বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (দ্বাদশ পর্ব)
পর্ব ১২। জগদীশচন্দ্রের বেতার গবেষণা : প্রদর্শন পর্ব
.................................
গবেষণাগারের ছোট্ট চৌহদ্দির মধ্যে বসে সম্পন্ন করা কাজকে নিয়ে এবার জনসমক্ষে প্রদর্শনের জন্য তৈরি হলেন জগদীশচন্দ্র।
এমনিতে এর আগে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ছাত্রাবস্থায় থাকাকালীন তাঁর প্রধান মেন্টর অধ্যাপক ফাদার লাঁফো তাঁকে ওই সময়টায় অনুরোধ করেই রেখেছিলেন যে কলকাতার সাধারণ মানুষদের সামনে তাঁর গবেষণার ফলাফল দেখিয়ে যেন তিনি প্রচার করতে শুরু করেন, শুধু নিজের বইয়েরই। আসলে ফাদার লাঁফো বিশ্বাস করতেন যে হাতেকলমে বিজ্ঞান-প্রদর্শনের বন্দোবস্ত না করলে দেশের মানুষকে এই বিষয়টার প্রতি আকৃষ্ট করা যাবে না। আমাদের সৌভাগ্য, জগদীশচন্দ্রও তাঁর গুরুর এই পরামর্শ শুনেছিলেন।
প্রথম প্রদর্শন ১৮৯৫-এর গোড়ার দিকে, স্থান: প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রদর্শনের জন্য নির্দিষ্ট করা একটা জায়গা, ওখানেই আয়োজন করা হয় এই ঘটনাকে চাক্ষুষ দেখবার। সেদিন জগদীশচন্দ্রের সহকর্মী রসায়নের অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ঘরের মধ্যে রাখা প্রেরক যন্ত্র থেকে অদৃশ্য বিকিরণ উৎপন্ন হয়ে প্রায় সত্তর ফুট দূরে আর এক অধ্যাপক আলেকজান্ডার পেডলারের ঘরে সেই বিকিরণ পৌঁছে যায় এবং সেখানে রাখা গ্রাহক যন্ত্রে তার অস্তিত্ব ধরা পড়ে। তারবিহীন অর্থাৎ কোনওরকম মাধ্যম ছাড়াই অদৃশ্য তরঙ্গের সাহায্যে যে বার্তা পাঠানো যেতে পরে, সে সম্ভাবনার অদৃশ্য একটা দ্বার যেন সেদিনই খুলে গিয়েছিল।
সমকালীন পত্রপত্রিকার খবরে একটা শব্দের উপস্থিতি লক্ষণীয় মনে হয়েছিল অনেকের: ‘Rumour। সত্যিই কি জগদীশচন্দ্র তাঁর কলেজে এরকম কোনও প্রদর্শন করেছিলেন? আর প্রত্যক্ষদর্শীরও কোনও স্মৃতিচারণ পাওয়া যায় না, খেয়াল করা দরকার।
এরপরে এল নভেম্বর মাস। কলকাতার টাউন হলে এক বড় আকারের সভার আয়োজন করা হয়েছিল সেদিন। বহু গণ্যমান্য মানুষজন সমবেত হয়েছেন সেদিন। সেই সভাতেই তাঁর নতুন আবিষ্কারকে কলকাতার বৃহত্তর দর্শকদের সামনে প্রত্যক্ষ করালেন জগদীশচন্দ্র। এই ঘটনার তারিখ এখনও জানা যায়নি।
টেবিলের ওপরে রাখা সেই যন্ত্র দেখে সকলে তো অবাক, বিস্মিত। সভায় সভাপতি হিসেবে তখন উপস্থিত আছেন বাংলার ছোটলাট বা লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার উইলিয়াম ম্যাকেঞ্জিও। বিপুল তাঁর দেহ। তিনিও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন এই তরুণ অধ্যাপকের সৃষ্টি করা যন্ত্রের যাদুক্রিয়া দেখতে।
সকলে প্রস্তুত। জগদীশচন্দ্র প্রথমে এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ব্যাখ্যা করলেন তার যন্ত্রের কর্মপদ্ধতি। তাঁর কথায় ফুটে উঠছে প্রবল আত্মবিশ্বাস। আর তাঁর ঘন কালো কোঁকড়ানো চুলের গুচ্ছ অল্প অল্প দুলছিল হাওয়ায়। সভার শ্রোতারা মুগ্ধ বিস্ময়ের সঙ্গে শুনছিলেন আজব সেই যন্ত্রে তৈরি হওয়া রশ্মির কথা। এই রশ্মিও নাকি এক ধরনের আলোই, শুধু চোখে দেখা যায় না এই হল তফাৎ। যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা এই অদৃশ্য আলো (বা অন্য কথায় বললে তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ) নাকি তিনটি ঘর পেরিয়ে একটা ঘরে রাখা পিস্তলকে সক্রিয় করে তুলবে, বেরিয়ে যাবে গুলি। এই ঘর থেকে শোনা যাবে সে শব্দ।
বক্তব্যের শেষে জগদীশচন্দ্র তাঁর তৈরি যন্ত্রের এক সুইচে চাপ দিলেন। অদৃশ্য সেই তরঙ্গ মুহূর্তের মধ্যে তিনটি ঘরের দেওয়াল, আর ম্যাকেঞ্জি সাহেবের বিরাট দেহ ভেদ করে ছুটে চলে গেল পঁচাত্তর ফুট দূরত্বের একটা ঘরে, আর এই ঘর থেকে সবাই শুনতে পেল পিস্তল থেকে গুলি বের হওয়ার আওয়াজ! শুধু তাই নয়, সেখানে রাখা একটা গোলার বিস্ফোরণের শব্দও শোনা গেল, সেই ঘরটা ভরে গেল বারুদের স্তুপ ফেটে তৈরি হওয়া ধোঁয়ায়।
সেদিন যে আশ্চর্য ঘটনা প্রত্যক্ষ করলেন কয়েক হাজার দর্শক, সকলে ধন্য-ধন্যও করল বটে; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না। তাঁর গবেষণার জন্য অর্থসাহায্য করতে এগিয়ে এল না কোনও বাঙালি, বা সরকারপক্ষ থেকেও দেখা গেল না তাঁকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার কোনও উদ্যোগ। তবে সেই ঘটনার রেশ পৌঁছে গেল ইংল্যান্ডে। যেখানে জগদীশচন্দ্র পৌছবেন মাস কয়েক পরে।
বৈজ্ঞানিক পেপার প্রকাশ
এই ১৮৯৫ সালটি অন্য একটি কারণেও জগদীশচন্দ্রের জীবনে খুবই স্মরণীয়, কারণ এ বছরের মে মাসের এক তারিখে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির সভাগৃহে তিনি পাঠ করলেন তাঁর প্রথম বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ। নাম ‘on Polarisation of Electric rays by Double-Refracting Crystals’ (আলো বা অন্য যে কোনও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের একটি বিশেষ ধর্ম এই ‘পোলারাইজেশন’ বা সমবর্তনের মতো কিছু পরীক্ষা, ওই প্রসঙ্গে আমরা পরের অধ্যায়ে বিস্তারিত বলব)। সভার বিবরণী থেকে জানা যায় যে এই সভায় সভাপতি ছিলেন ডঃ রুডলফ হর্নলে। তাঁর গোটা নাম হল August Friedrich Rudolph Hoernle। জীবনকাল ১৮৪১ থেকে ১৯১৮ সাল। ছিলেন অ্যাংলো-জার্মান প্রাচ্যবিদ। ভারতে জন্ম তাঁর, লন্ডনে পড়াশুনো। সংস্কৃত শিখেছিলেন থিওডোর গোল্ডস্টুকার-এর কাছে। পরে ভারতে এসে ১৮৮১-তে ক্যালকাটা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল হন, ১৮৯৯-তে সেখান থেকে অবসর নিয়ে অক্সফোর্ডে চলে যান। আর ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজেরই রসায়ন বিভাগের দুই অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও চন্দ্রভূষণ ভাদুড়ি। সেইসময় সোসাইটির সভাপতি ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক আলেকজান্ডার পেডলার। আলেকজান্ডার সাহেব পরের বছর ফেব্রুয়ারির বার্ষিক অধিবেশনে জগদীশচন্দ্রের গবেষণার উচ্চ প্রশংসাও করেন।
সোসাইটিতে পাঠ করা এই লেখাটি সোসাইটির মুখপত্রে প্রকাশিত হল সেই বছরের জুন মাসে [* vol 64, 291-296 pp.]। জগদীশচন্দ্র তাঁর এই সব আবিষ্কারের কথা গুছিয়ে লিখে একটি পুস্তিকা আকারে পাঠালেন লন্ডনে তাঁর শিক্ষকদের কাছে। সেখানকার বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন তো তাঁর এই কাজের খবর জেনে মুগ্ধ! তাঁর আবিষ্কার প্রদর্শনের খবর ততদিনে পৌঁছে গিয়েছে সে দেশের সংবাদমাধ্যমের কাছেও। লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় লেখা হল বেশ কিছু ভালো-ভাল কথা। এই পত্রিকা সাধারণত নেটিভ ভারতীয়দের কাজের খুব একটা গুরুত্ব দিতেন বলে তো মনে হয় না।
এর পরে তাঁর আরও দুটি প্রবন্ধ জগদীশচন্দ্র পাঠান ইংল্যান্ডে তাঁর মাস্টারমশাই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে-র কাছে, তার মধ্যে দুটি বিখ্যাত ‘ইলেকট্রিশিয়ান’ পত্রিকায় প্রকাশ পেল সেই বছরেরই ডিসেম্বর মাসের সাতাশ তারিখ শুক্রবারে। লেখা-দুটির শিরোনাম ‘on double refraction of the electric ray by a strained dielectric’ এবং ‘On a new electropolariscope’।
এর পরে তাঁর আরও একটি লেখা ‘on the Determination of the Indices of Refraction of Sulphur for the Electric Ray’ লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটিতে প্রেরিত হয় এবং সেটাও সোসাইটিতে গৃহীত হয়, সে বছরের ১৩ই ডিসেম্বর পঠিতও হয়, পরে সোসাইটির কার্যবিবরণীতে (Proceedings of royal society) প্রকাশ পায় সেই বছরের ৫৯-তম খণ্ডে, ১৮৯৬ সালের জানুয়ারি মাসে।
বিদেশ থেকে ডিএসসি লাভ
১৮৯৬ সালের প্রথম দিকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ‘On the Determination of the Wavelength of Electric radiation by Diffraction grating’ নামে একটি প্রবন্ধ পাঠান, এই লেখাটা পাওয়ার পরে বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিয়ম না মেনে জগদীশচন্দ্রকে দূর থেকেই (অর্থাৎ তাঁর সে দেশে অনুপস্থিতি স্বত্ত্বেও) সম্মানিত করলেন ডিএসসি ডিগ্রি দিয়ে। তাঁর ওই লেখার পরীক্ষক ছিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জন হেনরি পয়েন্টিং এবং জোসেফ জন থমসন। [* বিমলেন্দু মিত্র তাঁর জগদীশ-জীবনী বইয়ের ৩৫ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম দিয়েছেন ‘লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডিএসসি’, এই শিরোনামটি ঠিক নয়। জগদীশচন্দ্রের বড় ভায়রাভাই অর্থাৎ সরলা দেবীর স্বামী প্রসন্নকুমার রায় ১৮৭৬ সালে লন্ডন আর এডিনবরা দুটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডিএসসি উপাধি লাভ করেন। তিনিই প্রথম ভারতীয় ডিএসসি।
সুতরাং দেশের এক ‘কালা-আদমি’র জয়যাত্রা সাগরপারে ততদিনে যে শুরু হয়ে গেছে, আশা করি তা আর বলে দিতে হবে না।
পুস্তিকা প্রকাশ, লর্ড কেলভিনকে প্রেরণ
প্রেসিডেন্সি কলেজে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এবং ফলাফল একটি পুস্তিকার মাধ্যমে লিখে প্রকাশ করেছিলেন জগদীশচন্দ্র। পুস্তিকাটির নাম ‘An Account of experimental researches carried out at the Physical Laboratory of thr Presidency College in the year 1895’। এই পুস্তিকাটি জগদীশচন্দ্র পাঠিয়েছিলেন বিলেতের লর্ড কেলভিন সাহেবকে। তিনি এই লেখাটি পড়ে খুব খুশি হয়েছিলেন এবং নিজের প্রবন্ধাবলির একটি সংকলন জগদীশচন্দ্রকে পাঠিয়েছিলেন।
লর্ড কেলভিন জগদীশচন্দ্রকে একটি চিঠি লেখেন ১৮৯৬ সালের এপ্রিল মাসের চোদ্দ তারিখ। সেই চিঠিতে প্রশংসা তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল এ দেশে একটা ভালো মানের গবেষণাগার গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করবার কথাও।
লর্ড র্যালে-র ভারতে আগমন
কেমব্রিজে জগদীশচন্দ্রের মাস্টার মশাই লর্ড ভারতে এলে তাঁর ছাত্র জগদীশচন্দ্র র্যালে সাহেবকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ল্যাবরেটরি ঘুরিয়ে দেখান। সেই সঙ্গে স্যারের কাছে অনুরোধ করেন যে তাঁকে বিদেশে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হয়। প্রিয় ছাত্রের কাছে তাঁর বিদেশ যাত্রার ইচ্ছে দেখে লর্ড র্যালে চিঠি লিখলেন তখনকার ভারতসচিব জর্জ হ্যামিলটন-এর কাছে। ওই চিঠি এবং ওর সঙ্গে বড়লাট লর্ড ম্যাকেঞ্জির সুপারিশ, দুইয়ের প্রভাবে শিক্ষাদপ্তর জগদীশচন্দ্রের ছুটি মঞ্জুর করল। সরকারীভাবে ঘোষণাটা হয় ১ জুলাই, ১৮৯৬ তারিখে।
উপসংহার
জগদীশচন্দ্রের প্রথম বৈজ্ঞানিক সফর শুরু হয় ওই ১৮৯৬ সালের জুলাই মাসেই। আমরা সে প্রসঙ্গে আপাতত যাব না। বরং আগামী পর্বে আলোচনায় আনব সেই উদ্ভাবককে, যাঁকে ‘বেতার-সঞ্চালনের জাদুগর’ বলা হচ্ছে অনেক কাল আগে থেকেই। তাঁর নাম এবং কাজের কথা বলার পাশাপাশি ইতালীয় ইঞ্জিনিয়ার এবং নোবেলজয়ী গুগলিয়েমো মার্কনি ঠিক কোন পদ্ধতি মেনে আটলান্টিকের এপার থেকে অন্যপারে বেতার বার্তা পাঠালেন, সেই বিবরণও আমরা বলব, পরের পর্বে।
.......................................
পূর্ববর্তী পর্ব পড়ুন - বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (একাদশ পর্ব)