বাঁধা গতের চর্বিতচর্বণ: স্ট্রেঞ্জার থিংস 'সিজন ফোর'
সিরিজ: স্ট্রেঞ্জার থিংস সিজন ফোরস্রষ্টা: ডাফার ব্রাদার্সশ্রেষ্ঠাংশে: মিলি ববি ব্রাউন, উইনোনা রাইডার, ডেভিড হার্বোর, ফিন উল্ফহার্ড, গ্যাটেন মাতেরাজ্জো, জো কিয়ারি, নাতালিয়া ডায়ার, মায়া হক, সেডি সিঙ্ক, ক্যালেব ম্যাকলাফলিন, নোয়া স্ন্যাপ, চার্লি হিটন প্রমুখ
৫ নভেম্বর, ১৯৮৩। ইন্ডিয়ানা প্রদেশের ছোট্ট ঘুমপাড়ানি শহর হকিন্স থেকে হঠাৎই উধাও হয়ে যায় উইল বায়ার্স নামে এক লাজুক বালক। খোঁজ লাগায় তার তিন খুদে বন্ধু- মাইক, ডাস্টিন আর লুকাস, জানা যায় শহরের ওপারে রয়েছে আপসাইড ডাউন নামে আলাদা এক জগত। ওদিকে হকিন্স গবেষণাগার থেকে পালিয়ে আসে একরত্তি এক মেয়ে, হাতে ট্যাটু করা একখানা সংখ্যা- ইলেভেন।
২০১৬ সালে আবির্ভাবেই দেশবিদেশের দর্শকের মন জয় করে নিয়েছিল ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’। স্টিফেন কিং, স্টিভন স্পিলবার্গ, স্ট্যান লি প্রমুখ দিকপালদের কাজের সঙ্গে স্পষ্ট সাদৃশ্য থাকলেও গল্প বলার মুনশিয়ানা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা আর দুর্দান্ত অভিনয়ের জোরে পাকাপাকিভাবে এই সিরিজ উঠে এসেছিল জনপ্রিয়তার শীর্ষে। তারপর তৈরি হয়েছে আরো দু’খানা সিজন, এসেছে নিত্যনতুন চরিত্র। ডানপিটে ম্যাক্স, ঠোঁটকাটা এরিকা বা ছটফটে রবিনের মতো নয়া চরিত্রদের ভালোবেসে ফেলেছে দর্শকেরা। বয়স বেড়েছে খুদে বন্ধুদের, অনিবার্যভাবে এসেছে বয়ঃসন্ধিজনিত সমস্যা, তবে তৃতীয় সিজনে আচমকা রাশিয়ান চক্রান্ত প্রভৃতি এনে ফেলায় খানিকটা হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গল্পের বাঁধুনি। বিপুল প্রত্যাশার মাঝে এসেছে চতুর্থ সিজন, কোভিডজনিত বিভ্রাট কাটিয়ে শেষমেষ হকিন্স আর আপসাইড ডাউনের অদ্ভুতুড়ে দুনিয়া আবার হাজির নেটফ্লিক্সের পর্দায়। এবং দুঃখের বিষয়, বিরাট বিরাট এপিসোডে মনে রাখার মত উপাদান প্রায় কিছুই নেই।
একটু খুলে বলা যাক। স্ট্রেঞ্জার থিংস সিরিজের মূল প্লট অভিনব কিছু নয়, যাঁরা নিয়মিত কল্পবিজ্ঞান এবং অলৌকিক সাহিত্যের পাঠক তারা এই গল্পের প্রায় প্রত্যেকটি উপাদানের সঙ্গে আগে থাকতেই পরিচিত, আশির দশকের আমেরিকা নিয়ে এ ধরনের কাজ আগে যথেষ্ট হয়েছে, যেমন দ্য গুনিস বা সুপার এইট। এই সিরিজের মূল বাজি ছিল গল্পের টানটান বাঁধুনি এবং পুরনো রান্নায় নতুন মশলা দেওয়া, যেমন আপাত বেয়াদব স্টিভকে নরম মনের মানুষ হিসেবে তুলে ধরা বা সমকামী রবিনের কাহিনিতে প্রবেশ। কিন্তু যত সিরিজ এগিয়েছে, একের পর এক নতুন চরিত্রের ভারে তত নুয়ে পড়েছে চিত্রনাট্য, মার খেয়েছে গল্পের গতি। অবশেষে চতুর্থ সিজনে এসে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে একাধিক চরিত্রকে ঠিকঠাক জায়গাই দেওয়া যাচ্ছে না, এরিকা, রবিন, সুজি পু, আরগাইলের মত বেশ কিছু সম্ভাবনাময় চরিত্রদের স্রেফ নষ্ট করা হয়েছে, একটা জোরালো সংলাপ বা সত্যিকারের চমকপ্রদ মুহূর্ত নেই যার কারণে দর্শক এদের প্রতি ঠিকঠাক মনোযোগ দেবেন। একদিকে রাশিয়ার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, অন্যদিকে হকিন্সে ভেকনা নামক দানবের হানা, আরেকদিকে ইলেভেনকে নিয়ে টানাটানি, আরো একদিকে মাইক উইল জোনাথনের যাত্রা- নানাদিকে কাহিনির শাখা প্রশাখা এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে বোট্যানিকাল গার্ডেনের সেই বটগাছের মত কাণ্ডটাই উধাও হয়ে যাবার জোগাড়। মাইক, উইল, জোনাথনকে একটা সময় গল্প থেকে কয়েক এপিসোডের জন্য পুরো গুম করে দেওয়া হয়, প্রথম ভাগের শেষে কোনো হদিশই পাওয়া যায় না তাদের। বয়ঃসন্ধিকালীন যেসব সমস্যা তুলে আনা হয় তার বেশিরভাগই এর আগে দেখানো হয়ে গিয়েছে, মাইকের প্রতি উইলের আকর্ষণ বা তার সঙ্গে ইলেভেনের বিবাদ নতুন করে কোনো আগ্রহ জাগায় না। অযথা এপিসোডের কলেবর বেড়েছে, কাহিনি এত শ্লথ হয়ে গেছে যে চতুর্থ এপিসোডের আগে রহস্য ঠিকঠাক দানাই বাঁধে নি। ভেকনার মধ্যে প্রকৃত ভয়ঙ্কর খলনায়ক হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও প্রথম ভাগের পর্বগুলোয় তাকে মাত্র পাঁচ সাত মিনিট করে আনা হচ্ছিল কেন, মা গঙ্গাই জানেন। এত এত চরিত্র, অথচ শেষরক্ষা করতে সেই বারবার ইলেভেনেরই দরকার পড়ে, এ ব্যাপারটাও এবারে খানিক একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে বইকি, বাকিরা কি তবে কেবল দৌড়াদৌড়ি করে ভিড় বাড়ানোর জন্য রয়েছে? তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ভালোরকম জাতিবিদ্বেষ, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কড়া পাহারা ভেদ করে হপার যেভাবে একা পালিয়ে যায় বা ইউরির হাত থেকে প্লেন ছিনতাই করে জয়েস এবং মারে যেভাবে ক্র্যাশ ল্যান্ড করে তা সানি দেওল বা জন আব্রাহামের দেশাত্মবোধক ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। রাশিয়ানদের নোংরা স্বভাব, নির্বুদ্ধিতা, স্বার্থপরতা, অকারণ নিষ্ঠুরতা এবং কৃত্রিম অ্যাকসেন্টে ভরা সংলাপ ভারতীয় ছবিতে মিনিটে পাঁচবার করে ‘জনাব’ আওড়ানো শয়তান পাকিস্তানির থেকে কম মোটাদাগের নয়। সিরিজের প্রথম দিকে ইলেভেন এবং অন্যান্য শিশুদের উপর গবেষণার নিষ্ঠুর দিক তুলে ধরে রাষ্ট্র, বিজ্ঞান, পুলিশ প্রভৃতির ক্ষমতার অপব্যবহার সম্পর্কে বেশ জোরালো একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছিল, সিরিজের জনপ্রিয়তা বাড়ার পর সম্ভবত সেই বৈপ্লবিক রাস্তায় হাঁটা ডাফার ভাইদের সাহসে কুলোয়নি, তাই তাঁরা এবার ডঃ ব্রেনারের মধ্যে খোঁচাখুঁচি করে ভালো দিক খুঁজে বের করতে চাইছেন, ভালো পুলিশ/খারাপ পুলিশের চেনা প্যানপেনে লাইন ধরেছেন। ভালো পুলিশ ইলেভেনের ক্ষমতা ফেরাতে সাহায্য করে, তার বন্ধুদের পাহারা দিতে চায়, খারাপ পুলিশ ইলেভেনকে খতম করে দিতে চায়, তাই ইলেভেন হাত ঘুরিয়ে তাদের হেলিকপ্টার ভাঙচুর করে দেয়। যে ক্ষমতার ধাক্কায় একটা বাচ্চা মেয়ের নাক দিয়ে প্রত্যেকবার রক্ত পড়তে থাকে, সেই ক্ষমতাকে পুরোপুরি আশীর্বাদ বলে প্রমাণ করবার চেষ্টা বিতর্কিত নয় কি?
আরও পড়ুন: টিভিএফ পঞ্চায়েত : সহজ কথা সহজভাবে
তা বলে কি প্রশংসা করবার মত কিছুই নেই এই সিজনে? অবশ্যই আছে। অভিনয়ের মান বরাবরের মত এবারেও ভীষণ ভালো, স্টিভ ডাস্টিন ন্যান্সি জয়েস হপার প্রভৃতি যেসব চরিত্রদের ঠিকঠাক জায়গা দেওয়া হয়েছে, প্রত্যেক ভূমিকায় অভিনেতা অভিনেত্রীরা ফাটিয়ে কাজ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এক চরিত্র করতে থাকলে কলাকুশলীরা নিজস্ব একটা স্টাইল তৈরি করে নেন, স্ট্রেঞ্জার থিংস খুব ভালোভাবে তার সুফল ভোগ করছে। এডি মানসনের ভূমিকায় জোসেফ কুইন দারুণ স্বতঃস্ফূর্ত কাজ সবার মন জয় করে নিয়েছেন, যদিও এডির সঙ্গে ডাস্টিনের রসায়ন দেখাতে গিয়ে স্টিভের সঙ্গে তার কথোপকথন অদ্ভুতভাবে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রায় প্রত্যেক এপিসোডে যেকোনো পরিস্থিতিতে একটা করে গান গুঁজে দেওয়া বিরক্তিকর মনে হলেও কেট বুশের ‘রানিং আপ দ্যাট হিল’ গানটাকে বেশ সুন্দরভাবে কাজে লাগানো হয়েছে। ভেকনার উত্থানের কাহিনি বেশ সুন্দরভাবে পরতে পরতে বানিয়ে তোলা হয়েছে, সে যখন ম্যাক্সকে দ্বিতীয়বার আক্রমণ করে, খানিকটা হলেও আমরা ফিরে পাই প্রথমবার স্ট্রেঞ্জার থিংস দেখবার সেই টানটান উত্তেজনা। সিজন ফোরের শেষ মনে করিয়ে দেয় স্টিফেন কিংয়ের দ্য মিস্ট বইটিকে। নিজের জগতের সীমানা পেরিয়ে আপসাইড ডাউনের বিষাক্ত আবহাওয়া ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে হকিন্সে, এবারে সোজাসুজি এলাকা বাঁচানোর লড়াই। শেষ ফ্রেমে প্রধান চরিত্রদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যায়, প্রতিরোধের মূলে এবারেও সেই ইলেভেন। ডাফার ভাইদের প্রধান দক্ষতা গা ছমছমে রহস্যের আবহ নির্মাণে, অতিরিক্ত চরিত্র আর সাবপ্লটের বাহুল্য বিসর্জন দিয়ে সেই মূল সুরে ফিরে গেলে আবার অচিরেই স্বমহিমায় ফিরবে স্ট্রেঞ্জার থিংস, এমনটা আশা করাই যায়।
#stranger things season four #Duffer Brothers #netflix # science fiction #horror drama #web series