নাটক

বডি (দ্বিতীয় কিস্তি)

রোহন রায় April 21, 2023 at 7:29 pm নাটক

.........................

দ্বিতীয় কিস্তি 

..................... 

(প্রথম কিস্তির পর) 


প্রীতম।। তোমার মতলবটা কী বলো তো! 

কালু ।। টর্চটা হাতে নিচ্ছেন কেন? আরে আমার কোনও মতলব নেই! বিশ্বাস করুন! আমি শুধু আমার বডিটা খুঁজছি। 

প্রীতম।। আমার মাথার জায়গায় পাছা নয় যে, যা-খুশি বলবে আর বিশ্বাস করে নেব। সাতসকালে চোরের মতো ঘরে ঢুকেছ চ্যাংড়ামি করতে? কোন আহাম্মক সাতসকালে ঘরে ঢুকে ভূতের গল্প ফাঁদে? 

কালু ।। আমি চ্যাংড়ামি করছি না স্যার। আমার বডিটা সত্যি হারিয়ে গেছে। সেটা না পেলে খুব মুশকিল। ছেলের হাতের জল না পেলে স্বর্গে যেতে পারব না। আপনি আমার সমস্যাটা বুঝতে পারছেন না। 

প্রীতম।। তুমি বুঝতে পারছ না। আমায় ভয় দেখানোর চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। আমি বিচ্ছিরিরকমের শক্ত ধাতের লোক। 

কালু ।। আপনি কেমন লোক সে আমি হাড়ে-হাড়েই জানি স্যার। 

প্রীতম।। জানো? বাঃ! তাহলে খামোখা আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ কেন? জানো তো পণ্ডশ্রম।

কালু ।। আমার তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আপনাকে ভয় দেখাতে যাব। আমি মরছি নিজের জ্বালায়। উফফ! মাঝখানে ঘুমিয়ে পড়েই এই কেলোটা হল। পেটে খাবার পড়লেই আমার এত ঘুম পায়, কী বলব। বলে না স্বভাব যায় না ম’লে! আমার হয়েছে সেই অবস্থা। আর আপনার ঘরটাও এত ঠান্ডা! 

প্রীতম (হেসে)।। তাহলে তুমি বলার চেষ্টা করছ তুমি ভূত? 

কালু ।। আমি কিছুই বলার চেষ্টা করছি না স্যার। ভূত কি ভূত নই, তা দিয়ে আমার কিচ্ছু এসে যায় না। মরে গেছি, এটুকু বুঝতে পারছি। সে ভালোই হয়েছে মরে গেছি। আমার খুব একটা দুঃখ হচ্ছে না। বাড়িতে রাতদিন কী অশান্তি হত স্যার কী বলব! বউটা এত দজ্জাল। একটা ভালোমন্দ কথা বলার উপায় নেই, থালা-বাটি ছুড়বে। ভালো হয়েছে মরে গেছি। তোকে বিধবা করে দিয়েছি। আর মাছ-মাংস কিচ্ছু খেতে পারবি না। এবার বোঝ কেমন জব্দ! ওরকম করে কী দেখছেন স্যার? 

প্রীতম।। তোমাকে দেখছি।

কালু ।। আমাকে দেখার কী আছে? আমি কি তাজমহল না ঐশ্বর্য রাই? 

প্রীতম ।। কোনোদিন ভূত দেখিনি কিনা। তাই ভালো করে দেখে নিচ্ছি। 

কালু ।। সায়েবসুবোদের ব্যাপারস্যাপার সত্যিই বোঝা দায়। বলি, ভূত কি একটা দেখার জিনিস হল? 

প্রীতম।। দেখার জিনিস নয়? বলো কী? পৃথিবীতে কটা লোকের ভূত দেখার সৌভাগ্য হয়েছে? আর দেখলেও, এভাবে ভূতের সঙ্গে বসে খোশগল্প করার সৌভাগ্য কজনের হয়েছে বলো? 

কালু ।। হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে ভূতেদের লোকে কেন এত অপছন্দ করে, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। ভূত আর ভগবানের মধ্যে কিন্তু খুব সামান্যই তফাত। ভূত হয়ে আরও বেশি করে বুঝতে পারছি সেটা। 

প্রীতম।। সামান্য তফাত? 

কালু ।। হ্যাঁ, আপনি কোন দলে খেলছেন সেটাই শুধু তফাত। তা ছাড়া কাজ বলতে তো কিছু নেই সেরকম। হাওয়ার শরীর নিয়ে উড়ে উড়ে বেড়ানো শুধু। আর কী কাজ? 

প্রীতম।। কালু, আমার মনে হয় তুমি একজন ছদ্মবেশী দার্শনিক। 

কালু ।। কী যে বলেন স্যার! আমি দার্শনিক হতে যাব কেন? সারাদিন গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ইন্টুমিন্টু ভাবলে আমার চলবে? গতর খাটিয়ে খেতে হয় স্যার। আমি কারখানার লেবার। 

প্রীতম ।। তোমার কথাবার্তা শুনে কিন্তু লেবার ক্লাস বলে মনে হয় না। 

কালু ।। কপাল স্যার। আর কী বলব। ইংরিজি অনার্স নিয়ে ভরতি হয়েছিলাম। লেখাপড়ায় একেবারে হ্যাক-ছি ছিলাম না। বাবা পুরোটা টানতে পারল না। বলল, রোজগার কর। সেকেন্ড ইয়ারে উঠে পড়া ছেড়ে দিলাম। 

প্রীতম ।। তোমার মাইনে কত, কালু? হাজার সাত-আটেক হবে? 

কালু ।। তারও নিচে স্যার।

প্রীতম।। তারও নিচে? চলে?

কালু ।। চলে যায় স্যার। রোজগারের মাপে-মাপে জীবনটাকে ছকে নিলে চলে যায়। বউ সেলাইয়ের কাজ-টাজ করে, শাড়িতে ফলস পিকো করে। তাতেও কিছুমিছু হয়ে যায়। চলে যায়। তবে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার খরচটাই যা একটু ভাবাচ্ছে। বড় হচ্ছে তো, খরচাও বাড়ছে। আমি তো মরে গেলাম। এরপর চলবে কী করে কে জানে। পুজোর মাসে ভাবলাম বোনাস পাব। তাও পেলাম না। তাই নিয়ে বউ কত কথা শোনাল। এক পয়সার মুরোদ নেই, বিয়ে করেছিলে কেন? কথাটা সত্যি স্যার। কিন্তু যার পয়সা নেই, তার বিয়ে করতে ইচ্ছে করে না বলুন? তবে কিনা ওই মুরোদ কথাটা খুব বিচ্ছিরি। শুনলেই কেমন মাথায় খুন চেপে যায়। মুরোদ কথাটা আমি একদম সহ্য করতে পারি না স্যার। 

প্রীতম।। দেখো, ভূত হয়ে বউকে খুন করে ফেলো না যেন। 

কালু ।। না না। তা কেউ করে? বউরা তো কথা শোনাবেই স্যার। বউ জাতটাই ওরকম। যেমন সাপটে কথা শোনায়, তেমন জাপটে ভালোবাসে। এখন কেমন কাঁদছে দেখুন। মনটা একটু একটু খারাপই লাগছে স্যার, মিথ্যে বলব না। বউটার বড্ড চোপা, কিন্তু মনটা ভালো। এখন বিধবা হয়ে গেল, মাছ মাংস খেতে পারবে না। (প্রীতম একটা সিগারেট ধরাতে যায়, কালু আঁতকে লাফিয়ে ওঠে) স্যার, স্যার, সিগারেট ধরাবেন না! সিগারেট ধরাবেন না! 

প্রীতম।। কেন? 

কালু ।। ভূতেরা আগুন সহ্য করতে পারে না স্যার। সিনেমায় দেখেননি?

প্রীতম ।। আই সি! (সিগারেট পকেটে রেখে দেয়)। আচ্ছা কালু, একটা কথা বলো তো, ভূতেরা তো যতদূর শুনেছি রাত্তিরবেলাতেই আসে, তা তুমি ভোরের আলোয় কী করে এলে? 

কালু ।। সে যারা ভয় দেখায় তারা রাত্তিরবেলা আসে। আমি তো ভয় দেখাতে আসিনি স্যার। আমি শুধু বডিটা খুঁজতে এসেছি। আর তা ছাড়া আমি তো রাত্তিরবেলাই এসেছিলাম। বেরোতে বেরোতে একটু লেট হয়ে গেল।  

প্রীতম।। তা বাবা কালু, তুমি যদি ভূতই হও, তাহলে জানলার শিক কেটে ঢুকলে কেন বাবা? তোমাদের তো সূক্ষ্ম শরীর। 

কালু ।। এই দেখেছেন! কী কাণ্ড! ভুলেই গেছি! আসলে সদ্য-সদ্য ভূত হয়েছি কিনা! তাই সবসময় খেয়াল থাকছে না। এই দেখুন না, মরে গেছি মনে থাকলে কি আর দোকানে গিয়ে ছেলেমেয়ের জন্য জামা কিনতাম? মাথার মধ্যে ঘুরছে বডিটা হারিয়ে গেছে, তবু মনে থাকছে না যে মরে গেছি। ভাবুন কীরকম বেখেয়ালে লোক। আসলে ওই বডির টেনশনেই…। 

প্রীতম ।। জানলার শিক কেটে ঘরে ঢুকেছ। ঢুকে ফ্রিজ খুলে খেয়েছ। খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ। এখন বলছ বডি খুঁজতে এসেছ। বাবা কালু, আমার কপালে কি চার-অক্ষর লেখা আছে? 

কালু (ভালো করে দেখে) ।। কই, না তো! 

প্রীতম (প্রচণ্ড চেঁচিয়ে)।। তাহলে এই সাতসকালে আমার ঘরে ঢুকে আমড়াগাছি মারাচ্ছ কেন? ক-পাত্তর পড়েছে পেটে? 

কালু ।। আমি মাতাল নই স্যার। চোরও নই। বিশ্বাস করুন, আমি শুধু আমার বডিটা খুঁজতে এসেছি। পেলেই চলে যাব। 

প্রীতম।। বডি খুঁজতে এসেছ! ঢ্যামনামোর আর জায়গা পাওনি! পাছায় দুই লাথি মেরে বের করে দেব। ভালো চাও তো এখনই বেরিয়ে যাও। ওই জানলা দিয়েই বেরিয়ে যাও। 

কালু ।। সরি স্যার, বডি না নিয়ে তো যেতে পারব না। মাপ করবেন। মনসুর বড়সাহেবের বাড়ি গেছে, আর রতন গেছে সেনসাহেবের বাড়ি। আমার ভাগে আপনার বাড়িটা পড়েছে। বডি না নিয়ে যেতে পারব না। 

প্রীতম (ভীষণ চমকে)।। কী নাম বললে? মনসুর? রতন? 

কালু ।। হ্যাঁ স্যার, মনসুর আলি আর রতন ঘোষ। ওদের বডিগুলোও লাগবে। ওগুলোও হারিয়ে গেছে। মোট তিনটে বডি। তবে ওদেরটা ওদের দায়িত্ব। আমি শুধু আমারটাই নিয়ে যাব। সঙ্গে ওদেরটা পেলে ওদের খবর দিয়ে দেব, ওরা এসে নিয়ে যাবে। তিনটে বডি আমি কী করে নেব বলুন স্যার! বেশি ওজন তুললে কোমরে আজকাল খ্যাঁচ লেগে যায়। বয়েস হচ্ছে তো! 

প্রীতম ।। ওরা কোথায় গেছে বললে? বড়সাহেব আর সেনসাহেবের বাড়ি? 

কালু ।। হ্যাঁ। মনসুর বড়সাহেবের বাড়ি, রতন সেনসাহেবের বাড়ি। 

প্রীতম।। বডিগুলো আমাদের বাড়িতে খুঁজছ কেন? 

কালু ।। বা রে! আপনারা তিনজনে মিলেই তো সব করলেন! তো আপনাদেরই কারোর বাড়িতে থাকবে বডিগুলো। 

প্রীতম।। তুমি কে? 

কালু ।। আমি কালু। বললাম যে। 

প্রীতম।। পুরো নাম বলো! 

কালু ।। কালীপদ ধাড়া। 

প্রীতম।। লরেল অ্যান্ড জেনকিন্স কোম্পানির কালীপদ ধাড়া?

কালু ।। হ্যাঁ স্যার। 

প্রীতম।। যে পাঁচদিন আগে দুর্ঘটনায় মারা গেছে? 

কালু ।। একদম ঠিক স্যার। 

প্রীতম।। তার মানে আমি হচ্ছি তোমার মেজোসাহেব? 

কালু (মুচকি হেসে) ।। এই তো স্যার, জলের মতো বুঝতে পেরেছেন ব্যাপারটা। (প্রীতম উচ্চস্বরে হাসতে থাকে)। স্যার, হাসছেন কেন? ও স্যার, বডিগুলো কোথায় রেখেছেন বলুন না! 

প্রীতম।। তোমাদের বডি কোথায়, সেটা আমি কী করে জানব কালীপদ?

কালু ।। ও মা! আপনি না জানলে কে জানবে? নিউজ চ্যানেলের দাদা-দিদিদের সামনে আপনি যে বললেন, কেউ মারা যায়নি! ওই নামে আমাদের কোনও কর্মী ছিল না! তা সেটা তো আর সত্যি কথা নয়। আপনিও জানেন, বড়সাহেবও জানেন, সেন সাহেবও জানেন। আমার এগারো বছরের চাকরি স্যার। হ্যাঁ, আপনি কর্তা মানুষ, আপনি আমাকে মুখ দেখে তো চিনবেন না। কিন্তু কালীপদ ধাড়া যে আপনাদের কোম্পানির লেদ ডিপার্টমেন্টে সাত বছর ধরে কাজ করে, সেটা তো একেবারে কাগজে-কলমে সত্যি। 

প্রীতম।। ভুল করেছিলাম। চোর নও। তুমি ব্ল্যাকমেল করতে এসেছ। 

কালু ।। ব্ল্যাকমেল? না না! 

প্রীতম।। তাহলে তুমিই হচ্ছ প্রয়াত কালীপদ ধাড়া? মানে কালীপদ ধাড়ার ভূত? বেশ। কিন্তু কী করে বিশ্বাস করব? আধার কার্ড দেখাও। 

কালু ।। মরে যাবার পরেও আধার কার্ড লাগবে বুঝতে পারিনি স্যার। তাহলে নিয়ে রাখতাম।

প্রীতম ।। কেন, তুমি তো ভূত! উড়ে গিয়ে নিয়ে এসো! 

কালু ।। প্লিজ স্যার, ইয়ার্কি মারবেন না। মানুষের বডি নিয়ে ইয়ার্কি মারতে আছে?   

প্রীতম।। একটুও ইয়ার্কি মারছি না। মিঃ কালীপদ ধাড়া, আপনার মেজোবাবু আপনাকে হুকুম দিচ্ছে, আপনি এখনই উড়ে গিয়ে আধার কার্ড নিয়ে আসুন। না হলে বডি ছাড়ব না। 

কালু ।। তাহলে আপনি জানেন, বডি কোথায়? 

প্রীতম।। ইয়েস! জানি! 

কালু ।। কোথায় স্যার? বলুন না! 

প্রীতম।। বলছি তো আধার কার্ড নিয়ে এসো। তারপর বলব।

কালু ।। স্যার, প্লিজ। বডিটা দিয়ে দিন স্যার। আপনার পায়ে ধরছি। 

প্রীতম (গর্জন করে)।। এনাফ! অনেক বেয়াড়াপনা সহ্য করেছি! জোচ্চোর একটা! আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিস, তাই না? আমার আগেই বোঝা উচিত ছিল, তুই আমাকে ব্ল্যাকমেল করতে এসেছিস। (মুখ বেঁকিয়ে) কালীপদ ধাড়া? তাই না? চারদিন আগে মরে ভূত হয়ে যাওয়া কালীপদ ধাড়া? বেশ! মেনে নিচ্ছি তুই কালীপদ ধাড়া! যা! উড়ে গিয়ে নিজের আধার কার্ডটা নিয়ে আয়! যা! নিয়ে আয়! (বিছানার তলা থেকে টেনে বের করে রিভলভার) নিয়ে আয়! না উড়তে পারলে কিন্তু আমি গুলি করব! 

কালু ।। স্যার, কেন এরকম করছেন? আমি তো বডিটা পেলেই চলে যাব। আমি কি আপনার কোনও ক্ষতি করেছি বলুন? 

প্রীতম।। ওড়! না হলে গুলি করব! তুই অনেক কিছু জেনে ফেলেছিস! 

কালু (কাতর গলায়)।। আমরা তো আপনাদের কথা মেনেই নিয়েছি। আপনাদের কথাই সত্যি। আমরা আপনাদের কোম্পানিতে কাজ করতাম না। কালীপদ ধাড়া নামে কেউ কোনোদিন কোথাও ছিলই না, মনসুর আলি বলে কেউ ছিল না, রতন ঘোষ নামে কেউ ছিল না, বলছি তো। আমরা জন্মাইইনি কোনোদিন। তাই আমরা মরিওনি। সেদিন কিচ্ছু ঘটেনি। কোনও অ্যাক্সিডেন্ট ঘটেনি। আপনারা যা বলেছেন সব সত্যি। আমাদের বাড়ির লোকেরা মিথ্যে বলছে স্যার। অভাবী লোক তো, টাকার লোভে মিথ্যে বলছে। সব মেনে নিচ্ছি স্যার। আপনাদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও অভিযোগ নেই। শুধু আমাদের বডিগুলো ফিরিয়ে দিন স্যার। পায়ে ধরছি আপনার। একে অপঘাতে মরেছি, এরপর যদি দাহটাও না হয় তাহলে স্বর্গে যাব কী করে বলুন তো? 

প্রীতম ।। কী ভেবেছিস? ভূতের গল্প ফাঁদলেই ভয় পেয়ে যাব? ব্ল্যাকমেল করা ঘুচিয়ে দেব তোর! কে তুই? নাম কী তোর? লেবার ইউনিয়নের কেউ? 

কালু ।। না স্যার। লেবার ইউনিয়নের কেউ জানে নাকি? হেমন্তদা আর অজু বাদে কেউ তো দেখেনি। ওদের মুখ তো আপনারা টাকা দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছেন। 

প্রীতম।। তাহলে তুই জানলি কোত্থেকে? বল!

কালু ।। কী বলব বলুন? বললে তো আপনি বিশ্বাস করছেন না। 

প্রীতম।। উড়ে দেখা। না হলে গুলি করব। মরা মানুষের পার্ট করার খুব শখ তো? কালীপদ ধাড়া হবার খুব শখ? অ্যাঁ? চল, উড়ে দেখা। কাম অন বেবি! ফ্লাই! (এগিয়ে গিয়ে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে) ওড়! না হলে তোকে সত্যি সত্যিই কালীপদ ধাড়ার কাছে পাঠাব!

কালু ।। স্যার, একবার শুধু বলে দিন বডিগুলো কোথায় রেখেছেন। তারপর যা খুশি করুন। দুনিয়া থেকে রবার দিয়ে আমাকে মুছে দিয়েছেন, আমি কিছু বলেছি বলুন? বউ কাঁদছে, ছেলেমেয়ে কাঁদছে, আমি তা-ও কিছু বলেছি? বলছি তো, মরে গেছি বলে আমার বিশেষ দুঃখ নেই। দিনরাত অত গঞ্জনা! আমার ঘেন্না ধরে গেছিল। এখন মরে গেছি বলে কাঁদছে। একটু একটু মন খারাপ লাগছে। বউরা তো একটু কথা শোনাবেই বলুন, তা বলে কি ভালোও বাসে না? মিথ্যে বলব না, এখন একটু একটু মন খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি কি আপনাকে কোনও দোষ দিয়েছি বলুন স্যার? সত্যিই তো, আমরা তো মরেইছি। এরপর আপনারা যদি স্বীকার করেন, যথেষ্ট সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখেননি বলেই বিষাক্ত গ্যাস বেরিয়ে আমরা মরে গেছি, তাহলে তো আপনারাও ফাঁসিতে ঝুলবেন। বুঝি স্যার, বুঝি। আমাদেরও বউ বাচ্চা নিয়ে সংসার। বুঝি। ভালোই করেছেন বলেছেন, কালীপদ ধাড়া বলে কেউ নেই, রতন ঘোষ বলে কেউ নেই, মনসুর আলি বলে কেউ নেই। আমরা তো কোনও কিছু নিয়েই আপত্তি করছি না স্যার। শুধু আমাদের বডিগুলো দিয়ে দিন। প্লিজ স্যার। 

প্রীতম ।। তুমি যে-ই হও, স্বীকার করতেই হয়, তুমি খুব উঁচুদরের শিল্পী। 

কালু ।। আমি শিল্পী নই স্যার, আমি কালীপদ ধাড়া। আমি আমার বডিটা ফেরত চাই। 

প্রীতম।। অনেক নৌটঙ্কি হয়েছে। চল ওঠ। উঠে দাঁড়া। তোর বডিরও হদিশ পাবে না কেউ। মেরে পুঁতে দেব শালা! 

কালু ।। মরা মানুষকে কবার মারবেন স্যার? বলে দিন না কোথায় রেখেছেন বডিগুলো? 

প্রীতম।। ওই খাটের তলায় রেখেছি। এবার তোকেও মেরে ওখানেই রাখব। শালা! বহুত জ্বালিয়েছিস! 

কালু ।। খাটের তলায়? (হাসে) 

প্রীতম।। হাসছিস কেন? 

কালু ।। কেন ফাজলামি করছেন স্যার? বডি নিয়ে ফাজলামি করতে আছে? 

(হঠাৎ দরজায় প্রবল জোরে একটা ধাক্কা)। 

প্রীতম।। কে? (কোনও উত্তর নেই। ভারী কিছু দিয়ে দরজায় ধাক্কা দেওয়া হচ্ছে। বাড়ি কেঁপে উঠল)। কী মুশকিল! কে? 

কালু ।। দরজা ভাঙছে। 

[নেপথ্যে কাদের গলা শোনা গেল - “আরও জোরে মারো!”]

প্রীতম।। দরজা ভাঙছে? কে? দেখি! (প্রীতম দরজার দিকে এগোয়। তার আগেই আবার বিকট শব্দ। কেঁপে ওঠে প্রীতম। দরজা ভেঙে যায়। ভিতরে ঢুকে আসেন থানার ইন্সপেক্টর, একজন কনস্টেবল আর প্রীতমের স্ত্রী বিপাশা। বিপাশা কাঁদছে)। 

প্রীতম।। এ কী! বিপাশা! কী ব্যাপার! (বিপাশা প্রীতমকে দেখতে পায় না। কাঁদতে কাঁদতে এদিক-ওদিক দ‍্যাখে)। 

ইন্সপেক্টর ।। সার্চ করো! সব ভালো করে সার্চ করো! (কনস্টেবলরা সার্চ করতে থাকে)। মিসেস বিশ্বাস, আপনি শিওর ওঁদের বিজনেসে রিসেন্ট কোনও সমস্যা দেখা দেয়নি? 

প্রীতম।। এসব কী ব্যাপার ইন্সপেক্টর! (কেউই প্রীতমকে দেখতে পায় না)। বিপাশা কাঁদছ কেন? কী হয়েছে? আরে! তোমরা কেউ আমার সঙ্গে কথা বলছ না কেন? 

কনস্টেবল ১ ।। স্যার, এখানে! খাটের তলায়! (কালু বাদে সবাই ছুটে যায়। বিপাশা হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। প্রীতমের চোখ বিস্ফারিত)। 

ইন্সপেক্টর।। শিট! এ তো রাইগর মরটিস সেট করে গেছে!

কনস্টেবল।। কারখানার তিনজন টপ অফিশিয়ালের এভাবে একসঙ্গে মৃত্যু...। 

ইন্সপেক্টর।। ভেরি সাসপিশাস! নিশিকান্ত, বডিটা পোস্টমর্টেমে পাঠাও। 

(দুজন কনস্টেবল মিলে প্রীতমের লাশ টেনে বের করে খাটের তলা থেকে। সাসপেন্স মিউজিক শুরু হয় ঢিমেতালে)। 

প্রীতম।। এটা কী হয়েছে? অ্যাঁ? কী করে হল? (কালুর কলার ধরে ঝাঁকায়) তুমি খুন করেছো আমাকে? খুন করেছ?  

কালু (হাসে)।। আমি খুন করিনি স্যার। আপনার কৃতকর্মই আপনাকে খুন করেছে। ওই যাকে ভালো বাংলায় নিয়তি বলে। আমি নিমিত্ত মাত্র। 

প্রীতম (উন্মাদের মতো ছুটে যায় বিপাশার কাছে)।। বিপাশা! এই দ্যাখো আমি! এই তো আমি! আমাকে দেখতে পাচ্ছ না কেন? তোমরা কেউ আমায় দেখতে পাচ্ছ না কেন? 

কনস্টেবল ১।। স্যার, মাথার পেছনে ভারী কিছু একটা দিয়ে মেরেছে। ভারী, ভোঁতা কিছু। 

ইন্সপেক্টর ।। ঠিক একইরকম উন্ড মিঃ সরকার আর মিঃ সেনের মাথার পিছনেও আছে। তার মানে যা আন্দাজ করছিলাম, তাই। ইটস আ প্রি-প্ল্যানড মার্ডার! 

কনস্টেবল ২ ।। স্যার, জানলার দুটো শিক কাটা। (ইন্সপেক্টর ছুটে যান সেদিকে। প্রীতম পাগলের মতো টাল খায় সারা ঘরে)। 

কালু।। দেখুন, আমি চাইলেই তো আপনার বডি হাপিস করে দিতে পারতাম। পারতাম না, বলুন? কিন্তু করেছি কি? বুঝি স্যার, আমারও তো বউ-বাচ্চা নিয়ে সংসার। সব বুঝি। বডি-ফডি নিয়ে আমাদের একটা সেন্টিমেন্ট থাকে। বডি দাহ না করলে কি চলে বলুন তো? (প্রীতম অসহায়ের মতো আর্তনাদ করে। কালু হাসে)। বেশি জোরে মারিনি স্যার। বিশ্বাস করুন। আমি যেভাবে কষ্ট পেয়ে মরেছি, তার তুলনায় কিছু না। গ্যাসে দম আটকে মরার চেয়ে এটা কত ভালো বলুন তো? মেরেছি আর ভ্যাট করে মরে গেছেন। আপনি একদম টের পাননি, না? বললাম না, গুলিয়ে যায়! বেঁচে আছি না মরে গেছি গুলিয়ে যায়! প্রথম-প্রথম আপনারও হবে। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। চিন্তা করবেন না। এবার প্লিজ বলুন স্যার, বডিটা কোথায় রেখেছেন? (প্রীতম উন্মাদের মতো মাথার চুল ছিঁড়ছে। ছায়ার মতো মনসুর আর রতন এসে দাঁড়ায় কালুর পাশে। কালু ওদের দুজনের দিকে তাকায়) কিছুতেই বলছে না শালা! মরে গিয়েও একইরকম ঢ্যামনা থেকে গেছে। (আবার প্রীতমের দিকে ফেরে) ও স্যার! বলুন না! দাহ না করলে আমি তো এখান থেকে যেতে পারছি না। ও স্যার! 

[মিউজিক বেড়ে ওঠে। পর্দা পড়ে]। 

............................

আগের কিস্তি পড়ুন : বডি (প্রথম কিস্তি)  



........................  


[অলংকরণ : বিবস্বান দত্ত] 


#নাটক #Bengali Play #silly পয়েন্ট #Bengali Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

24

Unique Visitors

215796