ব্যোমকেশ ও ছাগল কলোনি
পিঁজরাপোলের কথা ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাসে বলেছিলেন রসিকবাবু। আঙুল কাটা রসিকবাবু। কারখানার মেশিনে তার আঙুল খেয়েছে। হঠাৎ কোন বোমাবাজ তাকে লুকিয়ে বোমা মেরে যায়নি। এই সব বোমাবাজির ঘটনা সদ্য প্রকাশিত সিরিজের। বোমা কেন মারল, রসিকের অপরাধ কী তা পরিচালক সুদীপ্ত রায় জানেন। কারণ ব্যোমকেশ কাহিনির ‘চিড়িয়াখানা’-কে তিনি প্রাণের খুশিতে ‘পিঁজরাপোল’ বানিয়েছেন। চিড়িয়াখানায় বেশ দৃষ্টিনন্দন সব পশুরা থাকে, পিঁজরাপোলের মধ্যে থাকে বুড়ো গবাদি। তাই সিরিজের নামকরণের সার্থকতা সাজাতে গোটা সিরিজের উপর একটা ডিসটোপিয়ান পলেস্তারা সেঁটে দেওয়া। সেই ডিসটোপিয়ার সাথে ব্যোমকেশের পেটখারাপের সম্পর্ক আছে কিনা জানি না, তবে সামরিক মোটরের সমাধি ক্ষেত্রে ভগ্ন হৃদয়ে গদগদ বুকনি - জমে ভালো। মুশকিলটা হল, এই সমাধি ক্ষেত্রটি কলোনির ঈশান কোণে। কলোনি লাগোয়া। যখন ব্যোমকেশদের গাড়ি সমাধির সামনে দাঁড়ায় তখন আশেপাশে কলোনি স্ক্রিনে ছিল না। আর তারপর লম্ফ দিয়ে নিশানাথের বাড়ির সামনে গাড়ি চলে এলে সুবিধে একটাই হয় - ডিটেলিং-এর শ্রম বাঁচে। চিড়িয়াখানা উপন্যাস যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন, উপন্যাসের মাঝে একটা নকশা আছে। সৌভাগ্যক্রমে ঔপন্যাসিক শ্রমের তোয়াক্কা না করে অক্ষরের মাঝে ম্যাপ এঁকেছিলেন।
নকশা অনুসারে যে ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে কলোনি, ততটা অঞ্চল জুড়ে কলোনিকে দেখানো হয়নি। বরং দেখানো হয়েছে একটা বাড়িকে। যে বাড়িতে কলোনিয়াল হ্যাংওভার আছে। কলোনি নেই। দক্ষিণ কলকাতার একটা বাঘাযতীন কলোনি বা বিদ্যাসাগর কলোনির কথা ভাবুন দেখি। ওই অত্তোটা জায়গার যে মালিক, তার যা দাপট- আর একটা বাড়িতে সবাইকে নিয়ে থাকা মালিকের দাপট কি এক হতে পারে? সিরিজের পরিচালক নিশানাথকে প্রায় বাড়িওয়ালাতে পর্যবসিত করেছেন। গোটা গোলাপ কলোনিকে ছেঁটে ফেলার বিরোধী হলেও পিঁজরাপোলের লোকেশন বেশ ছমছমে। লোহিয়া রাজ বাড়ির কোণে কোণে আলো ছায়ায় অদ্ভুত খেলা তৈরি করেছেন সিনেমাটোগ্রাফার। বেশিক্ষণ অন্দরমহলে কাটানোয় দম আঁটা ভাবটা বেশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। শুভদীপ গুহের সুর সিরিজের সেই থমথমে ভাবটাকে গাঢ় করে।
প্রাক -মোহনপুর অধ্যায়ে ব্যোমকেশ-অজিত জুটির রমেন বাবুর শরণাগতি অংশ বাদ যাওয়ায় ‘নেত্যকালী-সুনয়না’ সমস্যার জাল ঘনীভূত হয় না সিরিজে। এখানে মুরারি খুনের প্রসঙ্গ আগে সত্যান্বেষী জানতে পারেননি। হয়ত পরিচালক তখন তাকে শৌচাগারে আটকে রেখেছিলেন। জানলেও হয়ত না জানাটা হয়ে যেত অজিতের দোষ। তারপর হয়ত ব্যোমকেশ হেব্বি চেল্লাতেন। উপন্যাসে পানুর মৃত্যুর পর ব্যোমকেশ বলে, ‘- আমার দোষ। আমার ভাবা উচিত ছিল,পানু যদি সত্যিই কোন গুরুতর কথা জানতে পেরে থাকে, তাহলে তার প্রাণের আশঙ্কা আছে।‘ আর সিরিজে ব্যোমকেশ বলে ‘সারাজীবন মনে রাখবে অজিত, পানুকে খুন করেছ তুমি।’ প্রতীক দত্তের লেখা এই শব্দগুলো হয়ত ব্যোমকেশের করা ভুল থেকে ব্যোমকেশকে নিষ্কৃতি দেয়। হিরো কি আর ভুলে ভরা হয়? ব্যোমকেশের পেটখারাপ তাকে মানবিক করার একটা চেষ্টা হতে পারত, কিন্তু সপ্তাহ ব্যাপী ব্যোমকেশের অসুস্থতা ও ডাক্তার না দেখানো স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাবকে দর্শায়। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে – হিরোর কি স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবার প্রয়োজন পড়ে? আমাদের হিরো নিকোটিন প্যাচ নেন না। সিগারেট খান। কাজেই স্বাস্থ্যের দিকে তিনি মন দেন না। তাই সাতদিন পেটখারাপ চলতেই পারে। আর হিরো তো, নাক টিপে হলেও সহ্য করা যেতে পারে। নিকোটিনের কথা প্রসঙ্গে মনে এল, ব্যোমকেশের গল্পগুলিতে মারণাস্ত্র সব সময়েই অভিনব। গ্রামাফোনের পিন, শজারুর কাঁটা- বেশ চমকপ্রদ খুনের যন্ত্র। নিকোটিন বিষ, কিন্তু সিগারেটের প্যাকেটে প্যাকেটে পাওয়া যায় না। এই বিষের সঙ্গে জড়িয়ে আছে উপন্যাসের অনেকটা অংশ। এই বিষই মুরারিকে মারে। এতেই মারা যায় বনলক্ষ্মী ও ভূজঙ্গধর। কিন্তু সিরিজে বিষ, বিশ বাঁও জলে। বৌদ্ধিক ক্ষিপ্রতায় এইসব সূক্ষ্ণ কাজ ধরে ফেললে দর্শককে মনোযোগী হয়ে গোয়েন্দাকে দেখতে হয়। সেই সব সুতো ধরতে গেলে যে মনোযোগিতা লাগে তা দর্শকের নেই। অ্যাটেনশন স্প্যানই ১০ সেকন্ডের তলায়। এসব কথা ভালো করেই জানেন নির্মাতারা। তাই খুনের দৃশ্য বেশ হাড়হিম করা হলেই চমৎকার। খুনের উপায়, পদ্ধতি পর্যালোচনা নব্য ব্যোমকেশে চলে না। কিন্তু এই কি ব্যোমকেশ? শরদিন্দু লেখেন, ‘পানুগোপালের মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে দোষী মনে করিতেছে, একান্ত নিভৃতে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করিতে চায়।’ কিন্তু বোঝাপড়াটা, স্লো মোশনে দাবার বোর্ড ফেলার পর, কখন করল ব্যোমকেশ? নাকি নেতাদের স্টাইলে দায় এড়িয়ে গেল?
আসলে সিরিজের ব্যোমকেশ জনতার কাছে হিরো। হিরো অতি বিষম বস্তু। সাহিত্যের ব্যোমকেশ সাধারণ এক বাঙালি। একটু আলগোছে সে জীবনটাকে দেখে। কিন্তু হইচই করতে করতে সিরিজের ব্যোমকেশ ক্রমশ শার্লকীয় মাইন্ড প্যালেসে আসা যাওয়া শুরু করেছে, তার হিসাবেও ডিডাকসান ধরা পড়ছে। রকম সকমে চরিত্রাভিনেতা শার্লক না হয়ে উঠুন, কিছু কিছু জায়গায় বেনেডিক্ট কাম্বারব্যাচ হয়ে উঠছেন। হিরোর গোয়েন্দাগিরির গল্প দেখাতে বসলে হিরো বাদে বাকি অনেক কিছুতেই মনোযোগের খামতি ঘটতে পারে। কিন্তু হিরোর আবার খামতি কীসের? সব মিলিয়ে ব্যোমকেশ আর দোষে গুণে মেশানো সাধারণ মানুষ নন। অভিনয়ে তাই হিরোর চেয়ে অনেক এগিয়ে পানু, বিজয়, নজর, রসিক চরিত্রে বুদ্ধদেব, সৌমিক, দীপান্বিতা, সুমন্তরা। তাদের আলাদা আলাদা মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু চেনা যায় না অজিতকে। অজিত কথার খেলোয়াড়, কিন্তু এখানে সে ব্যোমকেশের ছায়ায় সুপ্ত। সিরিজের পর সিরিজে অজিত ক্রমশ লঘু হয়ে উঠছে। শরদিন্দুর ব্যোমকেশ যুদ্ধ বিরোধী, ফ্যাসি বিরোধী এক বাঙালি। আজ দেশে অন্য রকম হাওয়া। এক নায়কের পূজাই সর্বত্র। হইচইয়ের ব্যোমকেশও পাল্টাতে পাল্টাতে সেই দলেই নাম লেখায় কি না তাই দেখার। তখন হয়ত শরদিন্দুর ব্যোমকেশের ভবিষ্যৎ বাণী মিলে যাবে। ‘… গোলাপ কলোনীর পাশে হয়ত শীগ্গির ছাগল কলোনীর আবির্ভাব হবে।’
...............
[গোলাপ কলোনির নকশার ছবিটি ও উপন্যাসের উদ্ধৃতিগুলি শরদিন্দু অমনিবাস প্রথম খণ্ডের ‘চিড়িয়াখানা’ উপন্যাস থেকে গৃহীত।]