বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বেতারের আদিযুগ ও জগদীশচন্দ্র (একাদশ পর্ব)

অর্পণ পাল Feb 10, 2024 at 6:59 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পর্ব ১১। জগদীশচন্দ্রের বেতার গবেষণা : সূচনা পর্ব

.....................


বিলেতের কেমব্রিজের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজ থেকে পড়াশুনো করে দেশে ফেরবার পর জগদীশচন্দ্র বসুকে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক পদে চাকরি দেওয়া হয়। কিন্তু বিদেশি শাসকদল-পরিচালিত সরকারি দপ্তর থেকে যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল অপেক্ষাকৃত নিচু পদের অস্থায়ী অধ্যাপকের চাকরি, যার প্রতিবাদে তিনি একটানা তিন বছর সরকারি মাইনের গোটাটাই প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। পরে তাঁর জেদের কাছে হার মেনে এবং তাঁর কর্মকুশলতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর পদটাকে স্থায়ী করা হয় এবং তাঁর বেতনকে ইউরোপীয় অধ্যাপকদের সমান পরিমাণ করে দেওয়া হয়। জগদীশচন্দ্র তাঁর কর্মজীবনে শুরু থেকেই যে নিজের মানসিক দৃঢ়তা বজায় রাখতে পেরেছিলেন, এটা তার বড় একটা প্রমাণ। 

অধ্যাপনাকালের প্রথম দিকেই তিনি বিয়ে করেন অবলা বসুকে। বাবা-মায়ের সঙ্গেই দিদি-জামাইবাবুর বাড়িতে কয়েক মাস থাকবার পর দু-জনে একাধিকবার বাসাবদল করেন, শেষে রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজের ডান পাশের একটি জমিতে নিজস্ব বাড়ি বানান শতাব্দের একেবারে শেষপ্রান্তে এসে। এরই পাশাপাশি তিনি নিজের উপার্জনের একা বড় অংশ সঞ্চয় করে রাখতেন, বেশ কয়েক বছর পর যে অর্থ দিয়ে তৈরি হয় তাঁর সাধের বসু বিজ্ঞান মন্দির। 

অধ্যাপনাকালের প্রথম দিকে আমরা দেখি যে জগদীশচন্দ্র মেতে থাকতেন নানা ধরনের শখের বিষয় নিয়ে। পারিবারিকভাবে তিনি ব্রাহ্ম ছিলেন, যে কারণে কলকাতার সমসাময়িক আলোকপ্রাপ্ত ব্রাহ্ম পরিবারগুলির সঙ্গে তাঁর মেলামেশা ছিলই। এরকমই দুটি পরিবার, রবীন্দ্রনাথদের জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি এবং উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর পরিবার, দু-তরফেই ঘনিষ্ঠতা ছিল তাঁর। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি ব্রাহ্মসমাজের অধিবেশনে একত্রে গানের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন, সেই গান আবার তাঁর শখের একটি ফোনোগ্রাফ যন্ত্রে রেকর্ড করবার ব্যবস্থাও করেছিলেন। আরও কয়েক বছর পর তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অন্যদিকে উপেন্দ্রকিশোরদের বাড়ি ছিল জগদীশচন্দ্রের বাড়ি থেকে খুবই কাছে, যে কারণে তাঁর ও বাড়িতে প্রায়ই পায়ের ধুলো পড়ত। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেমেয়েরা এই শ্যাম-বর্ণ কালো কোট প্যান্ট পরিহিত সাহেবি হাবভাববিশিষ্ট মানুষটিকে বেশ ভয় পেলেও তিনি ওদের সঙ্গে মিশতেন বন্ধুর মতোই। 

ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা, দেশের নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত কাল্টিভেশন অভ সায়েন্স-এর সভায় বক্তৃতা দেওয়া বা বক্তৃতা শুনতে যাওয়া, বা ইউরোপে সদ্য আবিষ্কৃত এক্স রশ্মির খবর শুনে নিজেই সেরকম একটি যন্ত্র বানিয়ে তা থেকে এক্স রশ্মি উৎপাদন করে সেই রশ্মি দিয়ে ভাঙা হাড়ের ছবি তোলা— এ ধরনের নানাবিধ কাজে জগদীশচন্দ্র বেশ কয়েক বছর কাটাবার পর এল সেই সন্ধিক্ষণ— ১৮৯৪ সাল, নভেম্বরের তিরিশ তারিখ। 

সেদিন ছিল তাঁর জন্মদিন। পরে নিজেই তিনি ডায়েরিতে লিখেছিলেন যে ওই দিনই তিনি সংকল্প করেন যে দেশের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করবেন। আর এই কাজে তিনি ব্যবহার করবেন তাঁর যেটা অধীত বিষয়— সেই বিজ্ঞানকেই। বিজ্ঞান গবেষণায় আমাদের দেশ ইউরোপীয় দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে, সেই ব্যবধান কমিয়ে এই দেশেও যে বিজ্ঞান গবেষণা হতে পারে, এটাই দেখাতেই যেন তাঁর এই সংকল্প। 

সুতরাং এই কাজের জন্য তাঁর প্রস্তুতির পুরোটাই ছিল তাঁর একার, গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা বা কাউকে সহকারী হিসেবে রাখা— এসবের সুযোগ ছিল না তাঁর কাছে। আর এক ইউরোপ-ফেরতা অধ্যাপক তখন তাঁর সহকর্মী, যদিও সেই প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তিনি তাঁর গবেষণার বিষয়ে খুব যে আলোচনা করবার সুযোগ পেতেন, এটা আমাদের মনে হয় না। অবশ্য প্রফুল্লচন্দ্রকে তিনি গবেষণার ফলাফল প্রদর্শনের দিনে সঙ্গী করেছিলেন। 


২. 

কিন্তু গবেষণা করবেন কোন বিষয় নিয়ে, সেটা তিনি ঠিক করলেন কীভাবে? এ জন্য অনেক জায়গায় একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা থাকে। জগদীশচন্দ্র কোনও এক পত্রিকার পাতায় একবার একটি নিবন্ধ পড়েছিলেন, যেখানে বলা ছিল যে ধু-ধু সমুদ্রের বুকে জাহাজের নাবিকেরা কীভাবে বিপদে পড়েন। পাড়ের কাছাকাছি থাকলে তবু লাইটহাউস থেকে নির্গত আলো তাঁদের কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে বন্দরে ফিরে আসতে সাহায্য করে। কিন্তু দিকচিহ্নহীন সমুদ্রের মাঝখানে কোথায় পাবেন লাইটহাউস? তাছাড়া অন্য সমস্যাও আছে: কুয়াশার মধ্যে লাইটহাউসের আলোও আবার বেশিদূর অবধি যায় না। 

এমনিতে আমরা জানি, যে আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য যত বেশি, সে আলোর বিক্ষেপণ তত কম হয়। এই কারণে সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের সময় আকাশ লাল দেখায়। আবার বিপদ-সঙ্কেত হিসেবে লাল আলো ব্যবহৃত হয় একই কারণে। এখন, জগদীশচন্দ্র ভাবলেন, যদি লাল আলোর চেয়েও বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য-বিশিষ্ট আলো, অর্থাৎ অবলোহিত আলোকে লাইটহাউস থেকে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়, তবে অনেক দূর থেকে সেই আলোকে চিনে নিতে পারলে জাহাজ হয়তো পথভ্রষ্ট হবে না। কিন্তু সেরকম আলোকে তো খালি চোখে দেখা যাবে না। তাহলে সে আলোর অস্তিত্ব টের পাওয়া যাবে কী করে? 

১৮৯৪ সালের সেই জন্মদিনে শুরু হওয়া গবেষণা-ক্ষণ থেকেই জগদীশচন্দ্রের মূল লক্ষ্য ছিল অদৃশ্য বেতার তরঙ্গ নিয়েই কাজ করা। এই ধরনের তরঙ্গকে বিভিন্ন ধারক যন্ত্রের (অর্থাৎ ডিটেক্টর) সাহায্যে ধারণ করে সেসবের ধর্ম যাচাই করার কাজেই প্রথম দিকে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন তিনি। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জার্নাল, পত্রপত্রিকা বা সদ্য-প্রকাশিত বই ভালো করে অধ্যয়ন করবার ফলে তিনি এটা জানতেন যে ওসব দেশের বিজ্ঞানীরা যে তরঙ্গ নিয়ে কাজ করছেন সে তরঙ্গ ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে। আর পাশাপাশি সে তরঙ্গের সঙ্গে কিছু ‘স্ট্রে ওয়েভ’ বা জঞ্জাল তরঙ্গ মিশে যায়। যেগুলোকে আলাদা করা দরকার। 


৩. 

এমনিতে কলেজে পড়ানোর কাজে তাঁকে সপ্তাহে ছাব্বিশ ঘণ্টা ব্যয় করতে হত। প্রেসিডেন্সি কলেজের পদার্থবিদ্যা বিভাগে সেইসময় কোনও গবেষণাগারও ছিল না। রসায়ন বিভাগে তাও কিছু রাসায়নিক এবং যন্ত্রপাতি ছিল। তাই নিজের মাইনের টাকায় কলেজেই অধ্যাপকদের বসার জায়গার পাশে যে বাথরুম, তারই এক পাশের একটা ছোট্ট ঘরে (কুড়ি স্কোয়ার ফুট মাপের) তিনি গবেষণা করার মতো ব্যবস্থা করে নিলেন। এক ঝালাইকর্মী ধরে এনে তাঁর সাহায্যে বানিয়ে ফেললেন কিছু যন্ত্রপাতি। তিনি ‘মনে করলেন, ‘অতীতে একদিন যে জাতি সামান্য উপকরণ থেকে বৃহৎ কর্মসাধন করেছে, আমরা তো তাদেরই বংশধর! অবশ্য অধিকাংশ ভারতীয়দের ধারণা ছিল, এদেশে মৌলিক বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয়।’ (* বসু বিজ্ঞান মন্দির থেকে প্রকাশিত জগদীশচন্দ্র-জীবনী, ২০ পৃ.) সুতরাং ভারতীয়দের এই দুর্নাম ঘুচাতেই শুরু হল তাঁর গবেষণা। আর মাত্র তিন মাসে তিনি ফল পেতে শুরু করলেন, যে কথা নিজেই বলেছিলেন পরবর্তীকালে, ‘তেইশ বছর পূর্বে অদ্যকার দিনে যে আশা লইয়া কার্য আরম্ভ করিয়াছিলাম, দেবতার করুণায় তিন মাসের মধ্যে তাহার প্রথম ফল ফলিয়াছিল।’ (* ‘বোধন’ শীর্ষক গদ্যের অংশ, ‘অব্যক্ত’ থেকে)। তবে অনেকে মনে করেন, তাঁর এই সংক্রান্ত কাজের জন্য মানসিক প্রস্তুতি চলছিল নিজের হাতে যন্ত্রপাতি গড়ে নিয়ে গবেষণায় লেগে পড়বার অনেক বছর আগে থেকেই। 

তাঁর ওই ‘অব্যক্ত’ বইয়েরই ‘হাজির!’ শীর্ষক রচনায় দেখি তিনি লিখছেন: ‘ছুতার কামার দিয়া তিন মাসের মধ্যে একটা কল প্রস্তুত করিলাম। তাহা দিয়া যেসব অদ্ভুত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইল তাহা আমার কথা দূরে থাকুক, বিদেশী বৈজ্ঞানিকদিগকে পর্যন্ত বিস্মিত করিল।’ (* ‘অব্যক্ত’ দে’জ সংস্করণ, ১৪৩ পৃ.)

এর পরে দু-বছরের মধ্যেই তাঁর একার পরিকল্পনায় তৈরি যন্ত্রপাতির সাহায্যে পরীক্ষা করে পাওয়া ফলাফলের  প্রদর্শন ঘটিয়ে বিজ্ঞানীমহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ— এই দু-পক্ষকেই চমকে দিতে সক্ষম হলেন। তাঁর জয়ের রথযাত্রা যেন শুরু হল। 

জগদীশচন্দ্রের এই জয়যাত্রার ধারাবিবরণী কিছুটা সংক্ষেপে আমরা বলব, এই ধারাবাহিক আলোচনার পরের  পর্বে।

…………………………………


#Jagadish Chandra Bose #Radiowave #জগদীশচন্দ্র বসু #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

42

Unique Visitors

183874