বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (নবম পর্ব)
পর্ব ৯। আরও একজন ‘ম্যাক্সওয়েলিয়ান’-এর কথা
.....................
আমাদের দেশে অধ্যাপক জগদীশচন্দ্র বসু যখন প্রেসিডেন্সি কলেজের একটা ছোট্ট ঘরে বসে তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের নানা ধর্ম পরীক্ষা করে দেখছেন, ঠিক ওই সময়েই বহু দূরের ব্রিটেনে অলিভার লজ দারুণ বৈভবের মধ্যে আবিষ্কার করছেন কোহেরার নামে একটি যন্ত্র, যেটাকে এই তরঙ্গ ধারণ করবার কাজে দারুণভাবে কাজে লাগানো যাবে। আবার ওই একই সময়ে আরও দূরের রাশিয়ায় এক ইঞ্জিনিয়ার-গবেষক বানিয়ে ফেলেন ওই একই ধরনের কোহেরার, যদিও সেটা ছিল আরও বেশি উন্নত।
তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গের নানা ধর্ম বা বৈশিষ্ট্যকে চিনে নেওয়া বা এর সাহায্যে বার্তা প্রেরণের কাজে যাঁদের অবদান সবচেয়ে বেশি, আগের পর্বে বলেছিলাম সেরকমই একজন মানুষ অলিভার লজের কথা। এবারের পর্বে আমরা বলব সেই মানুষটির কথা, যিনি প্রায় ওই একই সময়ে অন্য একটা দেশে বসে ওই একই কাজ করে যাচ্ছিলেন। এবং সফলও হয়েছিলেন পুরোপুরি একার প্রচেষ্টাতেই।
২. এই মানুষটির নাম আলেকজান্ডার স্টেপানোভিচ পোপভ (Alexander Stepanovich Popov)। তাঁর জন্ম রাশিয়ায়, ১৮৫৯ সালের ৪ মার্চ। হিসেবমতো বয়সে তিনি জগদীশচন্দ্রের চেয়ে মাস চারেকের ছোট। অল্প বয়স থেকেই তাঁর বিজ্ঞানের প্রতি বেশ টান লক্ষ করা যাচ্ছিল। যদিও তাঁর বাবা চাইতেন ছেলে পাদ্রিগিরি করবার দিকেই ঝুঁকুক, অবশ্য ছেলে অন্য ধাতুতে গড়া, তিনি ধর্মতত্ত্ব পড়বার স্কুলে ভরতি না হয়ে চলে গেলেন সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে ভরতি হলেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়বার জন্য।
এখানেই তিনি পরে পাশ করবার পর পড়ানোর কাজে যুক্ত হন। পড়াতেন গণিত। কিন্তু ললাটের লিখনেই হয়তো, এরপর তিনি যুক্ত হয়ে পড়লেন সে দেশের নৌবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত একটি স্কুলের প্রশিক্ষক হিসেবে, সেখানে তিনি উঠতি সেনাদেরকে নানা ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতির সঙ্গে পরিচয় ঘটাতেন। এখানকার লাইব্রেরিটাও তাঁর বেশ উপকারে লাগত, তড়িৎবিদ্যা নিয়ে প্রচুর বই তিনি এখানেই পড়ে ফেলেন। আর ওই সময়েই তিনি জানতে পারেন জার্মানির হেইনরিখ হাৎর্জ-এর কথা। তাঁর মাথায় এটা ঘুরতে থাকে যে এই ধরনের তরঙ্গকে অনেক দূরের কোথাও পাঠানোর পর কীভাবে ধারণ করা যায়। আর ওই সময়েই ব্রিটেনে অলিভার লজ যে এই ধরনের তরঙ্গ তৈরি করে একশো ফুটেরও বেশি দূরে রাখা যন্ত্রে তার অস্তিত্বের প্রমাণ পেয়েছেন, সে খবর তাঁর কানে আসে। লজ যে কাচের তৈরি এক ধরনের লম্বা নল (যার মধ্যে রাখা আছে লোহার গুঁড়ো) দিয়ে কোহেরার বানিয়েছেন, জানতে পারেন তা-ও। অবশ্য এই কোহেরার যন্ত্র যে পুরোপুরি লজ সাহেবের তৈরি এমনটা কিন্তু নয়, তাঁরও তিন বছর আগে ফরাসি পদার্থবিজ্ঞানী এডুয়ার্ড ব্র্যানলি বানিয়েছিলেন এই কোহেরার। তাঁর কথা আমরা অন্য একটা পর্বে বলব।
পোপভ এরপর আলাদা এক ধরনের কোহেরার বানানোর চেষ্টা করতে শুরু করেন, যেটা লজ-এর কোহেরারের চেয়ে আরও বেশি সূক্ষ্ম তরঙ্গের অস্তিত্বকে জানান দিতে পারবে। তাঁর মাথায় ঘুরছিল অন্য একটা চিন্তাও— যদি এই ধারক যন্ত্র দিয়ে বজ্রপাতের সময়ে যে তরঙ্গ তৈরি হয় সেটাকেও ধারণ করে দেখানো যায়, তাহলে হয়তো বাজ পড়বার আগেই এই যন্ত্র জানান দিতে পারবে, আসন্ন বজ্রপাতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। পরীক্ষার পর এ কাজেও তিনি সফল হয়েছিলেন।
বিভিন্ন সময়ব্যাপী সিগন্যালগুলোকে আলাদাভাবে চেনার কাজে তাঁর কোহেরারকে তিনি উপযুক্ত করে বানিয়েছিলেন। সেই সঙ্গে এই কোহেরারকে এক-একবার ব্যবহারের পর ঝাঁকিয়ে আবার ব্যবহারের উপযুক্ত করতে লাগত না, এ জন্যও অন্য ব্যবস্থা করা গিয়েছিল।
১৮৯৫ সালে পোপভ তাঁর এই কাজ সংক্রান্ত একটা পেপার প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি লেখেন বজ্রপাতের সময় যে বিদ্যুৎ-চমক তৈরি হয় সেটাকে কীভাবে বিনা তারেই মাটিতে রাখা ধারক যন্ত্রে ধারণ করা যায়। ওই ধরনের একটা যন্ত্র তৈরি করে সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিওকেমিক্যাল সোসাইটির সদস্যদের সামনে ১৮৯৫ সালের মে মাসে হাজির হলেন পোপভ, দেখালেন তাঁর যন্ত্রের কারিকুরি।
এর পরের বছর, মানে ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসের চব্বিশ তারিখে ওই একই জায়গায় বিজ্ঞানীদের সামনে আরও একটা পরীক্ষার মাধ্যমে হার্জের তৈরি তরঙ্গকে (যাকে বলা হত ‘হাৎর্জিয়ান ওয়েভ’) সত্যি-সত্যিই যে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পাঠানো যায় সেটা দেখালেন পোপভ, দেখল সকলে। ২৪৩ মিটার ব্যবধানের দুটো বিল্ডিংয়ের মধ্যে বেতার তরঙ্গের সাহায্যে মোর্স কোড জাতীয় সঙ্কেতকে পাঠিয়ে এবং ধারণ করে পোপভ দেখালেন যে এই পদ্ধতিতে বার্তা পাঠানো সম্ভব। তাঁর বার্তা পেয়ে অন্য বিল্ডিংয়ে বসে থাকা এক অধ্যাপক ব্ল্যাক বোর্ডে লিখলেন সেই বার্তা, যেটা আসলে এই কাজের পথ প্রদর্শক বিজ্ঞানীর নাম: ‘Heinrich Hertz’! সকলেই তাজ্জব, এরকমও হতে পারে! অদৃশ্য পথ বেয়ে খবর চলে যেতে পারে এইভাবে?
সেদিনের বক্তৃতায় তিনি এমনটাও বলেছিলেন: ‘I can express my hope that my apparatus will be applied for signaling at great distances by electric vibrations of high frequency, as soon as there will be invented a more powerful generator of such vibrations.’
মাস কয়েক পর ওই বছরেরই জুলাই মাসে ইতালির গুগলিয়েমো মার্কনি ব্রিটেনে বসে এই একই ঘটনা ঘটাবেন, সে খবর পোপভ পেয়েছিলেন খবরের কাগজ পড়ে। মার্কনি প্রথমে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরত্বের দুটো জায়গার মধ্যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। আরও পরে পোপভ তাঁদের দেশে সমুদ্রের বুকের জাহাজ থেকে বন্দরে খবর পাঠানোর কাজে এই পদ্ধতি কাজে লাগান প্রথমে দশ কিলোমিটারের মধ্যে, কয়েক মাস পরে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় পঞ্চাশ কিমি। সেটা অবশ্য ১৮৯৮ সালের কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় পোপভ তাঁর এই আবিষ্কারের কোনও পেটেন্ট নেননি, বরং এর পর তিনি বিষয় পাল্টে চলে আসেন এক্স রশ্মি নিয়ে গবেষণার দিকে। এটা অবশ্য সকলেই মেনে নিয়েছেন যে মার্কনি এবং পোপভ দুজনেই নিজেদের কাজটা করেছিলেন একে-অন্যের কাজের খবর পাওয়ার আগেই।
মার্কনি শেষ পর্যন্ত বেতার বার্তা প্রেরণের প্রথম কারিগর হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন বটে, তবে পোপভ যে ওই একই সময়ে রাশিয়ায় একই কাজ করেছিলেন, এটা এখন স্বীকৃত। ভালো নাকি খারাপ খবর এটা বলা মুশকিল যে মার্কনির নোবেল পাওয়া তাঁর দেখতে হয়নি; মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয় ১৯০৬ সালের ১৩ জানুয়ারি, এর বছর তিনেক পর মার্কনি নোবেল পান।
১৯৪৫ সালে, যে বছর পোপভের ওই বজ্রধারক যন্ত্রের প্রথম প্রদর্শনটি ঘটবার পঞ্চাশ বছর পূর্তি হয়, ওই বছর থেকে এখনও রাশিয়ায় ৭ মে তারিখটি ‘রেডিও দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। কারণ পোপভ তাঁর পরীক্ষাটা প্রথম যেদিন দেখিয়েছিলেন, সেদিনের তারিখ ছিল ৭ মে।
......................
আলেকজান্ডার পোপভকে নিয়ে জানতে দুটো ভালো লেখা:
১/ http://scihi.org/alexander-popov-radio-receiver/
২/ https://spectrum.ieee.org/who-invented-radio-guglielmo-marconi-or-aleksandr-popov