তেমনই ভাস্করও দেখি দুই দীর্ঘশ্বাসের মাঝে স্থির হয়ে থাকা সদ্যজা মৃত্যুকে পেরিয়ে উঠে লিখছেন "চোদ্দো বছর কাটিয়ে দিলাম আত্মহত্যা করিনি।" তার বদলে তিনি মৃত কবিবন্ধুদের প্রতিনিধিত্ব করছেন। "আমি কলকাতায় থাকি।/ বরানগরে।/ প্রত্যেকের সঙ্গেই একটা যোগাযোগ আছে আমার এখনও।" মানিক, শামসের, তুষার সবার সঙ্গেই যথাযথ ঘনিষ্ঠতা রেখেও যে কথা তিনি কানে তুলছেন না তা হল তাদের "চলে আয়" ডাক। শহরের ধাঁধায় পা দুটো আটকে রেখে দেখছেন ঘুম, এপিকের মতো বিদায় নিয়েছে। "আত্মহত্যাপ্রবণতা ছুঁয়ে বসে আছেন সভ্যতা। / রাত্রিবেলা সল্টলেকে মোটরগাড়িটা / ঘুরছে তো ঘুরেই চলেছে"। থমকাই আবারও।
একেকটা শব্দের ভেতর স্মৃতিফলকের তীর লুকনো থাকে। এককালে যখন সল্টলেকে থাকতাম শঙ্খ ঘোষের 'সল্টলেক' কবিতার শেষ পংক্তিতে পেয়েছিলাম "বাড়ির ফলকে খুব বড়ো করে লেখা হয় : আত্মহত্যা পাপ।" কলেজবেলার খামখেয়ালি পাগলামির দিনে পথ হারিয়ে সেই বাড়ি খুঁজে পাবার উৎসাহের কথা মনে পড়ে। হাসি পায় আর বুঝি বয়স বেড়ে যাচ্ছে। টেনে নিই 'পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ'। চোখে পড়ে "এইসব লেখা তার মানে খুঁজে পাবে বলে আসে/ শহরের শেষ ধাপে কবরসারির পাশাপাশি/ এপিটাফগুলি তার অভিধা বাড়ায় সন্ধ্যাবেলা / নগ্ন অক্ষরের গায়ে মৃত বন্ধুদের হিম শ্বাসে।" এক পংক্তি থেকে আলাদা করে এদের কোনো এক পংক্তিকে তুলে নেবার স্পর্ধা আমার যেন কখনও না হয়! কিছু বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস এখনো ক্ষীণতম জলকণার মতো লেগে আছে। থাক। মনে পড়ে যায় "আমার বিশ্বাস আজও কিছু বেঁচে আছে, তাই হব/ পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আত্মঘাতী।" কলেজের দিনগুলোতে এইসব পংক্তিদের মোহ কীভাবে ঘিরে রাখত, মনে পড়ে। একেকটা দিন এই 'মনে পড়ে'-র চক্করে পড়ে কেমন কেটে যায় তাই ভাবি। পাখিদের উচ্ছল বাড়ি ফেরার শব্দে চমকে উঠে দেখি এই শহরে শুরু হয়েছে নিয়নের সময়। আরও একটা দিন পার করে ফেললাম কী সহজে!
"আপনি বেঁচে আছেন স্রেফ সরল একটা কারণে, আপনি নিশ্বাস নিচ্ছেন আর ফেলছেন। বজায় রাখুন ওই কাজটা। আরও দু-একটা বড়োসড়ো ঝড়ঝাপ্টা আসবে। নার্ভাস হবেন না।" ফিরে আসি ভাস্করের কাছে। এবার অন্তত চায়ের জল বসাতে হবে বলে উঠেও পড়ি আবার। চায়ের পরিমাণটা মাপতে মাপতে বিড়বিড় করি "শুনুন, মনখারাপ করবেন না।" চায়ের জল ফুটতে থাকে, ফুটতেই থাকে। পাশের বাড়ির রান্নাঘরে সন্ধের আলো জ্বলে ওঠে।
নিয়নের আলোয় ভেজা কলকাতার রাস্তায় তখন একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়ছে সন্ধের আবছায়া, যেভাবে জিভের রন্ধ্রে রন্ধ্রে চারিয়ে যায় চায়ের আস্বাদ। আর আত্মহত্যা মুলতুবি রেখে আরেকটু তারিয়ে তারিয়ে চেখে নেওয়া যায় জীবনের সমূহ আখ্যান।
[পোস্টার : অর্পণ দাস।]
#কলকাতা #কবিতা #আত্মঘাত #আত্মহত্যা #গদ্য #প্রিয়া সামন্ত