পাখিপড়ার আসর - বসন্তবৌরির গল্প
বসন্ত ভারি ভালো ছেলে। বাপ মা সেই কবে কোন ছোটবেলায় সগ্গে গেলেও, সে মোটে বখে যায়নি।
বাপ জমি-জিরেত রেখে যায়নি যে চাষ করে খাবে, জাল নেই যে মাছ ধরে বেচবে... এমনকি গাই-গরুও নেই। কোনোক্রমে চলে যায়। পাড়ার লোকেদের ফাইফরমায়েশ খেটে দেয়। কারুর ঘরের চাল ছাইতে হল, কি জঙ্গল থেকে কাঠ বইতে হল, কিংবা ধান কাটার পর মাঠের খড় মস্ত মস্ত আঁটি বাঁধতে হল.... এমনি সব কাজে বসন্তর ডাক পড়ে।
সে সারাদিন খেটে খুটে করে দেয়, বিনিময়ে কেউ দেয় ধামা করে চাল, কেউ দেয় কলাটা মূলোটা.... এমনি করেই হয়ে যায়। মজুরী হিসেবে পয়সা পায়না মোটে।
তবে, তাতে তার কোনও খেদ নেই। দুবেলা কোনোরকমে দুমুঠো জুটলেই সে খুশি। যেদিন চাল থাকেনা, মুড়ি আর পেট ভরে জল খেয়ে নেয়।
বসন্তর মুখে হাসিটা লেগেই আছে। যেদিন কিছু থাকেনা, গাঁয়ের কেউ হয়ত শুকনো মুখ দেখে বুঝতে পেরে, যা পারে দিয়ে যায়।
এমনি করেই গরম পড়ে, বর্ষা আসে, দিন কেটে যায়।
বসন্তর আরেকটা গুণ আছে, সে দিব্যি গাইতে পারে। মনসার ভাসান হোক, কি শিবের চড়ক, নইলে কেত্তন.... তার ডাক পড়বেই। সেখানেও তেমন রোজগার নেই, ওই দু চার পয়সা যা পেল তাই, নইলে সেই চাল ডালের সিধে।
মেয়ে বউরা তাকে ভারি পছন্দ করে, সে আবার বাঁশিতে বেশ সুর তুলতে পারে। মাঝে মাঝে পুকুর পাড়ে বট গাছটার ছায়ায় বসে বাঁশী বাজায়। মেয়েরা কলসি কাঁখে জল আনতে আসে..... দুদন্ড শুনে যায়।
কেউ কেউ আবার আবদার করে, গাছ থেকে তেঁতুল পেড়ে দিতে; কারুর বাসন পুকুরে হারালে ডুব সাঁতার দিয়ে খুঁজে আনতে সে ওস্তাদ।
গাঁয়ের সবাই ভাবে, এমন একটা ন্যালা খ্যাপা ছেলে, একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে দিলে বেশ হত। কিন্তু মেয়ে দেবে কে?
ছেলের না আছে রোজগার, ঘর বলতে ওই কুঁড়ে, তার লাগোয়া এক চিলতে জমি।
পাড়ার সবাই ঠিক করল, বিয়ে হলে একটা কিছু বন্দোবস্ত হয়ে যাবে.... এখন যেমন চলছে তেমনই চলবে। আরেকটা বাড়তি পেট.... ও সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নেবে।
সে গ্রামে এক কাক থাকত। সবাই বলত, সে নাকি কোন মুনি... কী যেন কারণে কাকের রূপ ধরে আছে।
সবাই তাকে ভক্তি শ্রদ্ধা করত, দরকারে পরামর্শ নিতে যেত।
বসন্তর ব্যাপারে কথা বলতে সবাই চলল।
কাক সব শুনেটুনে বলল, ছেলেটা তো ভারি ভালো, কিন্তু কে মেয়ে দেবে একে? খাওয়াবে কি?
গ্রামের সবাই হইহই করে জানাল, সে নিয়ে ভাবতে হবেনা, আমরা ভাগাভাগি করে তার দায়িত্ব নেব। ছেলেটা একটু থিতু হোক.... ওর ঘরের ছিরি ফিরুক।
কাক বললে, অত সোজা নয় বাপু.... কৌশল করতে হবে। এমন বোকাসোকা একটা মেয়ে লাগবে, যাকে বাপ মা বিদেয় করতে পারলে বাঁচে... সে অত শত বুঝবে না।
কাক মেয়ের সন্ধানে চলল ভিন গাঁয়ে।
সেখানে দেখে এক বুড়ি ঠাকুমা আর তার নাতনি মহা চেঁচামেচি লাগিয়েছে।
বুড়ি নাকি হাঁড়িতে মাগুর মাছ জিইয়ে রেখেছিল। নাতনি সেই হাঁড়ি-সুদ্ধু মাছ নিয়ে পুকুর পাড়ে জল বদলাতে গেছে। মাছ তো একলাফে জলে। বুড়ি রেগে কাঁই। বলে, এমন বোকা মেয়ে বাপের জম্মে দেখিনি.... জল বদলাতে কেউ মাছ-সুদ্ধু হাঁড়ি নিয়ে পুকুরে যায়... এ মেয়েকে নিয়ে কী করব!
কাক দেখে ,এই সুযোগ।
মনে মনে মতলব ঠাউরে, রোজ ঠিক দুপুর বেলায় ঘরের চালে বসে কা কা স্বরে অবিরাম ডাকতে থাকল। বুড়ির নাতনি অতিষ্ঠ হয়ে যায়। একে তার মেলা কাজ, তার ওপর এই অলুক্ষুণে কাক.... ডেকে ডেকে মাথা খেয়ে ফেলল।
সে মেয়ে ভাবে, একটা উপায় করা যাক... খড়ের চালে আগুন ধরিয়ে দিই।
তখন আর কাক কোথায় বসবে?
এই না ভেবে সে বোকা মেয়ে সত্যি সত্যি আগুন লাগিয়ে দেয়.... দাউ দাউ করে জ্বলে পুড়তে থাকে চাল।
বুড়ি কী কাজে পুকুরপাড়ে গেছিল, আগুন দেখে হাউমাউ করে ছুটে আসে।
কপাল চাপড়ে বলে, এ মেয়েকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো... এ কি সর্বনাশ হল আমার।
কাক সুযোগ বুঝে এগিয়ে এল।
তোমার নাতনির বিয়ে দেবে নাকি? আপদ বিদেয় হবে!
বুড়ি তো অবাক হয়ে জানতে চায়, এমন মেয়েকে নেবে কে?
- আছে, আছে.... এমন জামাই এনে দেব, তোমাকে পণ দিতে হবে না, উপরন্ত জামাই ঘরের চাল ছাইতে ভারি ওস্তাদ.... তোমাকে মজুরিও দিতে হবে না।
এই শুনে তো বুড়ি আহ্লাদে আটখানা।
কাক তক্ষুনি বসন্তকে ডেকে আনল।
পরিপাটি করে ঘর ছেয়ে টুকটুকে বউ নিয়ে সে গাঁয়ে ফিরল। বোকা মেয়ে এত হইচইতে বুঝতেই পারলনা, ঠাকুমা তাকে এক হদ্দ গরিব ছেলের কাছে পার করে দিয়েছে।
গ্রামের লোকেরা খুব খুশি, উলু দিয়ে বউকে ঘরে তুলল।
কাককে আরো মান্যি-গন্যি করতে লাগল লোকে।
বসন্তর কিন্তু কোনও বদল হল না, এখনও পাড়ার কেউ কাজে ডাকলেই সে দৌড়ে যায়। যে যেমন পারে দেয়, হাসিমুখে তাই নিয়ে ঘরে আসে। পালা গানের আসরে মাঝে মাঝে ডাক পড়ে। সে মেয়েদের মত মিহি গলায় গাইতে পারে। তার কদর আছে বেশ। সেবার পালায় গেয়ে কটি পয়সা কড়ি পেল। ফেরার পথে বউয়ের জন্যে একখানা ডুরে শাড়ি হাট থেকে খরিদ করে নিয়ে এল। ভাবল, বউ শাড়ি পেয়ে ভারি খুশী হবে।
কিন্তু কোথায় কি! সে মেয়ের মুখে হাসি নেই, মনে সুখ নেই, খেয়ে পরে সোয়াস্তি নেই। দিবারাত্র বলে, এটা নেই, ওটা নেই। শাড়ি দেখে মুখ বেঁকিয়ে বলে কিনা.... এটা শাড়ি না গামছা!
মাগো, এমন শাড়ি শখ করে কেউ কিনে আনে!
বসন্ত মুখে কিছু বলে না, মনে মনে ভারি দমে যায়।
সত্যি, তার বউয়ের জন্যে সে কিছুই করতে পারছে না। এই ভেবে একটা কাজ করে। তাদের ঘর লাগোয়া একটা জলা জমি ছিল, তাতে একখান ডোবা মতো ছিল। বউকে জলের কাজ সারতে যেতে হত সেইই ঘোষেদের পুকুরে। দিনদুয়েক ধরে নিজেই কোদাল দিয়ে মাটি কুপিয়ে কুপিয়ে সেই ডোবা দিব্যি টলটলে জলে ভরিয়ে ফেলল।
বসন্ত ভাবল, এইবারে বউ নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে... ঘরের বাইরেই জল, নাইবে সুখে।
ওমা কোথায় কি!
মুখ ঝামটা দিয়ে বউ বলে কিনা, দুটো তুবড়ে যাওয়া থালা আর কালি পড়া হাঁড়ি ছাড়া বাসন নেই.... সেই মাজার জন্যে আবার গোটা পুকুর!
দুটো বই যার শাড়ি নেই, সে আবার সুখে নাইবে!
বউ দুম দুম করে চলে যায়।
বসন্ত ভারী মুষড়ে পড়ে। বউ তার ছোটখাটো গড়নের, মুখখানাও মন্দ না... ভেবেছিল, বোকাসোকা মেয়ে, সরল সাদাসিধেই হবে। কিন্তু তেমন তো হল না। কদিন ধরে মোড়ল মশায়ের জমির আগাছা পরিষ্কার করে, অনেক খানি সরু চাল পেয়েছিল। মোড়ল গিন্নি ভালো মানুষ, সে চুপি চুপি বেশ খানিক সোনামুগ ডাল দিয়ে বলেছিল, ও ছেলে.... বর্ষার দিনে খিচুড়ি খাস।
ভেবেছিল, বউয়ের মুখের হাসি চওড়া হবে... কিন্তু এ মেয়ে যে খুশি হয় না কিছুতেই।
বসন্ত সেদিন আর ভাতের পাতে বসল না, দাওয়ায় বসে বাঁশিতে আনমনে সুর তোলে।
সেই দেখে বউ আরো রেগে গনগন করতে থাকে, একবারও কাছে গিয়ে নরম করে খাবার জন্যে সাধে না.... নিজেই একা খেয়ে শুতে চলে যায়।
নিশুতি সেই রাতে, বসন্ত পেটে খিদে নিয়েই শুয়ে পড়ল।
গভীর সে ঘুম।
ভোর রাতে বউ ওঠে। নিজের সিঁদুর কৌটো উপুড় করে পুরোটা বসন্তর গালে কপালে লেপে দেয়। তারপর পা উঠিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
যাওয়ার সময় গজগজ করতে করতে বলে যায়.... তুমি মেয়েদের মত সেজে থাকো, গান গাও।
আমি সংসার করব না, চললাম ঠাকুমার কাছে। যদি রোজগারের মুরোদ থাকে তো ডেকে এন।
বসন্ত কিছুই শুনতে পায়না। দরজা হাট করে রেখে বউ বাপের বাড়ির পথ ধরে।
বেলা অনেক হলে,তার ঘুম ভাঙে। খিদেতে পেটের মধ্যে মোচড় দিচ্ছে। চোখ না খুলেই ভাবে, এতক্ষণে নিশ্চয়ই বউয়ের রাগ পড়েছে.... আমাকে আদর করে চাট্টি পান্তা কি আর দেবে না!
বিছানা ছেড়ে উঠে দেখে ঘর ফাঁকা, দরজা দুহাট। তার গালে, কপালে সিঁদুর লেপালেপি।
বসন্ত বোঝে, বউ তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার বুক ভেঙে যায় কষ্টে, বুঝেই পায় না তার দোষ কোথায়। বউকে সাজিয়ে গুজিয়ে রাখতে পারেনি, সেটা ঠিক। কিন্তু তাই বলে ছেড়ে চলে যাবে!
সিঁদুর যেমনি ছিল, লেপে রইল.... বসন্ত গালে হাত দিয়ে দাওয়ায় বসে রইল চুপটি করে।
বেলা তখন প্রায় দুপ্রহর, পাড়া পড়শিরা একে একে হাজির হয়, সব জানতে পারে।
মেয়েরা বলে, ও ছেলে... পাজি বউ যেখানে গেছে যাক, মরুক বাঁচুক, তোমার আর খবর নেওয়ার দরকার নেই।
তুমি যেমন আগে ছিলে, তেমনি থাকো।
লোকেরা কিন্তু ভাবে, ছল করে বিয়ে দিয়েই এমন বিপত্তি। বসন্তটা এমন মনমরা হয়ে রয়েছে... কিছু তো একটা বন্দোবস্ত করতে হয়।
সবাই কাকের কাছে দল বেঁধে চলল, যদি কিছু সুরাহা হয়। সম্বন্ধ করেছিল কাক, তার তো একটা দায়িত্ব আছে।
কাক সব দেখেশুনে বলল, একটু ভুল তো হয়েছেই। অমন কৌশলে বিয়ে না দিলেই হত।
তা...বসন্ত না হয় বউকে মানিয়ে ফেরত আনুক।
সেখানেও এক বিপত্তি। বউ বাড়ি ফিরে দেখে, ঠাকুমা চলেছে গঙ্গা সাগর, মেলা দেখতে। সে অনেক ক্রোশ দূরে, যেতে আসতে দিনকয়েক লেগে যাবে। বউ ভাবে, আমিও যাই.... একা একা থেকে কি করব!
এদিকে কাক বলল, বউ তো অনেকদূর চলে গেছে। সে হেঁটে যেতে দিন কেটে যাবে। একটা উপায় আছে.... বসন্ত বরং পাখি হয়ে যাক। আমি তো রাস্তা চিনি.... আমার সঙ্গেই উড়ে উড়ে যাবে। উড়ে গেলে বেশিক্ষণের পথ নয়।
কাক দুটো শিকড় দিয়ে একটা খেতে বলল, অন্যটা যত্ন করে রাখতে।
বসন্ত শিকড় খেয়ে সবুজ রঙের ছোট্ট পাখি হয়ে গেল, সিঁদুরের লাল রং লেগে রইল গালে।
কাকের সঙ্গে হাওয়ায় ডানা ভাসিয়ে উড়ে, নদ নদী, খাল বিল, মাঠ প্রান্তর পেরিয়ে চলল সেই দক্ষিণের দেশে, যেখানে গঙ্গাসাগরের মস্ত মেলা।
অতটুকু পাখি, কাকের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারে না, তবু বউয়ের সঙ্গে দ্যাখা হবে... দরকার হলে তার হাতে পায়ে ধরে ঘরে আনবে… এইসব ভাবতে ভাবতে মেঘের গা ছুঁয়ে উড়ে যায়।
বিকেলের দিকে এসে পৌঁছয়।
দূর থেকে কাক দ্যাখায়, ঠাকুমার সঙ্গে তার বউ হেসে হেসে গল্প করতে করতে ফিরছে।
বসন্তর খুব মনে লাগে। সে ভেবেছিল, বউয়ের মুখ কষ্টে ম্লান হয়ে থাকবে...
কোথায় কি?
ঘর ছেড়ে অমন করে এসেও কোনো মনকেমন নেই।
আর সে কিনা মানুষ থেকে পাখি হয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে এতখানি পথ বয়ে এসেছে!
কী হবে আর বউয়ের মান ভাঙিয়ে.... টুক করে সে মানুষ হওয়ার শিকড়খানি ফেলে দেয় ঝোপের মধ্যে।
তারপর ডানা গুটিয়ে বসে মস্ত বটের ডালে।
কাক তাড়া দেয়। ইতোমধ্যে, বউ আর ঠাকুমা ক্লান্ত হয়ে সেই গাছেরই ছায়ায় বিশ্রাম নিতে বসে।
কাক দেখে, এই সুযোগ।
বলে:
বসন্তরে, কা কা কা
শিকড়টুকু খা খা খা,
আগের মত মানুষ হয়ে যা যা যা।
বসন্তর আর মানুষ হওয়ায় মন নেই, শিকড় সে তো কখন ফেলে দিয়েছে।
এই বেশ ভালো। উড়ে উড়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশ, পাতার আড়ালে, গাছের কোটরে বাস... বউ তো গেছেই... যাক।
পাখি বলে:
ঠুক ঠুক ঠুক ঠুক
এমন করেই জীবন কাটুক,
বউটি আমার,
যেমন আছে, তেমনি থাকুক।
এই বলে সে তার ছোট্ট ডানা দুখানি মেলে দেয় বাতাসে।
গল্পের পাখি বসন্তবৌরি।
কাক কিন্তু অত সহজে ছেড়ে দেয়নি।
বেচারা ভালো মানুষটি দুঃখ পেয়ে পাখি হল, বৌকেও ছল করে শিকড় খাইয়ে কাক অমন সবুজ পাখি করে দিল।
বসন্ত আর বউয়ের মিল হয়েছিল কিনা, কাক আর সে খোঁজ রাখেনি।
*************************
অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র