নিঃশব্দেই একশো পেরোলেন ভারত ভূষণ
প্যাক আপ (দ্বিতীয় পর্ব) :''দেহপট সনে নট সকলি হারায়''।সময়ের চেয়ে বড় সুপারস্টার কেউ নেই। তার সামনে সবাই পকেট-সাইজ। সময় কারো রোয়াব দেখে না বেশিদিন।খ্যাতি? সে তো বালির বাঁধ। আজ যে রাজা, কাল সে ফকিরেরও ফকির। সত্যজিত রায়ের কোনও এক গল্পে একটি চরিত্র বলেছিল, অভিনেতারা আক্ষরিক অর্থেই 'শুটিং স্টার'। উল্কার মতো আসেন। উল্কার মতোই চলে যান। মানুষ অল্পেই মাথায় তুলে নাচে, তার চেয়েও অল্পে অবহেলাভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় ক'দিন পর। বড় নিষ্ঠুর সেই গণ-প্রত্যাখ্যান। বড় অশ্লীল সেই গণ-বিস্মৃতি। বেঁচে থাকতে থাকতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান শতকরা নিরানব্বই ভাগ। বিরাট মাপের সুপারস্টারেরা মৃত্যুর পর দু' এক দশক অবধি টেনে দেন কোনওমতে।আসলে সময়ের চেয়ে বড় ঠগবাজ আর কে আছে! তার সাময়িক বশ্যতা- স্বীকারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ভেবে নিলেই পিঠে ছুরি খেতে হয়। সিলি পয়েন্টের এই নতুন ফিচার-সিরিজে আমরা তুলে আনব পুরনো দিনের এমন কিছু অভিনেতার গল্প, যাঁদের আমরা আজ পরিপাটি ভুলে গেছি - অথচ সময় একদিন তাঁদেরও তাঁবেদারি করেছে। প্রতি শুক্রবার সিলি পয়েন্টের ফিচার-সিরিজ 'প্যাক আপ'। আজ দ্বিতীয় পর্বে ভারত ভূষণ। .....................................................................................................................
কবি সাহির লুধিয়ানভি একবার মন্তব্য করেছিলেন, যদি কাউকে প্রকৃত কবির মতো দেখতে হয়, তিনি ভারত ভূষণ মির্জা গালিব, কালিদাস, সঙ্গীতজ্ঞ তানসেন, সাধক শ্রী চৈতন্য কিংবা সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত – সিনেমার পর্দায় পরপর সংবেদনশীল চরিত্রগুলির চরিত্রায়ণে ভারত ভূষণের তুমুল জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে, এ মন্তব্য অত্যুক্তি নয়।
ভারত ভূষণকে বলা হয় হিন্দি সিনেমার প্রথম ‘চকোলেট ফেসড’ স্টার। মিরাট শহরে ১৯২০ সালের ১৪ জুন তাঁর জন্ম। তাঁর আইনজীবী বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে আইনের পেশায় আসুক। বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে ভারত ভূষণ অভিনয়কে পেশা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। পরবর্তীকালে বম্বে শহরে এসে শুরু হয় তাঁর পেশাদারি অভিনয় জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই। ১৯৪১-এ প্রথম কাজ পান প্রযোজক রামেশ্বর শর্মার কাছে। মাসিক ৬০ টাকা পারিশ্রমিকে ‘ভক্ত কবীর’ ছবিতে কাশী নরেশ চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। তবে তাঁর সেলুলয়েড অভিষেক ১৯৪১ সালে কিদার শর্মার ছায়াছবি ‘চিত্রলেখা’ ছবিতে। এরপর প্রায় এক দশক চলেছিল তাঁর স্ট্রাগল। ১৯৫২ সালে বিজয় ভাট্ নির্দেশিত ‘বৈজু বাওড়া’ ছবিতে তিনি নামভূমিকায় অসাধারণ অভিনয় করেন যা তাঁকে রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। রফি সাহেবের কণ্ঠস্বরে “ও দুনিয়াকে রখওয়ালে শুন্ দরদ্ ভরে মেরে নালে” গানের সঙ্গে বিখ্যাত হয়ে যায় ভারত ভূষণের অভিব্যক্তি।
পাঁচের দশকে রাজ কাপুর-দিলীপ কুমার-দেবানন্দ ত্রয়ীর রাজত্বের মাঝেও ভারত ভূষণ নিজের একটা আলাদা জায়গা তৈরি করতে পেরেছিলেন দুর্দান্ত অভিনয়ের জোরে। ১৯৫৫ সালে ‘শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভু’ (১৯৫৪) ছবিতে নামভূমিকায় অভিনয়ের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান। পরের বছর ‘মির্জা গালিব’ (১৯৫৪) ছবিতে গালিবের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য পান শ্রেষ্ঠ অভিনেতার মনোনয়ন। ঐতিহাসিক ও পৌরাণিক চরিত্রে সে সময় তিনি পরিচালকদের অটোমেটিক চয়েজ। তাঁর লিপে রফি, মান্না দে থেকে মুকেশ পর্যন্ত সে সময়ের প্রায় সমস্ত প্রখ্যাত প্লে ব্যাক সঙ্গীতশিল্পীরা গেয়েছিলেন। ‘মির্জা গালিব’ ছবিতে গালিবের তালাৎ মাহমুদের কণ্ঠে বিখ্যাত গজলগুলি ভারত ভূষণের অসাধারণ অভিনয়ে আলাদা একটা মাত্রা পেয়েছিল।
ভারত ভূষণের দাদা রমেশ চন্দ্র সিনেমা প্রযোজনার সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর প্রযোজনায় ‘বসন্ত্ বাহার’ (১৯৫৬) ছবিতে ভারত ভূষণ মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। অভিনয়ের পাশাপাশি ভারত ভূষণ ‘বসন্ত্ বাহার’, ‘বর্সাত কি রাত’ (১৯৬০), ‘দুজ্ কা চান্দ্’ (১৯৬৪), ‘নয়ি উম্র কি নয়ি ফসল্’ (১৯৬৬) প্রভৃতি বেশ কয়েকটি ছবির চিত্রনাট্যও রচনা করেছিলেন। ভাবতে ভালো লাগে যে তিনি একজন আগ্রাসী পাঠক ছিলেন। শুধু যে বিপুল সম্পত্তি বা গাড়ি-বাড়ি করেছিলেন তা-ই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত বইয়ের সংগ্রহ ছিল লক্ষাধিক। দাদা প্রযোজক রমেশ চন্দ্রের পরামর্শে তিনি ফিল্ম প্রযোজনা শুরু করেন। তাঁর প্রযোজিত দুটি ছবি – ‘বসন্ত্ বাহার’ ও ‘বর্সাত কি রাত’ সুপারহিট হয়। কিন্তু চিরদিন কারো সমান যায় না। ভাইয়ের এই আর্থিক সাফল্য দাদা রমেশের লোভের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রমেশ তাঁকে আরও ছবি প্রযোজনায় প্ররোচিত করেন। পাশাপাশি পরবর্তী ছবিগুলিতে নিজের ছেলেকে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকেন। দাদার দাবি মানতে গিয়ে ভারত ভূষণের প্রযোজিত পরবর্তী প্রায় সব ছবিই ফ্লপ হয়। তিনি প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। পাশাপাশি, সে সময় শশী কাপুর, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্নার মতো প্রমুখ দাপুটে নবাগত অভিনেতাদের সঙ্গে তিনি পাল্লাও দিতে পারেননি। এই জোড়া বাণে বিদ্ধ হয়ে ভারত ভূষণের অভিনয় কেরিয়ার একেবারে শেষ হয়ে যায়। শেষমেশ দেনার দায়ে জড়িয়ে পড়ে তাঁকে বাড়ি, গাড়ি, বইয়ের সংগ্রহ – সবকিছুই বিক্রি করতে হয়েছিল। পেটের দায়ে সাতের দশকে অনেক ছবিতে তিনি নামমাত্র চরিত্রে অভিনয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এমন অবস্থা হয়েছিল, ১৯৯০ সাল নাগাদ তিনি বলিউডে প্রায় জুনিয়র আর্টিস্টের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছিলেন। অমিতাভ বচ্চন তাঁর একটি ব্লগে ভারত ভূষণের শেষদিকের মর্মান্তিক অবস্থা বিষয়ে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন – “একদিন সকালে কাজে যাওয়ার সময় আমি দেখলাম পঞ্চাশের দশকের সেই বিখ্যাত ‘রোম্যান্টিক হার্ট থ্রব’, সেইসময়ের অনেকগুলো সফল মিউজিক্যাল সিনেমার হিরো ভারত ভূষণ বাস ধরবার লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন! তিনি যেন একজন সাধারণ নাগরিক, জনতার অংশ, একা, অলক্ষিত, কেউ তাঁকে চিনতে পারছে না। কেউ যেন জানেই না তিনি কে ছিলেন।”
শেষজীবনে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়লেও তাঁর চিকিৎসা বা দেখাশোনা – কোনওটাই কেউ করেনি। সরকারি সাহায্যও পাননি। দীর্ঘদিনের কষ্টের পর অবশেষে ১৯৯২ সালের ১০ই অক্টোবর ভারত ভূষণ ইহলোক ত্যাগ করেন। এ বছরই মাসতিনেক আগে তিনি একশোয় পা রাখলেন। তবু আজও অবহেলা আর বিস্মৃতিই তাঁর সম্বল।
[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস]
#Bharat Bhushan # Indian actor #Bollywood #Baiju Bawra #Shri Chaitanya Mahaprabhu #Mirza Ghalib #Bhakta Kabir #Basant Bahar # Filmfare Best Actor Award (1955) # Mohammad Rafi #Manna Dey #Hindi Movies #Hero #star #বলিউড #অভিনেতা #ব্যক্তিত্ব #ফিচার #Feature #Feature Series #ফিচার সিরিজ #অলর্ক বড়াল #শতবর্ষ