জৈব-সন্ত্রাস: ভূত ও ভবিষ্যৎ
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন দেশের এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা জৈব-অস্ত্র প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেলেও ভারতে জৈব অস্ত্র প্রয়োগের প্রত্যক্ষ প্রমাণ সেভাবে পাওয়া যায় না। তা সত্ত্বেও অতীতে আমাদের দেশে ঘটা কিছু ঘটনার কারণ হিসাবে জৈব-সন্ত্রাসের নামই উঠে আসে। এরকমই কিছু ঘটনা নিয়ে আলোচনা করব আজ।
১৯৬৫ সালে সীমান্ত সমস্যাকে কেন্দ্র করে তখন বিবদমান ভারত-পাকিস্তান দুইপক্ষ। ঠিক এই আবহেই উত্তরপূর্ব ভারতে স্ক্রাব টাইফাসের “সন্দেহজনক” প্রাদুর্ভাবের সময় অনেকেই প্রশ্ন তোলেন, “এর উৎস কি প্রাকৃতিক? না কি জৈব-সন্ত্রাসই দায়ী এর পিছনে?”, এছাড়া পরবর্তী বিভিন্ন পর্যায়ে ১৯৯৪ সালে সুরাতে বিউবোনিক প্লেগ, ১৯৯৬ তে দিল্লিতে ডেঙ্গির প্রকোপ, ১৯৯৯ তে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুরে অ্যানথ্রাক্সের এবং শিলিগুড়িতে এনকেফালাইটিসের প্রাদুর্ভাব প্রশ্নচিহ্নের সংখ্যা বাড়িয়েই চলে ক্রমাগত।তবে ভারতে জৈব-অস্ত্র প্রয়োগের সর্বাধিক-চর্চিত ঘটনাটি কিন্তু ঘটেছিল খোদ পশ্চিমবঙ্গেরই পাকুড়ের রাজপরিবারে।
সালটা ১৯৩৩, হাওড়া স্টেশন থেকে বোন রাজকুমারী বনবালাকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেন ধরবেন পাকুড় রাজপরিবারের ছোটকুমার অমরেন্দ্রচন্দ্র পান্ডে। তাঁদের এগিয়ে দিতে এসেছেন অমরেন্দ্রচন্দ্রের সৎভাই বড়কুমার বিনয়েন্দ্রচন্দ্র। প্ল্যাটফর্মের ভিড় ঠেলে ট্রেনের দিকে এগোনোর সময় হঠাৎ প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠলেন অমরেন্দ্র! অনেক কষ্টে বললেন, ভিড়ের মধ্যে গায়ে ময়লা চাদর জড়ানো একজন লোকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে তাঁর, এবং তৎক্ষণাৎই তাঁর হাতে সূঁচের মত কি একটা ফুটিয়ে পালায় সে। জামা সরিয়ে ক্ষতস্থান পরীক্ষা করতেই অমরেন্দ্রর বাম হাতের উপরের দিকে দেখা যায় ছোট্ট একটা ফুটো এবং ঠিক তার চারপাশেই দেখা যায় লেগে রয়েছে হালকা হলুদ রঙের এক অচেনা তরল! প্রাথমিক ধাক্কা সামলে তাঁরা পাকুড় পৌঁছালেন ঠিকই, কিন্তু ততক্ষণে অমরেন্দ্রর হাতের ক্ষতস্থান বেশ ফুলে গেছে, বনবালা দাদার কপালে হাত দিয়ে দেখলেন জ্বরও আছে বেশ! জ্বর না কমায় এবং সন্দেহ হওয়ায়, চিকিৎসার জন্য পরদিনই অমরেন্দ্রকে নিয়ে পুনরায় কলকাতায় চলে আসা হয়, দেখানো হয় ডাঃ নলিনীরঞ্জন সেনগুপ্তকে। পরীক্ষা করবার পরে ডাঃ সেনগুপ্ত বললেন, অমরেন্দ্র এমন একটি মারাত্মক সংক্রমণে আক্রান্ত যা অতি দ্রুত রক্তের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে, বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় যাকে বলে সেপ্টিসেমিয়া। ডাক্তার বুঝলেন, দেরি হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও বাঁচাতে পারলেন না অমরেন্দ্রকে।
কোন্ জীবাণু দায়ী এর পিছনে তা জানতে ইতিপূর্বেই অমরেন্দ্রর রক্তের নমুনা কালচার করতে পাঠিয়েছিলেন ডাঃ সেনগুপ্ত। অমরেন্দ্রর অকালমৃত্যুর কয়েকদিন পরেই তাঁর রক্তের কালচার রিপোর্ট এলে চমকে ওঠেন ডাঃ সেনগুপ্ত। দেখলেন, অমরেন্দ্রর রক্তে ছিল সেপ্টিসেমিক প্লেগের জীবাণু "ইয়েরসিনিয়া পেস্টিস"! অতঃপর লালবাজারের তৎকালীন গোয়েন্দা অফিসার শরৎচন্দ্র মিত্রের তদন্তে এই রহস্যের উদ্ঘাটন হয়। গ্রেপ্তার হন পাকুড় রাজপরিবারের চিকিৎসক ডাঃ তারানাথ ভট্টাচার্য এবং বিনয়েন্দ্রচন্দ্র স্বয়ং। জেরার মুখে বিনয়েন্দ্রচন্দ্র স্বীকার করেন তারানাথকে সঙ্গী করে ভাই অমরেন্দ্রকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে সমস্ত সম্পত্তি একাই ভোগ করার পরিকল্পনার কথা। পরিকল্পনামাফিক বম্বের আর্থার রোড ইনফেকশস ডিজিজ হাসপাতালে বিনয়েন্দ্রর রেকমেন্ডেশানে রিসার্চ ফেলো হিসাবে ঢুকে প্লেগ জীবাণু হস্তগত করেন তারানাথ। সেই জীবাণুরই কিছুটা, ছোট একটি ভায়ালে (vial) ভরে নিয়ে চলে আসেন কলকাতা। অতঃপর, বিনয়েন্দ্রর নির্দেশেই এক ভাড়াটে খুনী হাওড়া স্টেশনে পৌঁছায় এবং ভিড়ের মধ্যে অতর্কিতে সিরিঞ্জের মাধ্যমে সেই প্লেগ-এর জীবাণু ইনজেক্ট করে অমরেন্দ্রর শরীরে। যার ফলেই কিছুদিনের মধ্যে মৃত্যু হয় অমরেন্দ্রর।
আমেরিকার জৈব-অস্ত্র গবেষণার প্রাণকেন্দ্র যেমন ছিল “ফোর্ট ডেট্রিক”, ঠিক তেমনি সোভিয়েত ইউনিয়নেরও ছিল Biopreparat।প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশী কর্মী যুক্ত ছিলেন এর সঙ্গে। ভবিষ্যতের বড় যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসাবে এখানে গোপনে বিভিন্ন মারণ অণুজীব নিয়ে গবেষণা চলতে থাকে। যেগুলির মধ্যে অ্যানথ্রাক্স, স্মল-পক্স, ইবোলা, প্লেগ রোগসৃষ্টিকারী ভয়ঙ্কর অণুজীব তো ছিলই, সঙ্গে ছিল Marburg virus, Machupo virus, আর আরও ভয়ঙ্কর সংযোজন হিসাবে ছিল Veepox এবং Ebolapox এর মত হাইব্রিড ভাইরাসও।
ছবিঃ Biopreparat
ছবি ঋণঃwww.ukrinform.net
এমনকি ২০০১ সালের একটি মার্কিন রিপোর্টে রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের আল-কায়দার মত জঙ্গি সংগঠনকে জৈব-অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়ারও অভিযোগ আনা হয়। আল-কায়দার পক্ষ থেকে আহমেদ রাসাম স্বীকারও করেন যে, বহুদিন ধরেই ওসামা বিন লাদেন এমন একটি যুদ্ধবিমানের সন্ধানে ছিলেন যেটি অপেক্ষাকৃত কম উচ্চতাযুক্ত অঞ্চলে জৈব-অস্ত্র প্রয়োগ করতে সক্ষম হবে।
ছবিঃ Ahmed Ressam
ছবি ঋণঃ www.nbcnews.com
নজরে থাকুক
জৈব-সন্ত্রাস: ভূত ও ভবিষ্যৎ ( প্রথম কিস্তি )
হাল আমলে জাইরেতে ইবোলা ভাইরাস বা চীনের উহান প্রদেশে SARS-CoV-2 এর কথাই না হয় ধরা যাক, এগুলি উৎপত্তিগতভাবে প্রাকৃতিক না কি পরীক্ষাগারে তৈরী, সে নিয়ে বিতর্ক চলতেই থাকবে। কিন্তু একটি বিষয়ে কারুরই দ্বিমত থাকা উচিৎ নয় যে, ভবিষ্যতে যে কোনও সময়ে যে কোনও রাষ্ট্রশক্তি বা সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী চাইলেই কিন্তু এরোসলাইজেশনের ফলে তৈরী হওয়া অতিক্ষুদ্র ড্রপলেটের মাধ্যমে এই ভাইরাসগুলিকে জৈব-অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতেই পারে। ভয়ের বিষয় হল, বিজ্ঞানীদের মতে, প্যারামিক্সোভিরিডি গোত্রের আরও দুটি ভাইরাস এই মুহূর্তে সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির উইশলিস্টের একেবারে প্রথম সারিতে। যার প্রথমটি হল, হেন্ডা ভাইরাস এবং দ্বিতীয়টি হল নিপা ভাইরাস। প্রসঙ্গত বলে রাখি, হেন্ডা ভাইরাস সাধারণত ঘোড়ার দেহে সংক্রমণ ঘটায় এবং এর সংক্রমণের ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে নিউমোনিয়া ও পরবর্তী পর্যায়ে মারাত্মক এনকেফালাইটিসের লক্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে, নিপা ভাইরাস সংক্রমিত হয় বাদুড় এবং শূকরের মাধ্যমে। এই ভাইরাসের সংক্রমণের ফলেও এনকেফালাইটিসের লক্ষণ প্রকাশ পায়, যা থেকে কিন্তু মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
আধুনিক সমরাস্ত্রগুলির মধ্যে যেগুলির সাহায্যে খুব সহজেই একসঙ্গে অনেক মানুষের প্রাণহানি ঘটানো সম্ভব তাদের একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত করে নাম দেওয়া হয়েছে weapons of mass destruction (WMD)। পারমাণবিক, রাসায়নিক এবং তেজস্ক্রিয় অস্ত্রের মত এই শ্রেণীভুক্ত অন্য আরও এক প্রকার অস্ত্র হল জৈব-অস্ত্র। জৈব-সন্ত্রাস অগণিত মানুষের প্রাণ তো নেয়ই, একইসঙ্গে মানুষকে করে তোলে সন্ত্রস্ত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় এবং দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য। কাজেই গোলা-গুলি-বোমা নয়, নিজেদের কার্যসিদ্ধির জন্য স্মল-পক্স, অ্যানথ্রাক্স কিংবা ইবোলা’র মত রোগের জীবাণুই এখন বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীগুলির প্রথম পছন্দ। একটি দেশের মানুষের মনোবল, সেদেশের স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক পরিকাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙে ফেলতে জৈব-অস্ত্রের জুড়ি মেলা ভার।
ঋণস্বীকার:
১) “India wakes up to threat of bioterrorism”- by Rohit Sharma. The British Medical Journal-এ প্রকাশিত একটি রিভিউ।
২) “Murder In The City: Twelve Incredible Case Files Of The Kolkata Police”, by Supratim Sarkar, Translated by Swati Sengupta।
৩) উইকিপিডিয়া।
৪) ইউটিউব থেকে সংগৃহীত কিছু ডকুমেন্টারি ভিডিও।
কভার ছবি ঋণঃ https://scroll.in
#জৈব-সন্ত্রাস #রাহুল দত্ত #বিজ্ঞান