কনসার্ট ফর বাংলাদেশ : পৃথিবীর প্রথম বেনিফিট কনসার্টের গল্প
সময়টা ১৯৭১ সালের জুন মাস। লস এঞ্জেলসে বসে পণ্ডিত রবিশঙ্কর উতলা হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর দৈনন্দিন রেওয়াজে মন ছিল না। কিছুক্ষণ পরেই সেখানে “দি বিটলস” ব্যান্ডের গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসন আসেন। তিনি তাঁর বন্ধুকে এত বিব্রত এত দুঃখিত কখনও দেখেননি। কী হল তাঁর হঠাৎ? রবিশঙ্কর তাঁর বন্ধুকে খুলে বলেন তাঁর দুঃখের কারণ। আর তার ঠিক দুমাসের মধ্যে পৃথিবীর সংগীতের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে নিউ ইয়র্ক শহরের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে।
কেন রবিশঙ্কর এত কষ্টে ছিলেন? কী-ই বা সেই যুগান্তকারী ঘটনা? জানতে হলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে আরও কয়েক মাস আগে।
১৯৭০-এর শেষের সময় সেটা। উত্তাল বাংলাদেশ, বলা ভালো পূর্ব পাকিস্তান। স্বাধীনতার লক্ষ্যে বাঙালিরা একজোট হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এমন সময় ভয়াল সাইক্লোন “ভোলা” কেড়ে নিল পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণ। সেই ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই ১৯৭১-এর মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের “অপারেশন সার্চলাইট”-এর বলি হল আড়াই লাখেরও বেশি মুক্তিযোদ্ধা। দলে দলে মানুষ প্রাণের ভয়ে পশ্চিমবঙ্গে পালিয়ে আসতে শুরু করেছে। চারিদিকে আতঙ্ক আর হাহাকার।
রবিশঙ্করের বাবা ছিলেন বাংলাদেশের একজন মধ্যবিত্ত যজমান। কাজেই শিকড়ের টান অগ্রাহ্য করা অসম্ভব হয়ে পড়ল তাঁর পক্ষে। তিনি এবং হ্যারিসন ঠিক করলেন একটি কনসার্ট করে টাকা তোলা হবে আর সেই টাকা বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিলিয়ে দেওয়া হবে। হ্যারিসন আর রবিশঙ্করের সম্পর্ক নিয়ে বহু বছর পরে রবিশঙ্কর এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “হ্যারিসন একাধারে আমার শিষ্য আমার ভাই এবং আমার ছেলে।”
আরও পড়ুন : বিপ্লবী সিনেমার আঁতুড়ঘর ঝিগা ভেরতভ দল / মৃণালিনী ঘোষাল
“দি বিটলস” ভেঙে গেছে বেশ কিছুদিন হল। হ্যারিসন জানতেন একাধিক বড় নাম ছাড়া কনসার্ট সফল করা কষ্টকর। বহুদূরে থাকা এক কিংবদন্তিকে টেলিফোনে ধরলেন তিনি। সেই কিংবদন্তি মানুষটি বেশ কিছুদিন কনসার্ট করছেন না। কনসার্টের মাঝে হঠাৎই হ্যারিসন ঘোষণা করেন, “আমি আমার এক বন্ধুকে ডেকে নিতে চাই। মিস্টার বব ডিলান।” ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের চল্লিশ হাজার দর্শক উল্লাসে ফেটে পড়েন তখন। স্বেচ্ছাবসর ভেঙে বব ডিলান গেয়েছিলেন “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ”-এ। বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাঁচটি গান গেয়ে আবার লাইভ কনসার্টে ফিরে আসেন তিনি।
আর দুজনের কথা না বললে এই কনসার্ট সম্পূর্ণ হয় না। বিখ্যাত ব্লুজ গিটারিস্ট এরিক ক্ল্যাপটন আর বিটলসের ড্রামবাদক রিঙ্গো স্টার। মতানৈক্য ভুলে বাংলাদেশের জন্য বাজাতে একবাক্যে রাজি হয়ে যান রিঙ্গো স্টারও। সেই সময় ড্রাগের নেশার সঙ্গে লড়াই করা ক্ল্যাপটনের অসুস্থ শরীরে বাজানো গিটার আজও সংগীতপ্রেমীদের কাছে অনুপ্রেরণা।
এই কনসার্টের প্রথম ভাগে ছিল প্রাচ্যের সংগীত। রবিশঙ্কর ছাড়াও ছিলেন বিশিষ্ট তবলচি আল্লারাখা, সরোদে আলী আকবর খান এবং তানপুরায় কমলা চক্রবর্তী। রবিশঙ্করের সৃষ্টি প্রায় এক ঘণ্টা ব্যাপী বাংলা-ধুন শীর্ষক খেয়ালটি পরবর্তীকালে “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” নামক অ্যালবামেও স্থান পায়। এরপর মঞ্চে হ্যারিসন এসে ডেকে নেন কি-বোর্ডিস্ট বিলি প্রেস্টন, লিওন রাসেল আর ব্রিটিশ ব্যান্ড ব্যাড ফিঙ্গারকে। তারপরের সময়টা ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের চল্লিশ হাজার দর্শকের জীবনের সবথেকে বড় স্মৃতি বললেও অত্যুক্তি হবে না হয়তো। হ্যারিসন কনসার্ট শেষ করেন তাঁর লেখা ও সুর দেওয়া গান “বাংলাদেশ” দিয়ে, যা শুধুমাত্র এই কনসার্টের জন্য লিখেছিলেন তিনি।
আরও পড়ুন : কোন মন্ত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড ? / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায়
পরবর্তীকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে রবিশঙ্কর বলেন, তিনি ভেবেছিলেন ২৫০০০ ডলারের মতো সংগ্রহ করবেন। কিন্তু হ্যারিসন আর রবিশঙ্করের যৌথ উদ্যোগে এই কনসার্ট প্রাথমিকভাবে ২৫০০০০ ডলার সংগ্রহ করে। এই কনসার্টের অ্যালবাম এবং সিনেমার স্বত্ব বিক্রি করে এক কোটি বারো লাখ ডলার পাঠানো হয় বাংলাদেশের ত্রাণের জন্য। “কনসার্ট ফর বাংলাদেশ” অ্যালবামটি ১৯৭৩ সালে গ্র্যামি পুরস্কার পায়, যা সংগীতের জগতে সবথেকে ঐতিহ্যবাহী পুরস্কার বলে ধরা হয়। এই কনসার্ট বিশ্বের প্রথম বেনিফিট কনসার্ট হলেও আমার কাছে এই কনসার্ট এক বন্ধুর জন্য আরেক বন্ধু কী করতে পারে তার উদাহরণ। হ্যারিসনকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়, “বাংলাদেশের জন্য কেন?” তার উত্তর ছিল, কারণ রবিশঙ্কর আমার বন্ধু।
এরপর বহু বেনিফিট কনসার্ট হয়েছে, হাইতি, কাম্পুচা, আফ্রিকা, সুনামিবিধ্বস্ত দেশগুলির জন্য। কিন্তু প্রাচ্য আর প্রাশ্চাত্যের মিলনে এ-ই প্রথম কনসার্ট, যার পুরোভাগে ছিলেন আমাদেরই দেশের এক কিংবদন্তি।
..............................................................
অরিন্দম রায়ের পরিচালনায় পরিবেশ ও পৃথিবী বিষয়ক একটি নতুন ওয়েবসাইট - sobujprithibi.in