বিল গেটসের ‘Think Week’ হতে পারে আপনারও ভালো থাকার মন্ত্র
পরিশ্রমের যে কোনও বিকল্প নেই, সে কথা কে না জানে। পরিশ্রম না করলে সফল হওয়া সম্ভব না, এ সত্য সভ্যতার ঊষাকাল থেকেই প্রশ্নাতীত। তবে আধুনিক সময় ও সমাজ এখন যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে কর্মক্ষেত্রের চাপ বাড়ছে। মানুষের দিনের সিংহভাগ সময় গিলে খেয়ে ফেলছে পেশাগত চাপ। যেটুকু বাকি থাকছে সেটুকু খেয়ে নিচ্ছে সোশাল মিডিয়া। এই সোশাল মিডিয়া কিন্তু কোনওভাবে মানুষের ‘Stress Buster’ অর্থাৎ মানসিক চাপ কমানোর সহায়ক হতে পারছে না। বরং মনোবিদদের চোখে এর উল্টো প্রবণতাই ধরা পড়ছে। সব মিলিয়ে মানুষের হতাশা, ক্লান্তি, দুশ্চিন্তা সবই বাড়ছে। ফলে বাড়ছে নানা মানসিক অসুস্থতা। ডিপ্রেশনের মতো অসুখ আজ মহামারি হয়ে উঠে ঘরে ঘরে থাবা বসাচ্ছে। মানুষের ভালো থাকার সম্ভাবনা তো কমছেই, একইসঙ্গে কমছে সার্বিক সৃজনশীলতা। আধুনিক সভ্যতার কাছে কি এর কোনও উত্তর আছে? কাজের চাপ কমাতে, অনেক মনোবিদ বা বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্টরা কিন্তু পুরনো সেই কথাটাকেই একটু পাল্টে নিতে বলছেন। ‘Word Hard’-এর চেয়েও তাঁরা জোর দিচ্ছেন ‘Work Smart’ মন্ত্রে। সফল হবার জন্য পরিশ্রমের পাশাপাশিই জরুরি হল নিজেকে তরতাজা রাখা, নিজের সৃষ্টিশীলতাকে বাঁচিয়ে রাখা। এমনই একটি ধারণার জন্ম দিয়েছেন মাইক্রোসফটের সহ-প্রতিষ্ঠাতা ধনকুবের বিল গেটস। তাঁর নিজের কথায়, তাঁর সাফল্যের প্রধান একটি চাবিকাঠি এটি। বিষয়টির নাম তিনি দিয়েছেন ‘থিঙ্ক উইক’ (Think Week) অর্থাৎ ভাবনা-সপ্তাহ।
কী এই ‘থিঙ্ক উইক’? এ আসলে গোটা একটা সপ্তাহ সব কর্মচঞ্চলতা থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিজের অলস ভাবনাকে প্রশ্রয় দেবার চেষ্টা। নিজের সৃষ্টিশীল ভাবনাগুলোকে উসকে নেবার একখণ্ড অবসর। টানা কর্মব্যস্ততায় শরীর-মন দুইই একেবারে অবসন্ন হয়ে পড়ে। তাদের দরকার যথাযথ বিশ্রাম। এই ভাবনা থেকেই বিল গেটস মাঝেমধ্যে নিজের জন্য এমন এক সাপ্তাহিক ছুটির পরিকল্পনা করেছিলেন। নিজের ক্লান্ত বিক্ষিপ্ত মনকে আবার কেন্দ্রীভূত করতে তিনি এই সাতটা দিন আধুনিক সভ্যতার প্রায় সমস্ত উপকরণ থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ গুটিয়ে নেন। প্যাসিকফিক নর্থওয়েস্টের জঙ্গলের মাঝে এক দোতলা কেবিনে গিয়ে একান্তে সময় কাটান। সঙ্গে কোনও গ্যাজেট থাকে না। থাকে শুধু কিছু বইপত্র। একেবারে একা থাকেন না তিনি। সঙ্গে থাকে একজন কেয়ারটেকার, যিনি একইসঙ্গে রাঁধুনিও বটে। তাঁর কাজ গেটসকে দু’বেলার খাবার আর সারাদিনে বারবার ডায়েট অরেঞ্জ ক্রাশ যোগান দেওয়া। এই সপ্তাহটা গোটাটাই তিনি কাটাতেন নানারকম বই পড়ে। কখনও বা মাইক্রোসফটের কর্মীদের লেখা চিঠিপত্র, মতামত, প্রতিবেদন ইত্যাদিও পড়েন। নতুন কিছু ভাবনা মাথায় এলে নোট করে রাখেন। ১৯৯৫ সালে এমন একটি থিঙ্ক উইকে বসেই গেটস রচনা করেছিলেন তার বিখ্যাত মেমো ‘The Internet Tidal Wave’, যা নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রযুক্তি-জগতের পরবর্তী গতিপ্রকৃতি। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের ধারণা সুগঠিত হয়েছিল এই নোট থেকেই। এছাড়াও মাইক্রোসফট ট্যাবলেটসহ আরও বেশ কিছু আইডিয়া গেটস পেয়েছিলেন ‘থিঙ্ক উইক’ কাটানোর সময়েই। মাইক্রোসফটের মতো বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থেকেও তিনি যে নিজের সৃজনশীলতা বা উদ্যমকে হারিয়ে ফেলেননি, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় একেবারে শুরুর দিকে থেকেও অকারণ বিলাসে ডুবে না থেকে সদাসক্রিয় রেখেছেন নিজের মস্তিষ্ক ও মননকে। নতুন নতুন ধারণার উদ্ভাবন করে গেছেন প্রায়শই। এর পিছনে ‘থিঙ্ক উইক’-এর অবদান স্বীকার করতেই হয়।
আরও পড়ুন : কনসার্ট ফর বাংলাদেশ : পৃথিবীর প্রথম বেনিফিট কনসার্টের গল্প / অরিন্দম রায়
বিল গেটসের এই ‘থিঙ্ক উইক’ থেকে কিন্তু আমরা সকলেই ভালো থাকার কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র শিখতে পারি। তার জন্য গেটসের মতো বড়লোক বা বিশাল ব্যক্তিত্ব হবার দরকার নেই। জঙ্গলের মাঝখানে কেবিন বা সারাদিনের ডায়েট অরেঞ্জ ক্রাশও দরকার নেই। দরকার নিরবচ্ছিন্ন কয়েকটা দিনের ছুটি আর একটু নিরিবিলি। রোজকার কাজ এবং জীবনযাপনের চাপ আমাদের শুষে নেয়। তার থেকে সাময়িক বিরতি নিজেকেই খুঁজে নিতে হবে। বিরতি মানে একেবারে নিখাদ অবসর। সেখানে মোবাইল, ট্যাব, ইন্টারনেট বা কর্মক্ষেত্রের তাগাদা যদি আপনার পিছু না ছাড়ে তাহলে সেই বিরতি অর্থহীন। সারা বছরে অন্তত এক-দু বার এমন নিখাদ ছুটির সপ্তাহ সমস্ত মানসিক চাপ ঝেড়ে ফেলে আপনাকে চাঙ্গা হয়ে উঠতে সাহায্য করবে। নিজের কাজে কয়েকগুণ উদ্যম নিয়ে ফিরে আসতে পারবেন আপনি। কাজে ফোকাস বাড়বে, ফলে কাজের গুণমান বাড়বে। শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যও ঠিক থাকবে। মনোবিজ্ঞান স্বীকার করে যে, কয়েকটা দিন প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে কাটালে শরীর-মন অনেকটা শুশ্রূষা পায়। রোজকার জীবন থেকে ক্ষণিকের বিরতি নিয়ে আপনি ঠাণ্ডা মাথায় নিজের সমস্যাগুলোর জট ছাড়াতে পারবেন। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের সুযোগ পাবেন।
ঋণ : ১) Inside Bill’s Brain / Netflix
২) Roar Media, বাংলা