আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক
“ত্রিকোণ পাথর। তাকে ঘষে ঘষে সূচিমুখ করিগুহামধ্যে জড়ো করেছ অস্ত্রশস্ত্র, কালাশনিকভ,বিশুদ্ধ সাঁজোয়া ট্যাংক, ডিনামাইট।আস্তিনে রেখেছপারমাণবিক বোমা। ঘিরে ধরেছ চতুর্দিক থেকে।তোমাদের প্রেম, এই ব্যূহরচনার শৈলীযুগপৎ মুগ্ধ করে, বমনও উদ্রেক করে আজ।”– রাকা দাশগুপ্ত
এই ঘিরে ধরা একদিনে হয়নি। এক বছরেও নয়। শতকের পর শতক জুড়ে, আশ্রয় সেজে, পিতৃতন্ত্রের বিষ জড়িয়ে রেখেছে মেয়েদের। ‘তোমাদের ভালো চাই, তাই বারণ করি’– এই উচ্চারণের মধ্যে মঙ্গলকামনার হয়তো খামতি নেই, কিন্তু একইসঙ্গে দুর্বিনীত পুরুষের ‘চাইলেই পারি’ মেজাজকে তোষণ করাও আছে।
পার্ক স্ট্রিট, দিল্লি, কামদুনি, কাশ্মীর, মণিপুর, হায়দ্রাবাদ, হাথরাস হয়ে আর জি কর, এবং এর মাঝে ছড়িয়ে থাকা আরও অসংখ্য পুনরাবৃত্তি। ধর্ষণ বহুকাল ধরে নিউজ চ্যানেলের তরজার মতোই স্বাভাবিক। ততটাই স্বাভাবিক হল, প্রতিটি ঘটনার অনতিকাল পরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রতিবাদের পাশাপাশি ড্রয়িংরুমে বসে মেয়েদের পোশাকের দৈর্ঘ্য বিচার আর ধর্ষিতার চরিত্র বিশ্লেষণ। এই অবধি পড়ে যাঁরা ভাবছেন, “ঠিক ঠিক! তবে আমার বাড়িতে মোটেও...”, ভুল ভাবছেন। দুর্ঘটনার জের থিতিয়ে গেলে একবার খেয়াল করে দেখবেন, গলির মুখের দোকান থেকে একটা সাবান কিনে আনতে বেরোলেও বাড়ির মেয়েটিকে শরীর-ঢাকা পোশাক পরে বেরোতে হয়। ছেলেরা অবশ্য হাফপ্যান্ট, লুঙ্গি যা খুশি পরে বেরোতে পারেন। পাড়া-সংস্কৃতির মধ্যে থাকলে দেখবেন, সাতসকালের চায়ের দোকান কীরকম মধ্যবয়স্কদের স্যুইমিং ক্লাব হয়ে উঠেছে। খালি গায়ে সে কী দেদার আড্ডা! মেয়েদের শরীরে উল্কি দেখলে তাঁদের উক্তি শোনেননি বুঝি? “এই দেখে যদি কোনও ছেলে হাত ধরে টানে, অমনি তো ছেলেটার দোষ!”
ঠিক এই কারণেই পুরুষ হিসেবে নিজেকে এখন একটা শিশ্নের অধিক কিছু ভাবতে পারি না। যারা কলকাতার হাসপাতালে ছিল, কাঠুয়ার মন্দিরে ছিল কিংবা দিল্লির চলন্ত বাসে, আমি তাদের থেকে ঠিক কোথায় আলাদা? আমার বড়ো হয়ে ওঠার মধ্যেও তো ছিল মায়ের অফিস-বাড়ি-আত্মীয় সামলে নিজের শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দেওয়া, রাজ্যের অন্য প্রান্ত থেকে কলকাতায় পড়তে আসা বোনের নিজে থেকেই স্বাধীনতার গণ্ডি ঠিক করে নেওয়া, বান্ধবীদের বাড়ি থেকে চাপিয়ে দেওয়া বিধিনিষেধ। পারিবারিক মূল্যবোধ আর শিক্ষার জমি শক্ত হওয়া সত্ত্বেও ছেলে হওয়ার সুবাদে যে বিপুল সুবিধা আমি পেয়েছি, তাকে তো সুবিধা বলে চিনতেই অনেকটা সময় লেগে গেছে। সেই একই শিক্ষা, একই মূল্যবোধ যদি প্রতি অভিভাবক তাঁর সন্তানকে দিতে চেষ্টা করেন, তাহলে ধর্ষক আসে কোথা থেকে? মানসিক বিকার, লালসা, অবদমিত যৌনতা, ক্ষমতার দম্ভ– যেভাবেই একজন ধর্ষকের হীনতাকে বোঝার চেষ্টা করুন, পারবেন না। প্রতিটি ধর্ষণের পরে অপরাধী ধরা পড়ে, রাজনৈতিক মদত না থাকলে তাদের মৃত্যুদণ্ড হয়। তারপর? পরের ধর্ষণটা আটকানোর জন্য ঠিক কতটা নিশ্ছিদ্র সুরক্ষার ব্যবস্থা করব আমরা? পরিসংখ্যান বলছে, ১৫-৪৯ বছর বয়সি ভারতীয় মহিলাদের প্রায় ৩০% কোনও না কোনও সময়ে পরিবারের মধ্যেই যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। কাজের জায়গায় যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে হিসেবটা প্রায় ৫৭%। একজন মানুষ নিজের পরিবার বা কর্মক্ষেত্রের থেকেও বেশি সুরক্ষা আর কোথায় পাবে?
সম্ভব নয়, কারণ সমস্যা চিনতে শিখিনি আমরা। চিনলেও তাকে মেনে নিতে পারি না। সমস্যা রয়ে গেছে আমাদের পারিবারিক লিঙ্গবোধের একেবারে মূলে। নির্ভয়াকে ছিঁড়ে খেয়েছিল যে লোকগুলো, তাদের মধ্যে অন্যতম মুকেশ সিংহের স্বীকারোক্তি মনে আছে? “অত রাতে মেয়েটা একটা ছেলের সঙ্গে ফিরছিল, ওসব মেয়েদের সঙ্গে এমনটাই করতে হয়”। নিশ্চয়ই ভুলে গেছেন অন্য দুই অভিযুক্তের হয়ে সওয়াল করা আইনজীবী অজয় প্রকাশ সিংহের অনন্য মন্তব্য? “আমার মেয়ে রাতে একটা ছেলের সঙ্গে ঘুরলে তাকে স্রেফ ফার্ম হাউসে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারতাম”। দুটো মানুষ, যাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, শিক্ষা, সুযোগ, প্রতিপত্তি সবকিছু আলাদা, তারা এই জায়গায় কী ভীষণ একরকম। খোলা চত্বরে সাংবাদিকদের সামনে, বিবিসির তথ্যচিত্রে বারবার যে কথা উচ্চারিত হয়েছে, তা মক্কেলকে বাঁচানোর জন্য উকিলের দায়বদ্ধতা নয়, অপরাধীর নিজেকে মানসিক রোগী প্রমাণ করার ফন্দিও নয়– একান্ত ব্যক্তিগত বিশ্বাস। সে বিশ্বাসের কাঠামো গড়ে দিয়েছে সনাতন সমাজ। মানসিক নয়, ধর্ষণ করার ইচ্ছা আমাদের সামাজিক ব্যাধি। যে সমাজ শিখিয়েছে মেয়েদের ঠিক কী কী করতে নেই, যে সমাজ প্রতিনিয়ত মেয়েদের শিখিয়ে চলেছে কোথায় কতটা হেনস্থা লঘুজ্ঞানে মেনে নিতে হবে এবং মানিয়ে নিতে হবে, সেই সমাজের অংশ আমি-আপনি, আমাদের আত্মীয়-পরিজন-বন্ধু সব্বাই। আমাদেরই মধ্যে থেকে কেউ মনে করে ‘ভদ্র’ মেয়েদের রাত করে ফিরতে নেই, কেউ জানে বউয়ের খরচাপাতির দায়িত্ব বরের, কেউ বিশ্বাস করে একটা বয়সের পরে মেয়েকে চোখে-চোখে রাখতে হয়। সেই সমাজের অংশ হিসেবে একটি পরিবার যখন নিরাপত্তার তাগিদেই তার মহিলা সদস্যদের কোনও না কোনও শিকলে বাঁধে, তখন সেই প্রতিটি পরিবার একজন সম্ভাব্য ধর্ষকের জন্ম দেয়। পরিবারের কনিষ্ঠতম পুরুষটিও শেখে এই সমাজে মেয়েদের জায়গা সীমিত আর তার ক্ষমতা অসীম। পরিবার পুত্রকন্যা নির্বিশেষে সন্তানের মঙ্গল চেয়ে, তাদের মানুষ হিসেবে গড়তে চেয়ে, ধীরে ধীরে নিজের অজান্তে ধর্ষণের বীজ বপন করে। এরপর সেই পুরুষটির অহং-এর নিয়মিত ভরণপোষণ আর তাতে আঘাত লাগার অপেক্ষা– সেটুকু ঠিকঠাকভাবে হলেই সমাজ পাবে আর-একজন ধর্ষক, আমি-আপনি পাব আর-একটা আর জি কর।
এই গোটা ব্যাপারটাই একটা বৃত্তের মতো, শুরু-শেষ ঠাহর করা মুশকিল। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মেয়ের বাড়ি ফিরতে অতিরিক্ত দেরি হলে কোনও বাবা-মায়ের পক্ষেই দুশ্চিন্তামুক্ত থাকা সম্ভব নয়, কারণ প্রশাসন সেটুকু আশ্বাস দিতে পারে না। তার থেকে বড়ো কথা, আমাদের সমাজব্যবস্থা পিতৃতন্ত্রকে এমনভাবে গেঁড়ে বসিয়েছে যে মেয়েদের আলাদা করে সুরক্ষার প্রয়োজন, এই বিশ্বাস আমাদের স্নায়ুকোশে ঢুকে গেছে। চাইলেই সেই অভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়, এমনকি বেরিয়ে আসা যাচ্ছে না বলে অভিভাবকদের দোষারোপ করার জায়গাও নেই। অতএব যা করার করতে হবে আমাদের প্রজন্মকেই। নারীর ক্ষমতায়ন, সমানাধিকার এগুলো নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে; হওয়াটা প্রয়োজন। কিন্তু এই মুহূর্তে পারিবারিক পুরুষতন্ত্রের কাঠামোতে আঘাত করাটা আরও বেশি প্রয়োজনীয়। আর জি করের ঘটনার পরেই সামাজিক মাধ্যমে ভেসে আসতে দেখা গেছে “এইজন্যই বাবা এত কড়াকড়ি করত” কিংবা “এখন বুঝি মেয়েকে কতটা সাবধানে রাখা দরকার”– এই জাতীয় মন্তব্য। সোশ্যাল মিডিয়াতেই একজন লিখেছেন তাঁর কানে শোনা কথা, এক বাবা মেয়েকে ফোনে বলছেন ‘তোকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেব’। নারী পুরুষ নির্বিশেষে চিন্তা এবং চেতনার বয়ান একই হয়ে দাঁড়ালে বোঝা যায়, পিতৃতন্ত্রের সবচাইতে বড়ো জয় এখানেই। যে, মেয়েদেরকেও সে বুঝিয়ে ছেড়েছে, পারিবারিক সুরক্ষাই তাদের একমাত্র আশ্রয়। এই সুপরিকল্পিত ধারণা ভেঙে বেরোতে না পারলে যৌন লাঞ্ছনা, ধর্ষণ, পারিবারিক হিংসা কোনও কিছুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে উঠবে না। পরিবারকে অগ্রাহ্য করে নয়, তার ভালোবাসাকে সম্মান জানিয়েই তা করা সম্ভব, শুধু এইটুকু মেনে নিতে হবে যে একজন পুরুষ ও একজন মহিলার সামাজিক কর্তব্য এবং তথাকথিত শিষ্টাচার পালনে কোনও প্রভেদ থাকতে পারে না। মেনে নিতে হবে, বাড়ির মেয়েকে যা কিছু করতে ‘সামাজিক’ দৃষ্টিতে বারণ করা যায়, ছেলেটির জন্যও ওই একই যুক্তি প্রযোজ্য। সবার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু এভাবে আর মানিয়ে নেওয়াও সম্ভব নয়! এখনও যদি সমাজ শুধরে না যায়, ভবিষ্যতে চরম আঘাত আসবে। রাজ্য জুড়ে দুশো জায়গায় যে জমায়েত হল, তা ওই তেকোনা পাথরটাকে ছুঁচলো করা। পুরুষতন্ত্রের কদর্য ক্লেদগুলো নিজেরাই সাফ করতে না পারলে একদিন নিঃশব্দে পাথরের তীক্ষ্ণ অগ্রভাগ সমাজের নাভিমূলে ঢুকে যাবে। তার আগে বদল আনা প্রয়োজন। যেদিন কোনও মহিলাকে তার স্বাধীন সিদ্ধান্তের জন্য অভিভাবকের অনুমতি নিতে হবে না, পোশাকের ঝুল কত বা সিগারেট খায় কি না তাই দেখে তার উদ্দেশ্য বিচার করা হবে না, ঋতুকালীন অসুবিধার কথা বলতে হলেও সহকর্মীরা অস্বস্তি বোধ করবেন না, সেদিন থেকে ধর্ষককেও সাধারণের ভিড়ে চোখে আঙুল দিয়ে চিনিয়ে দেওয়া যাবে।
যতদিন সেটা হচ্ছে না, একজন মহিলাও কোথাও সুরক্ষিত নন। যতদিন সেটা হচ্ছে না, মহিলারা বাড়িতে না ফেরা অবধি তাদের ভালোবাসার পুরুষরা একইরকম বিপন্ন বোধ করবেন। যতদিন সুরক্ষার নামে বাড়িতে পঞ্চায়েত আর অফিসে সিসিটিভি বসানো হবে, ততদিন বাড়ির মধ্যে মহিলাদের সম্মানের ধর্ষণ হবে, আর অফিসে দক্ষতার। যদি সত্যি অঘটন ঘটে যায়, তাহলে ওই সিসিটিভির সামনে বসা চোখগুলোও সত্য খোঁজার আগে শরীর চেখে নেবে, কারণ সমাজ তাদের সুযোগ নেওয়ার শিক্ষাই দিয়েছে এতকাল। মেয়েরা ছকের বাইরে গেলে যোগ্য নয়, ভোগ্য হয়– এটাই শিখে এসেছি আমরা। আমাদের বাবা-মা তা শেখাননি, কিন্তু সমাজের প্রতিটা ক্ষেত্র গুরুঠাকুর হয়ে সামনে দাঁড়িয়েছে আর সে গুরুঠাকুরকে উপেক্ষা করার সতর্কতা পারিবারিক শিক্ষার মধ্যে এখনও উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। তাই প্রচণ্ড অস্বস্তি হলেও মেনে নিন যে আমার-আপনার মতো পুরুষমানুষের মধ্যেই একজন ধর্ষক লুকিয়ে আছে। শুধু পাশবিক ইচ্ছেটা ছাড়া, তার সঙ্গে আমাদের আর কোনও প্রভেদ নেই, কারণ প্রভেদ করার চেষ্টাই করিনি এতদিন।
যতদিন সেই প্রভেদ স্পষ্ট হচ্ছে না, নিজের লিঙ্গপরিচয়ের লজ্জা আমাকে বয়েই চলতে হবে।
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান
আরও পড়ুন : যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান
#স্পর্ধা #RGKAR #wewantjustice #reclaimthenight