ব্যক্তিত্ব

মেডিকেল কলেজ থেকে মানুষের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাড়িতে এনে রাখতেন বনফুল

বিদিশা বিশ্বাস July 19, 2022 at 8:23 pm ব্যক্তিত্ব

বাংলা সাহিত্য জগতের এক ক্ষণজন্মা প্রতিভা বনফুল তথা বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর লেখালেখির সঙ্গে সাহিত্যপ্রেমী বাঙালির পরিচয় সুবিদিত। গোটা জীবন জুড়ে অজস্র ছোটগল্প এবং উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে তিনি ছুঁয়ে গেছেন মানবমনের জটিল থেকে জটিলতর আবেগ, ফুটিয়ে তুলেছেন বিচিত্র সব চরিত্র। জীবনের চেনা ছক ভেঙে ফেলা সে সব চরিত্রের স্রষ্টা স্বয়ং যে কতটা ব্যতিক্রমী ও বিচিত্র স্বভাবের ছিলেন, বনফুলের ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন টুকরো ঘটনা তারই প্রমাণ দেয়। আদ্যন্ত বোহেমিয়ান বনফুল কোনো দিনই নির্দিষ্ট সময় ও নিয়মের ধার ধারেননি।ছাত্রজীবনে পটুয়াটোলা লেনের মেসে থাকাকালীন তাঁর এক সহপাঠী জ্বরের কবলে পড়লেন। এখন রোগীর জন্য তো ঠিকমত আহারের ব্যবস্থা করতে হবে।এদিকে মেসের খাবার সুস্থ মানুষেরই মুখে তোলের যোগ্য নয়। এমন খাবার কীভাবে রোগীকে খাওয়ানো হবে? ত্রাতার ভূমিকায় নেমে পড়লেন বনফুল। একটা থালা জোগাড় করে ঝড়ের গতিতে মেস থেকে বেরিয়ে হনহন করে হাঁটা লাগালেন। সবাই তখনো বুঝতে পারছে না ঠিক কী হতে চলেছে। অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তিনি যখন ফিরলেন তখন থালা ভর্তি দারুণ দারুণ সব খাবার। পরে জানা গেল বনফুল থালা নিয়ে বেরিয়ে এক অপরিচিতের বাড়িতে ঢুকে ভাত তরকারি চেয়ে নিয়ে এসেছেন অসুস্থ বন্ধুর জন্য। এমনই খেয়ালী ও বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন।

ডাক্তারি পড়াকালীন মির্জাপুর স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থলে ইন্টারন্যাশনাল বোর্ডিং এ থাকতেন বনফুল। এই বোর্ডিং এরই এক বন্ধু তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে চিঠি লিখতে লিখতে অন্য কোনো দরকারে বেরিয়ে গেছেন। আর সেই অসমাপ্ত চিঠির উপর নজর পড়ল বনফুলের। হাতের লেখা নকল করে সে চিঠি সমাপ্ত হল। এমনকি বনফুল স্বয়ং চাকরের বেশ ধরে হাঁটুর উপর কাপড় তুলে, ফতুয়া গায়ে, খালি পায়ে সে চিঠি পৌঁছে দিয়ে এলেন সেই বন্ধুর শ্বশুরবাড়ি। চিঠি পাওয়ার পর থেকে দফায় দফায় লোক আসতে শুরু হল বোর্ডিং-এ, দাবি জামাইকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হবে। শেষে সেই বন্ধুর শ্বশুরমশাই পর্যন্ত এসে হাজির। আসলে হাতের লেখা নকল করে বনফুল বন্ধুর স্ত্রীর উদ্দেশ্যে চিঠিতে লিখেছিলেন - "সে যা হোক, আমি তোমাদের বাড়িতে যেতে চাই কিন্তু যেচে যেতে বড় লজ্জা হয়। তোমরা যদি ওখান থেকে যেতে লেখ তা হলেই যেতে পারি। ইতি-" বন্ধুর সঙ্গে এহেন ভয়ানক কৌতুক বনফুলই করতে পারতেন।

এই ইন্টারন্যাশনাল বোর্ডিং এই বনফুলের সঙ্গে একই ঘরে থাকতেন তাঁর এক দূরসম্পর্কীয় ভাই। এই ভাইটি পড়তেন মেডিক্যাল স্কুলে। তার পড়ার সুবিধার জন্য বনফুল মেডিক্যাল কলেজ থেকে মানুষের মগজ, ফুসফুস, হৃদপিণ্ড প্রভৃতি সংগ্রহ করে এনে মাটির হাঁড়িতে ফর্মালিনে ডুবিয়ে রাখতেন। হাঁড়িগুলো থাকত তক্তাপোষের নিচে। আর তার ঠিক পাশেই কুকারে প্রায়ই রান্না হত পাঁঠার মাংস। এমনকি দেহের কাটা অংশগুলো ফর্মালিনে পুরোপুরি না ডুবলে, মাঝে মধ্যেই পচে ভয়ানক দুর্গন্ধে ঘর ভরে যেত। অথচ তারই মধ্যে নির্বিকার চিত্তে বনফুল নিজের কাজ করে যেতেন।

একবার এক মেয়ের বাবা বনফলের কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। অসম্মতি প্রকাশের পরও ভদ্রলোক মেয়ে দেখেতে যাওয়ার জন্য জোর করতে থাকলে বনফুল বলেন- "বিয়ে করতে চাইলে কনের নাক ক’-ইঞ্চি বা চামড়া কেমন তা কখনো দেখব না। দেখি তো ব্লাড স্পিউটাম ইউরিন রিপোর্ট দেখব। বিয়েতে আমার ন্যূনতম শর্ত থাকবে এই যে প্রথমত সে একটি মেয়ে হবে, দ্বিতীয়ত ম্যাট্রিকুলেশন পাশ হবে, এ ভিন্ন চামড়ার রঙে বা নাক মুখের মাপে আমার ইন্টারেস্ট নেই।" এমনই স্পষ্টভাষী মানুষ ছিলেন বনফুল। খামখেয়ালিপনা আর ছেলেমানুষি ছিল তাঁর আজীবনের সঙ্গী। কখনো দিনের পর দিন নাওয়া খাওয়া নেই, গায়ের জামা ছেঁড়া, মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ- কোনো কিছুরই পরোয়া করেননি কোনোদিন। ব্যক্তিজীবনের প্রাত্যহিকতা হোক বা লেখার খাতা- সর্বত্রই এক অদ্ভুত সাবলীল চলন তাঁর। আর ঠিক এখানেই বনফুল বাকি সবার থেকে স্বতন্ত্র। 

.................. 

ঋণ : স্মৃতিচিত্রণ, পরিমল গোস্বামী

#বনফুল #বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

22

Unique Visitors

215889