বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (দশম পর্ব)
পর্ব ১০। কোহেরার: বেতার-তরঙ্গ চেনবার কল
অদৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যে কোনও স্থানে উপস্থিত রয়েছে, বা এসে হাজির হয়েছে সেটা বোঝবার জন্য যে উপায়, সেটাই কোহেরার। অন্যভাবে বললে এই তরঙ্গকে ‘ডিটেক্ট’ করা বা বিশেষভাবে চিনে নেওয়ার কাজে যে বিশেষ ব্যবস্থাটা কাজে লাগিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্র সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীরাও, সেটারই নাম ‘কোহেরার’। ব্রিটেনের বিজ্ঞানী স্যার অলিভার লজ এই কোহেরারের সবচেয়ে বেশি উন্নতিসাধন করলেও এর আবিষ্কর্তার স্বীকৃতি দেওয়া হয় ফ্রান্সের এডুয়ার্ড ব্র্যানলি-কে। আরও পরের দিকে এই কোহেরার-এরই এক বিশেষ রূপের আবিষ্কার নিয়ে দ্বন্দ্ব হবে জগদীশচন্দ্র আর মার্কোনি-র মধ্যে। এই পর্বে আমরা সেই ব্র্যানলি নামের মানুষটির কথা আলোচনা করব।
উৎপাদক-যন্ত্র থেকে উৎপন্ন হয়ে সঞ্চালন ব্যবস্থার মাধ্যমে বেতার তরঙ্গ বা রেডিও ওয়েভ কোনও স্থানে পৌঁছেছে কি না, সেটা এই ব্যবস্থার সাহায্যে বোঝা যাবে। অন্য কথায়, ‘কোহেরার’ হল তরঙ্গ-ধারক ব্যবস্থা। জগদীশচন্দ্র বা তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের অনেক আগে থেকেই এই জাতীয় যন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে আসছে তড়িৎ-প্রবাহকে চিনে নেওয়ার কাজে।
বেতার তরঙ্গ নিয়ে কাজ শুরু হওয়ার প্রথম যুগে এই ধরনের তরঙ্গ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হত স্পার্ক ট্রান্সমিটার নামে এক যন্ত্র, যেখানে খুব বেশি মাপের ভোল্টেজ তৈরি করে সেই ভোল্টেজের সাহায্যে স্পার্ক বা স্ফুলিঙ্গ তৈরি করা হত। আর সেই স্পার্ক থেকে তৈরি অদৃশ্য তরঙ্গকে অন্য স্থানে পাঠানো হত অ্যান্টেনার সাহায্যে। এই তরঙ্গকেই ধারণ করতে কাজে লাগানো হয় কোহেরার। কোহেরার কথাটা এসেছে ল্যাটিন ‘Cohaere’ থেকে, এর অর্থ যা ‘কোহের’ (Cohere) করে, মানে যা কোথাও লেগে থাকে। শব্দটা অলিভার লজ সাহেব প্রথম ব্যবহার করেন।
এই কোহেরারের প্রাথমিক রূপটি তৈরি হয় আজ থেকে একশো সত্তরেরও বেশি বছর আগে। ১৮৫০ সালে পিয়ের গুইটার্ড (Pierre Guitard) নামে এক ব্যক্তি (এঁর সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানা যায় না) প্রথম দেখেছিলেন যে যখন ধূলিকণাযুক্ত বাতাসকে যখন তড়িতের সাহায্যে আহিত (চার্জড) করা হয়, তখন ওই ধূলিকণাগুলো একত্রিত হয়ে একটা সরু সুতোর মতো আকার ধারণ করে। এই যে বিভিন্ন বস্তুর কণা তড়িৎ প্রবাহিত হলে অন্যরকম আচরণ করে, এটাই তখন মানুষকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। পরে এই সংক্রান্ত ব্যাপারে প্রথম পেটেন্ট নেন দুই বিজ্ঞানী: স্যামুয়েল আলফ্রেড ভারলি (Samuel Alfred Varley) এবং ডেভিড এডওয়ার্ড হিউজেস (David Edward Hughes)। প্রথমজন ১৮৬৬ সালে যে যন্ত্রটা তৈরি করেন তার নাম ছিল ‘লাইটনিং অ্যারেস্টার’ বা বজ্রধারক। আর ১৮৭৮-৭৯ সালের দিকে ডেভিড হিউজেস দেখান যে কোনও কাচের নলের মধ্যে যদি পাতলাভাবে (মানে একদম চাপাচাপি করে না রেখে, সেগুলোর মধ্যে অল্প-অল্প ফাঁক রেখে) কুচি-কুচি করে কাটা ছোট-ছোট দস্তা আর রূপোর টুকরো ভরে রাখা হয় এবং ওই নল থেকে কিছু দূরে তড়িৎ-স্পার্ক তৈরি করা হয়, তবে ওই নলের মধ্যেকার দস্তা-রূপোকুচিগুলো গায়ে গায়ে এসে আটকে যায়। যদিও এটা সাময়িক।
এই ব্যাপারটা নিয়ে আরও চর্চা করেন টামিস্টোকল ওনেস্টি (Tamistocle Onesti) নামে এক ইতালীয় পদার্থবিদ। তিনি দেখেন যে দুটো ব্রোঞ্জের পাতের মাঝখানে যদি তামার কুচি রাখা হয় তবে ওই ওই কুচিগুলো পাতের দু-পাশে তড়িৎ প্রয়োগ করলে আটকে যায় এবং গোটা জিনিসটা তড়িৎ পরিবহন করতে থাকে। এই যন্ত্রকে যে কাজে লাগিয়ে বজ্রপাতের খবর আগাম জানানো যেতে পারে, এটা তাঁরও মনে এসেছিল।
সুতরাং কোহেরার ব্যাপারটা যে নিতান্তই ব্র্যানলির আবিষ্কার তা নয়। তবে তিনিই প্রথম এই কোহেরার দিয়ে অদৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে চিনে নেওয়ার কাজটা গুছিয়ে করতে পেরেছিলেন। পরে তাঁর কাজের ওপর ভিত্তি করেই জগদীশচন্দ্র বা অন্যেরা বেতার তরঙ্গের সঞ্চালনের কাজটা আরও সফলভাবে করতে পেরেছিলেন।
২. সুতরাং কোহেরার নিয়ে যাঁর কৃতিত্ব সবচেয়ে বেশি, তিনি ফরাসী বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড ব্র্যানলি (Edouard Branly, ১৮৪৪- ১৯৪০), এতে সন্দেহ থাকা উচিত নয়। ছোট থেকেই তাঁর পড়াশুনোয় বেশ মনোযোগ ছিল। একটু বড় হয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়বার জন্যেই ভরিত হন ইকোল নরমালে সুপিরিওরি নামে একটা প্রতিষ্ঠানে। তখন এখানকার প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন সেই বিখ্যাত লুই পাস্তুর। এখান থেকে পড়াশুনো করে ব্র্যানলি প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ার পদে চাকরি পান। পরে তাঁর পদোন্নতি হয়ে তিনি ডেপুটি ডিরেক্টর হয়েছিলেন।
১৮৭৩ সালে ব্র্যানলি ডক্টরেট করেন। এর আগে ফ্রান্স-প্রুশিয়া যুদ্ধের সময় তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও কাজ করেছিলেন। তবে যুদ্ধের পর, ১৮৭৫ সালে ব্র্যানলি এই চাকরি ছেড়ে চলে যান প্যারিসে, সেখানে সদ্য স্থাপিত হওয়া ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন অধ্যাপক হিসেবে। অবশ্য এরপরে তিনি আবার পথ পাল্টে চলে এসেছিলেন মেডিকেল লাইনে, ১৮৭৭ সালে ভরতি হন চিকিৎসাবিদ্যা পড়বার কোর্সে।
আশির দশকের শেষ দিকে এসে আমরা দেখি ব্র্যানলি অবশেষে আবার ফিরে গিয়েছেন পদার্থবিদ্যার জগতে। চিকিৎসাবিদ্যার বিষয় নিয়ে গবেষণা করলেও তিনি সফল হতেন নিশ্চয়ই, তবে তখন এই তরঙ্গবিদ্যা নিয়ে তাঁর কাজকর্ম অন্যদের যেভাবে প্রভাবিত করেছিল, সেটা আর ঘটত না সম্ভবত।
এই সময়েই তিনি বিভিন্ন তড়িৎ পরিবাহী পদার্থের নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই কাজেরই একটা ফলাফল হল ওই কোহেরার সংক্রান্ত আবিষ্কার। মোটামুটি ১৮৯০ সালের দিকে তাঁর এই আবিষ্কারের কথা সর্বসমক্ষে আসে। তিনি নিশ্চিতভাবেই দেখান যে কাছাকাছি কোনও উৎস থেকে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ (বা তড়িৎপ্রবাহও) যদি এই কাচনলের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে, তবে নলের তড়িৎ-পরিবাহিতা (অর্থাৎ কত ভালোভাবে তড়িৎ প্রবাহিত হতে পারে সেই ক্ষমতা) পরিবর্তিত হয়। তাছাড়া তিনি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন ‘রেডিও কন্ডাক্টর’, আর ওটাই বেতার-সংক্রান্ত দূরসঞ্চার ব্যবস্থায় রেডিও শব্দের প্রথম প্রয়োগ বলে স্বীকৃত। অবশ্য ব্র্যানলি এই ‘রেডিও’ বলতে বুঝিয়েছিলেন ‘রেডিয়েশন’ বা বিকিরণের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনও বিষয়।
ছবি। এডুয়ার্ড ব্র্যানলি
ব্র্যানলি আরও লক্ষ্য করেছিলেন যে খুব পাতলা ধাতব পাতের (থিন মেটালিক ফিল্ম) গায়ে যদি অদৃশ্য তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ এসে পড়ে, তবে ওই পাতের রোধ পাল্টে যায়। এই ব্যাপারটা দেখাবার জন্য তিনি কাচের ওপরে লাগানো পাতলা প্ল্যাটিনামের স্তর ব্যবহার করেছিলেন। পরে তিনি আরও নানারকম পদার্থ ব্যবহার করে নিশ্চিত হন যে ধাতব পদার্থের রোধ অদৃশ্য তরঙ্গের আপতনের ফলে পরিবর্তিত হয়ে থাকে। যদিও তিনি কোহেরার যন্ত্র ব্যবহার করেন ১৮৯১ সালে, আর তাঁর কোহেরারে কোনও পারদ ছিল না। যেটা ব্যবহার করবেন জগদীশচন্দ্র।
তবে অলিভার লজসাহেবই প্রথম এই কোহেরার যন্ত্রকে বাস্তবগ্রাহ্য, মানে আরও উন্নততর করে তোলেন। তিনি ব্র্যানলির প্রায় একই সময়ে ব্রিটেনে কোহেরার নিয়ে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। ব্র্যানলির চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে লজসাহেবই এই যন্ত্রের নাম দেন ‘কোহেরার’।
লজ সাহেব ১৮৯০ সালে লন্ডনের ইনস্টিটিউশন অব ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার্স-এর সভায় তাঁর এই ফলাফলগুলি প্রকাশ করেছিলেন, এবং আরও কিছুটা উন্নতি করে তাঁর তৈরি কোহেরার যন্ত্রকে প্রথমবার সাধারণের মধ্যে প্রকাশ করেন ১৮৯৪ সালে, রয়্যাল ইনস্টিটিউটে।
তাঁর এই কোহেরারের পেটেন্টও তিনি নিয়েছিলেন ১৮৯৭ সালে। আর প্রায় ওই সময়েই ইতালির গুগলিয়েমো মার্কনি এবং আমাদের দেশের জগদীশচন্দ্র এই কোহেরারকে ব্যবহার করতে থাকেন এবং সফলভাবে বেতার তরঙ্গ সঞ্চালন করতে থাকেন। তবে শেষ পর্যন্ত বেতার তরঙ্গ সঞ্চালনের স্বীকৃতি পেয়েছেন মার্কনি, এটাই যা দুঃখ আমাদের।
................
#Jagadish Chandra Bose #Radiowave #জগদীশচন্দ্র বসু #silly পয়েন্ট