হাত ধরতে শেখার বই : জয়া মিত্রের 'চার পাঁচজন বন্ধু'
বই : চার পাঁচজন বন্ধু (গল্প সংকলন) লেখক : জয়া মিত্র প্রচ্ছদ ও অলংকরণ : শিবাজী বসু প্রকাশনা : অনুষা
আজকের ছোটরা জানে যে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি সংকটে। এই তথ্য এঁটুলির মতো লেগে আছে তাদের যাপনের গায়ে। এই নিয়েই বড়ো হচ্ছে তারা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, তথ্যের বাইরে বেরিয়ে আসল সমস্যাটা জ্যান্ত হয়ে উঠতে পারেনি তাদের কাছে। কারণ বড়দের কাছেও সমস্যাটা খুব জ্যান্ত নয় মোটেই। সত্যি বলতে কী, আজ পরিবেশ নিয়ে যতটুকু কথাবার্তা হচ্ছে তার কেন্দ্রমূলে আছে আসন্ন বিপদ আর বিলুপ্তির ভয়। এর বাইরেও যে প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে আলোচনার একটা আলাদা পরিসর ছিল, অন্তত থাকা যে সম্ভব - সেটা আজ আর মনে পড়ে না আমাদের। মনে পড়ার পরিস্থিতিও নেই। প্রকৃতির সঙ্গে বোঝাপড়া ও সহাবস্থানের দীর্ঘ ইতিহাসই যে আসলে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার ইতিহাস, তা ভুলিয়ে দেওয়ার আয়োজন অনেকদিন ধরেই হয়েছে। আমাদের বেঁচে থাকার ভরকেন্দ্র থেকে প্রকৃতি বিষয়টা বহুদিন আগেই সরে গেছে। সরে যেতে যেতে বিপন্ন প্রজাতির খাতায় নাম লিখিয়ে ফেলেছে কতশত না-মানুষ বন্ধুরা। এখন আর প্রতিবেশীদেরও খবর রাখা হয় না আমাদের। তীব্র ইন্ডিভিজুয়ালিটি আমাদের একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ করে তুলেছে। সেভাবে হাত বাড়াতে জানলেই বন্ধু পাওয়া যায়, কিন্তু হাতকে তো আমরা শুধুই বাঁ-দিকের বুকপকেট সামলাতে শিখিয়েছি, কিংবা নিজের ঘরের ছিটকিনি তুলে দিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিতে। শিশু-কিশোরদের জন্য আজ যেসব গল্প-উপন্যাস লেখা হয় তার বেশিরভাগই এই বৃত্তের বাইরে বেরোতে পারে না। জয়া মিত্রের এই বইটা কিন্তু হাত বাড়াতে শেখার এবং হাত ধরতে শেখার বই।
লেখক, পরিবেশকর্মী জয়া মিত্র যখনই ছোটদের জন্য লিখেছেন, বেঁধে-বেঁধে থাকার গল্প লিখতে চেয়েছেন। এই বইয়ের সব গল্পই তাই। বন্ধুতার গল্প। প্রকৃতিলগ্নতার গল্প। স্বাধিকারের গল্প। তেরোটা মৌলিক গল্প আর একটা অনুবাদ গল্পের সঙ্গে রয়েছে একটা নাটকও। সব মিলিয়ে এই বই ভালোবাসার কথা বলে। চড়াই পাখি, টিকটিকি, বিড়াল, প্রজাপতি সব্বাইকে জড়িয়ে নিয়ে একসঙ্গে বাঁচার কথা বলে। কালো পাখির কথা বুঝতে সমস্যা হয় না সোহেলের। দুই চড়াই-বন্ধু রিয়া আর পিয়ালের সঙ্গে চলে যায় ইস্কুলে। পারুদিদি আর মিমপাদিদির ঘরেই দিব্যি জায়গা হয়ে যায় টিকটিকির। পড়াশোনায় মন-না-বসা মহিনের দিক চেনানোর ক্ষমতা তাক লাগিয়ে দেয় জিওলজিকাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার আধিকারিকদের। তার নামই হয়ে যায় 'গ্রামের অ্যাটলাস'। চোর দুবেলা ভাত খেতে পায় না বলে চোখ ছলছল করে ছোট্ট ময়নার। এই গল্পেরা ইঁদুরদৌড়ের দর্শনের বাইরে গিয়ে দাঁড়ানোর প্ররোচনা দেয়।
এটা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমাদের পড়াশোনার মূল দর্শনটাই বস্তুবাদী, উৎপাদনকেন্দ্রিক। জাতীয় শিক্ষানীতির প্রতিটা নতুন খসড়া আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় অন্ধ-বোবা-কালা এক উপযোগবাদের দিকে। নতুন প্রজন্মের শারীরিক, মানসিক দৈন্য বা সংকীর্ণতার কারণ যদি এই সামূহিক বিযুক্তিতে না খুঁজি, তাহলে অন্যত্র খোঁজা বৃথা। মোল্লা নাসিরুদ্দীনের মতো, যেখানে সুবিধা সেখানে সমাধান খুঁজছি আমরা। ফলে যেখানে রোগ সেখানে চিকিৎসা হচ্ছে না কিছুতেই। প্রকৃতি যে-শুশ্রূষা দিতে পারে, যে-শুশ্রূষা দিতে পারে বন্ধুতা - টাকা দিয়ে তা কেনা যাবে না। 'আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে' দাঁড়াতে না পারলে কোনও রাস্তা নেই। জয়া মিত্র সহজ-সরল গল্পে সেটা মনে করান।
বইয়ের সব গল্প সমান ভালো নয়, কিন্তু সব গল্পই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের নিহিত বার্তার জন্য। সে-বার্তারা কিন্তু প্রকট হয়ে থাকে না মোটেই। আলগোছে মিশে থাকে গল্পদের শরীরে। যে-কোনও মহৎ শিশু-কিশোর সাহিত্যের মতো এ-বইও বড়দের অবশ্যপাঠ্য। ছোটদের আগে বড়রা পড়লেই ভালো। কারণ কে না জানে, আমাদের চারপাশের বড়রা ততটা বড় হয়ে উঠতে পারেনি এখনও। তবে দেড়শো পাতার এই বই আরও বড়সড় একটা কথার মুখোমুখি দাঁড় করায়। বই তো আসলে মেড-ইজি। ছাত্রবন্ধু। আসলে তো শিখতে হবে প্রকৃতি থেকে। শিখতে হবে চারপাশের জগৎ ও জীবন থেকে। এই যে-মস্ত কথাটার পাদদেশে অনেক কষ্টে, অনেক রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে তবে পৌঁছানো যায়, বড়ো সহজে তার কাছে নিয়ে যায় জয়া মিত্রের এই গল্পেরা। এ-বইকে প্রোমোট করা মেধাজীবীদের আশু কর্তব্য বলে মনে করি।
আর বইটার গুরুত্বের বিচারে যে-স্বীকৃতিকে হয়তো বামনের মতো দেখাবে, কিন্তু বইটার বিক্রি বাড়াতে সাহায্য করবে বলে আশা করা যায়, তারও উল্লেখ করে রাখি। বইটা ২০২২ সালে শিশুসাহিত্য বিভাগে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছে।
..................
#চার পাঁচজন বন্ধু #জয়া মিত্র #বই রিভিউ #Book Review #silly পয়েন্ট