ফিচার

বিলির বুট : কমিক্স, ফুটবল আর নস্ট্যালজিয়ার গল্প

অর্পণ দাস Dec 22, 2020 at 11:22 am ফিচার

বিলি ডেন। ইংল্যান্ডের এক শহরে ঠাকুমার সঙ্গে বসবাস করা সাধারণ এক কিশোর। পাগলামি বলতে একমাত্র ফুটবল খেলা। ফুটবল প্রতিভাতে বিলি অত্যন্ত সাদামাটা হলেও স্বপ্ন দেখে একদিন সে বড়ো ক্লাবের হয়ে, তার দেশের হয়ে ফুটবল খেলবে। এতটা পর্যন্ত বিলির সঙ্গে আর পাঁচটা বাঙালির ছেলের তেমন কোনো পার্থক্য নেই। ভরা বর্ষার প্যাচপ্যাচে কাদায় বা গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে, একফালি মাঠ পেলেই একদল ছেলে সবুজ ঘাসে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু বিলির গল্পটা একটু আলাদা। একদিন বাড়ির পুরনো চিলেকোঠা পরিষ্কার করতে গিয়ে সে পেয়ে যায় পুরনো ধাঁচের ছেঁড়া একজোড়া জুতো। যে জুতো জোড়া তার ঠাকুর্দা বিখ্যাত ফুটবল স্ট্রাইকার চার্লস ‘ডেডশট’ কিনের থেকে স্মারক হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন। সেই বুট পরে বিলি একদিন তার স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে নামে। আশ্চর্য হয়ে সে লক্ষ করে জুতো জোড়া পরতেই যেন কিনের ক্ষিপ্রতা, চোরা গতি, শক্তি বিলির উপর ভর করে। ক্রমেই সে ‘ডেডশটের’ মতো অবিশ্বাস্য সব গোল করা শুরু করে। ঘুম উড়ে গেল বিলির। ঘুম উড়ে গেল আশি-নব্বইয়ের দশকের ফুটবল পাগল কিশোর বাঙালির। বিলি হয়ে উঠল এক বন্ধু-সুপারহিরো। ফুটবল মাঠে সে যতই অপ্রতিরোধ্য হোক; বিলির সারল্য, বোকামো, স্কুল, পরিবার নিয়ে তার কাহিনি পড়লে তাকে বন্ধু বলেই মনে হয়। আর শুধু পড়া তো নয়, দেখাও। বিলি ডেন আসলে কমিক্সের চরিত্র, তাও আবার বিদেশি কমিক্সের অনুবাদ। রেখায়-লেখায় মোড়া কিশোর বিলি আর বুটকে আপন করে নিতে বাঙালি বিশেষ সময় নেয়নি। কারণ, গুপী-বাঘার ভূতের রাজার জুতো যদি নাও পাওয়া যায়, বিলির মতো জাদু জুতো যে তার চাই-ই চাই।

কমিক্সের পাতায় বিলির বুটের প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬১ সালে ইংল্যান্ডের ‘Tiger’ ম্যাগাজিনে Frank Purcell-এর হাত ধরে। ১৯৬৩ সালে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৭০ সালে ফুটবল-কমিক্সের ম্যাগাজিন Scorcher-এ বিলির পুনরাবির্ভাব ঘটে। এবারের কাহিনিকার Fred Baker এবং চিত্রশিল্পী John Gillatt। এই সময় থেকেই বিলির জনপ্রিয়তার সূত্রপাত। ১৯৭৪ সালে তা পুনরায় টাইগার ম্যাগাজিনে ফিরে আসে ‘Scorcher’ ‘Tiger’ ম্যাগাজিনের সঙ্গে মিশে যাওয়ায়। ১৯৮৪ সালে আবার স্থান পরিবর্তন। নতুন ঠিকানা ‘Eagle’ ম্যাগাজিন। এই সময়ের কমিক্সগুলিতে বিলির ফুটবল জীবনের থেকেও বেশি প্রাধান্য পেতে থাকে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলি—বিশেষ করে তার অসুস্থ ঠাকুমার কথা। ফলে এক বছরের মধ্যেই বিলি আবার ঠাঁই বদল করতে বাধ্য হয়ে চলে আসে ‘Roy of the  Rovers’ ম্যাগাজিনে। ছবির দায়িত্ব গ্রহণ করেন Mike Western। এখানেই ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে বিলির বুট প্রকাশিত হতে থাকে।

বাংলায় ‘Billy’s Boot’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৯১ বঙ্গাব্দের আনন্দমেলা পূজাবার্ষিকীতে ‘ভূতুড়ে জুতো’ নাম নিয়ে। ১৩৯১ বঙ্গাব্দে শারদীয়া আনন্দমেলাতে ‘Billy’s Boot’ যখন প্রথমবার বাংলায় অনূদিত হয়, তখন বিলি সেখানে আদ্যোপান্ত বাঙালি। তার নাম বিলাস রায়, ডাকনাম বিলু। বাঙালিয়ানার মোড়কে সেখানে বিলুর বন্ধুদের নাম রন্টু, পটলা, জগবন্ধু। ‘ক্যাপশন’-এ বর্ণিত আছে, “খেলা থেকে অবসর নেবার পরেই হঠাৎ দেশে-বিদেশে বিখ্যাত এক ফুটবল খেলোয়াড় বিমান-দুর্ঘটনায় মারা যান। রেখে যান তাঁর আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি... আর একজোড়া বুট”। সেই ‘মৃত’ ফুটবলারের নাম উল্লেখ না থাকলেও তাঁকে সবাই ডাকত ‘গোলন্দাজ’ বলে। বোঝাই যায় এও ‘ডেডশট’-এর বাংলা অনুবাদ। এমনকি বিলুর গোলন্দাজের মতো জোরালো শট দেখে একজন মন্তব্য করে, “বাস্‌ রে! যেন চুনী গোস্বামী!” কিন্তু বিদেশি পরিবেশ বা বিদেশি গড়নের মুখাবয়বের চিত্রকর্মের জন্য অনুবাদের সাবলীলতা থাকা সত্ত্বেও বিলু কখনই বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি। আদতে মাত্র ছয় পাতার এই সাদা-কালো কমিক্সটি নেহাতই লঘু খসড়া ধরনের। 


বাঙালির কাছে ‘বিলির বুট’-এর খ্যাতি শীর্ষে ওঠে শুকতারার পাতায়। কার্তিক ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ থেকে শুকতারা পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে ‘বিলির বুট’ প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। ‘ডেডশট’ কিনের জীবনী পাওয়া থেকে এই কাহিনি শুরু হয়। কিন্তু শ্রাবণ ১৪০০ বঙ্গাব্দে বিলির লন্ডনের কাকার বাড়িতে ঘুরতে গিয়ে ওয়েভিল রেঞ্জার্সের সঙ্গে ম্যাচের আগে তা আচমকাই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ততদিনে ‘বিলির বুট’ এতটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল যে সম্পাদক কমিক্সটি ফিরিয়ে আনতে বাধ্য হন। তাই আষাঢ় ১৪০১ থেকে বিলির বুট পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে শুকতারায় পাতায়, আগের বার যেখানে শেষ হয়েছিল ঠিক তারপর থেকেই। কিন্তু অগ্রহায়ণ ১৪০২ বঙ্গাব্দে বিলির ফ্রান্সে যাওয়ার ঠিক আগে আবার অসমাপ্তভাবে তা শেষ হয়ে যায়। বাঙালির জীবন থেকে বিলি নামক কিশোরটি তার ছেঁড়া বুট আর ফুটবল নিয়ে চিরতরে বিদায় নিল। তার বদলে দিয়ে গেল একাধিক প্রজন্মকে দুই দশকব্যাপী অফুরন্ত নস্ট্যালজিয়া।

বিলির জনপ্রিয়তা শুরু হয়েছিল আশির দশকের ফুটবল মানচিত্রে। তখন কলকাতা ময়দান কাঁপাচ্ছে মজিদ বাস্কার, জামশিদ নাশিরি, ভাষ্কর গাঙ্গুলি, কৃশানু দে, সুব্রত ভট্টাচার্য-র মতো প্লেয়াররা। আর বুরুচাগা, প্লাতিনি, গুলিট, জিকো, মারাদোনার পায়ের জাদুতে তখন গোটা বিশ্ব মুগ্ধ। রেডিওর রিলের অপূর্ব ধারাভাষ্যে বা গুটিকয়েক সাদা-কালো টেলিভিশনের পর্দায় মূর্ত হয়ে উঠছে তাঁদের শিল্পিত ফুটবল-প্রতিভা। কাঁটাতারের বেড়া পার করে ফুটবলপ্রেমী বাঙালি তাদেরকে ‘ঘরের ছেলে’-র মতোই নিজের নিজের ক্লাবের জার্সি পরিয়ে দিয়েছিল। অথচ এরকম এক ফুটবল পাগল জাতির কাছে ময়দানের ধুলো-কাদামাখা একজন নিজস্ব ফুটবল মহানায়কের বড্ড অভাব ছিল। উপন্যাসে, গানে, কবিতায়, সিনেমায় আমরা ফুটবলের উৎসবকে চিরন্তন করে রাখলেও সেই কাল্পনিক মহানায়ক কোথায়? আমাদের সেই আফসোস খানিকটা মিটেছে কমিক্সের হাত ধরেই। একদিকে যেমন আপামর বাঙালির শৈশব-কৈশোরের চোখ হাঁদাভোঁদা, বাঁটুল, নন্টে-ফন্টের মধ্যে ডুবে থেকেছে; অন্যদিকে অরণ্যদেব, সুপারম্যান, স্পাইডারম্যানের মতো কোনো কল্পজগতের ‘সুপারহিরো’ হয়ে ওঠার সুপ্ত বাসনাকেও আজীবন পুষে রেখেছে। আবার নারায়ণ দেবনাথ, ময়ূখ চৌধুরী, কাফি খাঁর তুলি-কলমে সমগ্র বিশ্বে, এমনকি বহির্বিশ্বেও বাঙালি ভ্রমণ সেরে ফেলেছে। এদের মধ্যে বিলির ‘সুপার পাওয়ার’ ছিল সম্ভবত সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য। তাই কোনো এক অজ্ঞাতকুলশীল বিলিকে পেতেই বাঙালি তাদের যোগ্য মযার্দায় স্থাপিত করেছিল। সেদিনের যেসব শিশু-কিশোর বিলির বুটে পা গলিয়েছিল তারা আজও সেই নস্ট্যালজিয়ার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। কমিক্সের কল্পনা হয়েও সে বাস্তব, ইংল্যান্ডবাসী হয়েও সে বাঙালি। ‘রোভার্সের রয়’-এর রয়ও সেরকমই আরেক মহানায়ক। তাঁর গল্প না হয় আরেকদিন হবে।


বিশেষ কৃতজ্ঞতা : Dhulokhela.blogspot.com


#বাংলা #ফিচার #বিলির বুট #কমিক্স #অর্পণ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

49

Unique Visitors

219200