মুক্তগদ্য

ব্লাইন্ড ডেট

বিতান ঘোষ Feb 22, 2023 at 5:56 am মুক্তগদ্য

......................

[এক]

একজনের কাছে পৌঁছতে গিয়ে বারবার অনেকের কাছে পৌঁছে গিয়েছি আমি। নানান সংলাপে-অভিজ্ঞতায় বহুধা হতে চেয়েছি। হয়েওছি খানিক। তবে এই বহুমাত্রিক যাত্রাপথে বারবার একমাত্রিক এক ক্লান্তিই ফিরে ফিরে এসেছে। অসংখ্যের মধ্যে যে-বিশেষ সংখ্যাটিকে খুঁজে চলেছি, তার ঠিকানায় অনেকগুলো লেটারবক্স ঝুলছে। একই নামের আলাদা আলাদা পদবীতে। চিঠির অক্ষরে সন্তর্পণে টপকেছি নিজের চৌকাঠ, সতর্কে পেরিয়েছি অচেনা পথ, তবু সেই চিঠি খুঁজে নিতে পারেনি সঠিক ঠিকানা। তাই একবার শুধু পথ চলার আনন্দেই দল বেঁধে পাহাড়ে ট্রেক করতে বেড়িয়েছিলাম। কোনও এক পান্থশালায় রাত্রিবাস করতে এসে কেউ কেউ সেখানেই থেকে যায় দলছুট হয়ে। খুঁজে পায় পথ চলার আর আবিষ্কারের নতুন মাধ্যম। বাকিরা চলে যায় যে যার গন্তব্যে।

সেখানে হঠাৎ তোমায় ঘুমোতে দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। তোমার সঙ্গে বহু বহু কথোপকথনেও তোমার কাছে পৌঁছতে পারিনি, তোমার বন্ধ চোখের সুস্পষ্ট ভাষা হঠাৎ তোমার সেই স্মৃতির পাড়ে বসিয়ে দেয় আমায়। জলের দিকে তাকিয়ে, আমার ইচ্ছের প্রতিচ্ছবিকে গাছের ছায়ার মত কাঁপতে দেখে থম মেরে বসে থাকি আমি। তোমার অ্যাক্টিভ অ্যাবসেন্সের গভীরে একটা ঢিল মারতে গিয়ে প্যাসিভ প্রেসেন্সের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে জলে। প্রতিবার জল শান্ত হয়ে সেই তরঙ্গ থামার আগেই আমি একটা পর একটা নুড়ি ছুড়ে যাই - সযত্নে বুকপকেটে জমানো পাথর ভেঙে ভেঙে, আরো বেশি করে তোমার উপস্থিতিকে ফিরে পেতে চেয়ে। তুমিও জানো, জলের সেই তরঙ্গকে আসলে আমি শান্ত হতে দিই না। নিজের অনুভূতির প্রতিচ্ছবি দেখতে চাই না বলেই।


ব্যথার চৌকাঠ সন্তর্পণে পেরোতে পেরোতে হঠাৎ এক নির্জন, ধূ ধূ  প্রান্তরে এসে পড়েছি। কিছু আঘাত এতই আপন, যার অভাব ক্ষতের বদলে শূন্যস্থান ফিরিয়ে দেয়। যাতে অক্ষত থাকার বোধ আছে, শুশ্রূষা নেই। ভালোবাসার স্রোতে সমস্ত পিছুটানের শ্যাওলা ধুয়ে মুছে যাবে ভাবতাম। কিন্তু সম্পর্কের ডুবুরির মত না ভেসে তা আটকে রইল ভূমিকার নোঙরের মতো। পিছুটানও হয়তো অনুকুল স্রোতের বিপ্রতীপে অবস্থান করা এক প্রতিকূল স্রোতের মতোই। অপ্রাপ্তির অন্ধকার টানেলে যাতায়াত ক’রে ব্যথার মোড়কে যে প্রজ্ঞার লজেন্স ফিরে পাই, তাতে প্রাপ্তির স্বাদই ফিরে ফিরে আসে। তাই এখন কারও থেকে আঘাত পেলে আগেই চোখে পড়ে যায় তার নিজের ক্ষতস্থান। দেখি কীভাবে অপ্রাপ্তির বোধ শাসন করে চলেছে প্রাপ্তির উপলব্ধিকে, যেভাবে মৃত্যু শাসন করে চলে জীবন। তোমার প্রতিটা প্রশ্নে আসলে লুকিয়ে থাকত সুনির্দিষ্ট অভিযোগ। বুঝতাম, প্রশ্ন করে জানতে নয়, জানাতে চেয়েছ বারবার। আজ বুঝি, আমাদের প্রতিটা সিম্পটমই আদতে আমাদের মধ্যে দিয়ে কিছু বলতে চাইত। কিছু আপাত জটিলতা অনেক সময় একেবারে সাদামাটা সরল উত্তরের কাছেও আমাদের পৌঁছে দেয়। সেই ডাকনাম শুনে, হঠাৎ পিছু ফিরে কাউকে দেখতে পাও না তুমি। সরবতের ঘোলাটে ভাব স্পষ্ট হওয়ার আগেই তার অতলে চামচ নাড়িয়ে অজান্তেই ভুলে যেতে চাও সেই সম্বোধন। 


বহু দূরে শহরের কোলাহলে, কোনো এক ক্যাফেতে, তখন ঝুপ করে সন্ধে নামে।


[দুই]

ছোটো থেকেই কিছু শেষ হয়ে গেলে আমার ভারি দুঃখ হত। আজকাল শত ইচ্ছে বা চেষ্টার পরেও কিছু ব্যাপার শেষই হতে চায়না। নিজেরই অনুভূতির ভূতের হাত থেকে পালাতে পালাতে বারবার এমন শান্তিকে আঁকড়ে ধরেছি আমি, যাকে আঁকড়ে ধরেও হারানোর ভয় যায় না। কোনো-একদিন হারানোর ভয়ে রোজ তাকে হারাতে থাকি। দুঃখের থেকে মুখ ফিরিয়ে আমি এমন সুখের দেশে এসে পড়ি, যেখানে কোনও সুখই আর আপন লাগে না। সমস্ত সুখের সঙ্গে আলাপ করতে করতে, প্রতিটা সংলাপে শুধুই অসুখের বোধ উঠে আসে। আপন কিছু খুঁজতে গিয়ে দূরবীনে ধরা পড়ে সেইসব দুঃখের কথা, যাদের পিছুটান থেকে বহুকাল ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছি আমি। দেখতে পাই, জীবনের প্রতিটা শোকের প্রদর্শন করতে গিয়ে তার সঙ্গে ঠিকমতো সময়ই কাটানো হয়নি। পুরোনো ক্ষতর মতই শুশ্রূষার অভাবে সেই শোক বারবার ক্রনিক দুঃখ হয়ে ফিরে এসেছে আমারই অজান্তে। রয়ে গেছে চিরসখা হয়ে। তবু বুঝতে পারিনি শোক প্রদর্শনের সামগ্রী নয়, একান্ত ব্যক্তিগত।

আজকাল স্বপ্নে অচেনা কেউ বারবার এসে বলে যায়, অনুভূতি আর অনুভূতির বোধ এক নয়। দুঃখের থেকেও বেশি দুঃখ লাগে দুঃখের বোধে, প্রাপ্তির চেয়েও বেশি প্রাপ্তি হয় প্রাপ্তির বোধ ঘিরেই। একা না হয়েও অনেকের একাকীত্বের বোধ খুব তীব্র। অকারণেই। সমস্ত অনুভূতির বোধই যেন 'দেজা ভু'-র মতো এসে তাদের সঙ্গে বাল্যকালের সম্পর্কের স্মৃতি ফিরিয়ে দিয়ে যায় - শুধু তারা বড় হয়ে কেমন দেখতে হয়েছে, আমায় দেখলে চিনতে পারবে কিনা, এইসব শোনার আগেই আমার অ্যালার্ম ক্লক বেজে ওঠে। এমনকি তা শোনার ইচ্ছেটুকুও সবসময় আমার কাছে পৌঁছতে পারেনা, সারাদিন ধরে বেজে যাওয়া অ্যালার্মের তীব্র ক্যাকোফোনিতে। কিন্তু স্পষ্ট বুঝতে পারি আমায় বহুকাল ধরে সযত্নে অনুসরণ করে চলেছে তারা। আর আমি অজান্তেই পালিয়ে বেড়াচ্ছি, কোথাও পৌঁছনোর তাড়াহুড়োর অজুহাতে। কোথায় পৌঁছতে চাইছি? কার কাছে? নিজেই কি জানি? ঠিকানা ছাড়াই বেড়িয়ে পড়েছিলাম তাকে খুঁজতে। ভেবেছিলাম ঠিক দেখা হয়ে যাবে তার সঙ্গে। কিন্তু যতবারই দেখা হয়েছে, তাকে চিনতে না পেরে, উল্টে তার কাছেই পৌঁছনোর রাস্তা জিজ্ঞেস করেছি বারবার। তাই কোথাও না পৌঁছে নতুন নতুন পথে ঘুরেই চলেছি কেবল।

একটা মোড়ে এসে দেখি অনেকগুলো পথ অনেক দিকে চলে গেছে। পড়ন্ত বিকেলের গাছের ছায়া দেখে পথ চলতে হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগল। গাছের পাশে দীঘির জলে খানিক তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হতে লাগলো, কোথায় পৌঁছনোর চেয়েও বোধহয় কোথাও ফিরে যেতে না চাওয়ার তাগিদেই এই পালানো। 

আসলে আমি পিছন ফিরে, কতদূর পালিয়ে এসেছি সেটা মাপতে মাপতেই আগামী গন্তব্যের দূরত্ব হিসেব করে চলেছি। এখন সামনে অজস্র পথের, অজস্র দিকনির্দেশ, হাতছানি, হিসেবনিকেশ আমার দিকে চেয়ে অপেক্ষায়। কিন্তু আমি শুধুই সেই দীঘির জলের দিকে তাকিয়ে।


[তিন]

বহুরূপী সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছি বহুকাল। আত্মমগ্ন হয়ে জাদুঘরে দেখিয়েছি ম্যাজিক, আর্ট গ্যালারিতে শিল্পকলা। অফিসে দেখিয়েছি আনুগত্য, সংসারে মায়া, অজানাকে দেখিয়েছি কৌতূহল। নিজেই নিজের ম্যাজিশিয়ান হতে গিয়ে জাদুঘরের আয়নাগুলোয় নিজেকে দেখেছি কখনও প্রেমিক, কখনও শিল্পী, কখনও সন্তান, কখনও পিতা, কখনও বন্ধু হিসেবে। আত্মকেন্দ্রিকতার ছদ্মবেশে নিজের কাছেই কখন নিজেকে গোপন করে ফেলেছি অজান্তেই।

ভালোবাসতে পারা সহজ। কিন্তু নিজেকে বা অন্যকে অন্তর থেকে প্রকৃত সম্মান করে ওঠা বোধহয় সহজ নয়। ঠিক যেমন আমরা কী চাই আর কীসে আকৃষ্ট হই, তার মধ্যেও সূক্ষ্ম একটা পার্থক্য থেকে যায়। প্রাপ্তির দাঁড়িপাল্লায় বারবার শুধুই কীসে আকৃষ্ট হই তা মাপতে যাই। তাকেই ভালোবাসতে যাই। আমরা কী চাই তাকে কখনো যথার্থ সম্মান করে ওঠা হয় না। কেন্দ্র খুঁজে না পেয়েই বারবার বৃত্ত সম্পূর্ণ করতে চাই। এখন মনোলগেও এই উচ্চারণটুকু করতে বড় অস্বস্তি হয়। অচেনা লাগে। তখন আবার পালানোর ছুতোয়, পকেট হাতড়ে দেখি, পকেটে জমানো সব নুড়ি পাথরগুলো কখন শেষ হয়ে গিয়ে, জলের সব তরঙ্গ থেমে, আমার প্রতিচ্ছবি আরও একবার স্থির আর শান্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। তলায় থিতিয়ে পড়েছে বুকপকেটে জমানো সেইসব অনুভূতির নুড়ি-পাথর, যাদের বহু কষ্টে জমিয়ে রেখেও দেখে ওঠা হয়নি কখনও।


 


শব্দকে বাদ দিয়ে শুধু বোবা অনুভূতির মাধ্যমেও অনেকসময় অনেক মরুপথ নিমেষে অতিক্রম করা যায় না কি? বহুদূরের কোনও ক্যাফেতে তোমার উল্টো দিকের চেয়ারটা হয়তো তখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে কারও অপেক্ষায়। নতুন করে আবিষ্কারের দরজা বন্ধ হয়ে এলে, উদ্ভাবনের জানলা হঠাৎ খুলে যায়। সরবত গুলতে গুলতে তুমি কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলে। সরবতের তলায় সব উপাদেয় উপাদান ধীরে ধীরে থিতিয়ে পড়ে স্বচ্ছ হয়ে উঠতেই হঠাৎ কি সেল্ফির মত নিজেকে দেখে ফেললে তুমি?

তোমার সঙ্গে এভাবেই বারবার দেখা হয়ে যায় আমার। সমস্ত পথই তখন ঠিকানার মতো লাগে।

...........................

[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র] 


#গদ্য #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

59

Unique Visitors

177714