বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (সপ্তম পর্ব)
পর্ব ৭। তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ উৎপাদন ও প্রেরণের সূচনা: হেইনরিখ হাৎর্জ-এর কথা
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ যে কী সেটা ম্যাক্সওয়েল আবিষ্কার করলেন, এবং তার সঙ্গে আলো নামক বিকিরণের সাদৃশ্যও দেখালেন বটে, তবে তাঁর অকালমৃত্যু তাঁকে এই বিষয়টা নিয়ে এর চেয়ে বেশি দূর এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিল না আর। মাত্র আটচল্লিশ বছর বয়সে যখন তিনি ক্যান্সারে ভুগে মৃত্যুর দোরগোড়ায়, তখনও নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত বই ‘ট্রিটিজ অন ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম’-এর দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরির কাজে। অবশ্য মৃত্যু এসে তাঁকে সে কাজ শেষ করতে দেয়নি। এই সংস্করণটি শেষ করতে পারলে, অনেকেরই অনুমান যে এই তত্ত্ব তাঁর হাতে আরও কিছুটা সংশোধিত হত।
তবে আমাদের সৌভাগ্য যে তাঁর প্রয়াণেও এই সংক্রান্ত কাজ থেমে থাকেনি, আরও এক ঝাঁক নবীন-প্রবীণ বিজ্ঞানীর হাতে কাজটা রিলে-রেসের মতো চালু ছিল। এই বিজ্ঞানীদের, যাঁরা ম্যাক্সওয়েলের আরব্ধ কাজ শেষ করবার ব্রত নিয়ে লেগে পড়েছিলেন, এঁদের এখন নাম দেওয়া হয়েছে ‘ম্যাক্সওয়েলিয়ান’। আমাদের জগদীশচন্দ্র বসুকেও এই ম্যাক্সওয়েলিয়ানদের প্রথম প্রজন্মের মধ্যেই ফেলা হয়ে থাকে।
ম্যাক্সওয়েলের মৃত্যুর বছর চারেক বাদে ১৮৮৩ সালে ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজের অধ্যাপক জর্জ ফ্রান্সিস ফিটজেরাল্ডই (George Francis FitzGerald, ১৮৫১ - ১৯০১) প্রথম বলেন যে ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করা অসম্ভব কিছু নয়। কম্পনশীল প্রবাহিত তড়িতের সাহায্যে এই ধরনের তরঙ্গ তৈরি করা যেতে পারে। ফিৎজেরাল্ড, আরও অনেকের মতোই এই তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েলের লেখা ‘ট্রিটিজ অন ইলেক্ট্রিসিটি অ্যান্ড ম্যাগনেটিজম’ বইটি পড়বার পর। তবে তিনিও এই তরঙ্গ তৈরির উপযুক্ত কোনও বাস্তব পরীক্ষা করে দেখাতে পারেননি।
অবশ্য ফিৎজেরাল্ডের কৃতিত্ব অন্য এক জায়গায়, তিনিই ১৮৯২ সালে বিখ্যাত ‘সায়েন্স’ পত্রিকায় লেখা একটা চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে গতিশীল বস্তুর দৈর্ঘ্য কমে যায়। পরবর্তীকালে আলবার্ট আইনস্টাইন যে আপেক্ষিকতাবাদের বিশেষ তত্ত্ব আবিষ্কার করবেন বিশ শতকের শুরুর পাঁচটা বছর কেটে যাওয়ার পর, সেই তত্ত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এই ‘দৈর্ঘ্য সংকোচন’, যেটা প্রথম জানিয়েছিলেন জর্জ ফিৎজেরাল্ড। আর তাঁর এই সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা ছিল দুই আমেরিকান বিজ্ঞানী আলবার্ট মিকেলসন এবং এডোয়ার্ড মরলে-র করা এক পরীক্ষারও। ওই পরীক্ষা করেই তাঁরা ইথার নামে মাধ্যমটা যে বাস্তবে নেই, সেই সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন। অবশ্য আরও বছর সাতেক বাদে আর এক ডাচ বিজ্ঞানী হেন্ড্রিক লোরেঞ্জ এই একই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন আলাদা পথ বেয়ে, তাই এখন এই দুজনের নামেই ব্যাপারটা ‘ফিৎজেরাল্ড-লোরেঞ্জ লেন্থ কনট্র্যাকশন’ (দৈর্ঘ্য সংকোচন-কে ইংরেজিতে ‘লেন্থ কনট্র্যাকশন’ বলে) নামে খ্যাত হয়েছে।
২.
কিছুটা তাঁর বই পড়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হারম্যান ফন হেল্মহোল্টজ-এর উৎসাহেই জার্মান বিজ্ঞানী হেইনরিখ হাৎর্জ (Heinrich Hertz, ১৮৫৭-১৮৯৪) তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ তৈরি করবার চেষ্টা এবং সেই তরঙ্গের যে আলোকীয় ধর্ম রয়েছে সেটা প্রমাণ করবার কাজ শুরু করেন।
বয়সে ইনি ছিলেন আর একজন ‘ম্যাক্সওয়েলিয়ান’ অলিভার লজ সাহেবের চেয়ে বছর ছয়েকের ছোট। ১৮৫৭ সালের বাইশে ফেব্রুয়ারি জার্মানির হামবুর্গ শহরে এঁর জন্ম। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনোর পাশাপাশি আগ্রহের সঙ্গে শিখেছিলেন আরবী এবং সংস্কৃত ভাষা। বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করার পর তিন বছর বিখ্যাত বিজ্ঞানী হারম্যান হেল্মহোলজ-এর কাছে সহকারী হিসেবে গবেষণা করেন তিনি। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতে থাকেন। গুরু হেল্মহোলজের পরামর্শেই তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে কাজ শুরু করেন হাৎর্জ। দেখা গিয়েছিল যে প্রায় একইসময়ে অলিভার লজসাহেব আর হাৎর্জসাহেব তরঙ্গের উৎপাদন আর গ্রহণ করার পদ্ধতি নিয়ে কাজ করছিলেন।
১৮৮৬ সাল। নভেম্বরের তেরো তারিখ। তখন হাৎর্জ জার্মানির কার্লশ্রুহে-র টেকনিক্যাল ইউনিভারসিটি-তে অধ্যাপনা করছেন, তৈরি করলেন তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। প্রথমে আবেশ কুণ্ডলী আর লেইডেন জারের সাহায্যে এই তরঙ্গ তৈরি করে তারপর একটু দূরে একটা রুমকর্ফ স্পার্ক গ্যাপ যন্ত্রের সাহায্যে আলাদা করে রাখা দুটো ধাতব গোলকের মধ্যে ওই তরঙ্গের অস্তিত্ব টের পাওয়ার মধ্যে দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, সত্যি-সত্যিই এবার আসতে চলেছে বিপ্লব। তিনি এই তরঙ্গের তরঙ্গদৈর্ঘ্য হিসেব করে বের করতে পেরেছিলেন, আর সেটাকে কাজে লাগিয়ে বের করেছিলেন এর বেগও। তাঁকে অবাক করে দিয়ে সেই বেগের মান আলোর বেগের সঙ্গে একেবারে মিলে যায়। প্রমাণিত হয়, তাঁর যন্ত্রে তৈরি তরঙ্গ আর আলো দুটোই একই— তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ!
তরঙ্গ তৈরি করবার আর তাকে অনুধাবন বা তার অস্তিত্ব প্রমাণ করবার যন্ত্র, যেগুলোকে পরিভাষায় ‘এমিটার’ আর ‘ডিটেকটর’ বলে, দুটোই তিনি তৈরি করলেন। খুব বেশি মাপের ভোল্টেজ তৈরি করে, তা থেকে সামান্য ফাঁক রাখা দুটো বড় ধাতব গোলকের মধ্যে স্পার্ক তৈরি করে দেখালেন (এটা ‘এমিটার’ বা তরঙ্গের নিঃসারক); আর তা থেকে কিছু দূরে (তাঁর পরীক্ষায় এই দূরত্ব ছিল প্রায় দেড় মিটার) দুটো ছোট ধাতব গোলকের মধ্যে স্পার্ক জন্ম নিল (এটা ‘ডিটেকটর’ বা ধারক, যা কোনও তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গকে ধারন করে তার কম্পাঙ্ক, তরঙ্গদৈর্ঘ্য বা দশা সম্বন্ধে কিছু তথ্য জানাতে পারে)। বড় গোলক দুটি রাখা ছিল একটা ধাতব চকচকে অধিবৃত্তাকার আয়নার কেন্দ্রে।
নানারকম পরীক্ষা করবার পর হার্জ বুঝলেন তাঁর তৈরি তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের সঙ্গে খুবই মিল রয়েছে দৃশ্যমান আলোর। তিনি এই তরঙ্গের প্রতিফলন, প্রতিসরণ বা সমবর্তন-এর মতো কিছু আলোকীয় ঘটনা (মানে যেগুলো আলোর ক্ষেত্রে দেখা যায়) পরীক্ষা করে দেখান, এবং এই আবিষ্কারের কথা গুছিয়ে লিখে প্রকাশ করেন ১৮৮৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘On Electromagnetic Effects Produced by Electrical Disturbances in Insulators’ বইয়ে। এই বইটি তিনি বার্লিনের অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স-এও পাঠিয়েছিলেন।
৩.
হাৎর্জ যদিও যে ধরনের তরঙ্গ নিয়ে কাজ করেছিলেন সেগুলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য ছিল ত্রিশ সেন্টিমিটার থেকে আট মিটার অবধি। এই সীমানা আজ রেডিও তরঙ্গের পাল্লার মধ্যেই পড়ে। তখন তাঁর তৈরি তরঙ্গের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘হাৎর্জিয়ান ওয়েভ’, পরে একে বেতার তরঙ্গ হিসেবে ডাকা শুরু হয়।
কিন্তু তিনি এই তরঙ্গ প্রেরণ করার মধ্যে ভবিষ্যতের অমিত সম্ভাবনাময় বার্তা প্রেরণের মতো কোনও ব্যাপার যে লুকিয়ে রয়েছে, সেটা ভাবতেই পারেননি। হার্জ লিখেছিলেন, ‘It’s of no use whatsoever […] this is just an experiment that proves Maestro Maxwell was right— we just have these mysterious electromagnetic waves that we cannot see with the naked eye. But they are there.’ তিনি এক পূর্বসূরির স্বপ্ন সফল করেছেন, ব্যস। এইটুকুই। এর বাস্তব বা ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে তিনি আর মাথাই ঘামালেন না। বরং পরে, ১৮৮৯ সালের দিকে তিনি আবারও বলেছিলেন, এইভাবে তরঙ্গের মাধ্যমে শব্দসংকেত বেশি দূরে কখনই পাঠানো যাবে না; কারণ সেটা সম্ভব করতে গেলে প্রেরক অ্যান্টেনার দৈর্ঘ্য হতে হবে তিনশো কিলোমিটারের মতো!
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ উৎপাদন আর কিছু দূরে প্রেরণ— এইটুকুই সাফল্যের সঙ্গে করবার পর হাৎর্জ উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, মনোযোগ দেন অন্য বিষয়ের দিকে। সেটার নাম আলোকতড়িৎ ক্রিয়া। বিশেষ কিছু ধাতুর ওপর বিশেষ ধরনের আলো ফেললে ওই ধাতুর মধ্যে থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলেকট্রন কণা বেরিয়ে আসতে থাকে, এবং কণা স্রোতকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করা যায় তড়িৎ। আজকের দিনে আমরা যে সব বড়-বড় সোলার বাইত দেখি, সে সবের পেছনে আছে এই আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ভূমিকা।
হেইনরিখ হাৎর্জের সম্মানে তরঙ্গের কম্পাঙ্কের এককের নাম রাখা হয়েছে ‘হাৎর্জ’ (Hertz), এর আগে কম্পাঙ্ককে মাপা হত ‘সাইকেলস পার সেকেন্ড’, অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে কয়টি পূর্ণ আবর্তন হচ্ছে। এখন ‘হাৎর্জ’ নামের এককটাই সব জায়গায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
হাৎর্জ মারা যান মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯৪ সালের পয়লা জানুয়ারি, জার্মানির বন শহরে; রক্তের সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে। তাঁর মৃত্যুর পর অলিভার লজ রয়াল সোসাইটিতে একটি বক্তৃতা দেন, বিষয় ছিল ‘Heinrich Hertz and His Successors’।
এই বক্তৃতাটি বই আকারেও প্রকাশিত হয়েছিল। আর প্রায় নিশ্চিত করেই আমরা বলতে পারি যে জগদীশচন্দ্র বইটি পড়েছিলেন। আর এই বই পড়েই তাঁর মনে হয়তো জেগে ওঠে ক্ষুদ্র তরঙ্গদৈর্ঘ্য বিশিষ্ট তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ নিয়ে কাজ করবার কথা। তবে এর আগে বিদেশে পড়াশুনো করার সময়ও তিনি তরঙ্গ নিয়ে পুরনো বইপত্রও পড়ে ছিলেন নিশ্চয়ই। সব মিলিয়ে তিনি এরপর যখন পুরোদস্তুর গবেষণায় নেমে পড়লেন, তাঁকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হল না। তবে সে বিবরণ আমরা বলব, পরের কোনও এক পর্বে।
জীবনের শেষ দিকে হাৎর্জ অদৃশ্য আলোর ভেদনক্ষমতা নিয়েও চিন্তাভাবনা করছিলেন; আশা করা যায় যে আরও কিছু বছর বাঁচলে তিনি এক্স-রশ্মিও আবিষ্কার করে ফেলতেন। প্রায় তাঁর মৃত্যুর সময় থেকেই মূলত এই তরঙ্গ সংক্রান্ত তাঁর কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ভাবনাচিন্তা শুরু করেন জগদীশচন্দ্র এবং ইতালীয় উদ্ভাবক গুগলিয়েমো মার্কোনি দুজনেই। পরে এই মার্কনির মাথাতেই উঠেছিল বেতার তরঙ্গ উৎপাদন ও প্রেরণের মাধ্যমে বার্তা সঞ্চারণ করবার কৃতিত্ব হিসেবে নোবেল পুরস্কার। আর বঞ্চিত করা হয়েছিল জগদীশচন্দ্রকে, বা অন্য অনেককেও। তবে সে অন্য প্রসঙ্গ।
তাই এই জর্জ ফিৎজেরাল্ড আর হেইনরিখ হাৎর্জ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী হাৎর্জের আগে-পরে এই সংক্রান্ত কাজে মাথা এবং শ্রম দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম আর কাজের কথা সামান্য আলোচনা করে নেব আমরা, পরের পর্বে। তারপর আসব জগদীশচন্দ্রের কাছে।
...............................
১/ ফিৎজেরাল্ডের কাজ নিয়ে জানতে
https://www.lindahall.org/about/news/scientist-of-the-day/george-francis-fitzgerald
২/ হাৎর্জ-এর কাজ নিয়ে জানতে
ক/ https://www.juliantrubin.com/bigten/hertzexperiment.html
#Jagadish Chandra Bose #Radiowave #জগদীশচন্দ্র বসু #silly পয়েন্ট