হিচককের সঙ্গে কাজ করেছিলেন বাঙালি চলচ্চিত্র-পরিচালক মধু বসু
.......................................
প্যাক আপ (পঞ্চম পর্ব) :
.......................................
''দেহপট সনে নট সকলি হারায়''। সময়ের চেয়ে বড় সুপারস্টার কেউ নেই। তার সামনে সবাই পকেট-সাইজ। সময় কারো রোয়াব দেখে না বেশিদিন। খ্যাতি? সে তো বালির বাঁধ। আজ যে রাজা, কাল সে ফকিরেরও ফকির। সত্যজিৎ রায়ের কোনও এক গল্পে একটি চরিত্র বলেছিল, অভিনেতারা আক্ষরিক অর্থেই 'শুটিং স্টার'। উল্কার মতো আসেন। উল্কার মতোই চলে যান। মানুষ অল্পেই মাথায় তুলে নাচে, তার চেয়েও অল্পে অবহেলাভরে মুখ ফিরিয়ে চলে যায় ক'দিন পর। বড় নিষ্ঠুর সেই গণ-প্রত্যাখ্যান। বড় অশ্লীল সেই গণ-বিস্মৃতি। বেঁচে থাকতে থাকতেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যান শতকরা নিরানব্বই ভাগ। বিরাট মাপের সুপারস্টারেরা মৃত্যুর পর দু' এক দশক অবধি টেনে দেন কোনওমতে। আসলে সময়ের চেয়ে বড় প্রবঞ্চক আর কে আছে! তার সাময়িক বশ্যতা- স্বীকারকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বলে ভেবে নিলেই পিঠে ছুরি খেতে হয়। সিলি পয়েন্টের এই নতুন ফিচার-সিরিজে আমরা তুলে আনব পুরোনো দিনের এমন কিছু অভিনেতার গল্প, যাঁদের আমরা আজ পরিপাটি ভুলে গেছি - অথচ সময় একদিন তাঁদেরও তাঁবেদারি করেছে। প্রতি শুক্রবার সিলি পয়েন্টের ফিচার-সিরিজ 'প্যাক আপ'। আজ পঞ্চম পর্বে ভারতীয় চলচ্চিত্রে সমান্তরাল ধারার পথপ্রদর্শক মধু বসু-র কাহিনি।
.............................................................................................................
চিত্রগ্রহণে বিশেষ দক্ষতা ছিল। ছায়াছবির সেই আদিযুগে জার্মানি গিয়ে চলচ্চিত্রের কলা-কৌশল শিখেছিলেন। সে কারণেই সুযোগ পেয়েছিলেন খোদ অ্যালফ্রেড হিচককের ছবিতে সহকারী-চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করার। মধু বসু ছাড়া আর কোনও বাঙালির এমন প্রত্যক্ষ হিচকক-যোগ নেই। তিনিই সম্ভবত হলিউডে কাজ করা প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র-ব্যক্তিত্ব। প্রখ্যাত এই বাঙালি চলচ্চিত্র-পরিচালকের ঝুলিতে ছিল আরও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক কাজের অভিজ্ঞতা। বাংলা তথা ভারতীয় সমান্তরাল ছবির পথপ্রদর্শক বলা যেতে পারে তাঁকে। অথচ আজ তিনি অনেকটাই বিস্মৃত।
জন্ম ১৯০০ সালে, কলকাতায়। আসল নাম সুকুমার বসু। পিতা বিখ্যাত ভূতত্ত্ববিদ প্রমথনাথ বসু। পড়াশোনা শান্তিনিকেতনে, পরে কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজে। বি এস সি পাশ করেই তিনি পা রাখেন সংস্কৃতি-জগতে। নাটক লেখা ও অভিনয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে নিতেই একদিন খ্যাতনামা প্রযোজক হিমাংশু রাইয়ের সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়। হিমাংশু সে সময় বিখ্যাত জার্মান চলচ্চিত্র-পরিচালক ফ্রাঞ্জ অস্টেনের সঙ্গে যৌথভাবে ‘Prem Sanyas : The Light of Asia’ নামে একটি ছবির কাজ করছিলেন। তাঁর সুপারিশে মধু বসু সেই ছবির প্রোডাকশন ও মার্কেটিং টিমে কাজ করেন। অস্টেনের সঙ্গে কাজের সূত্রেই মধু বসু জার্মানির বিখ্যাত এমেলকা স্টুডিওয় গিয়ে চলচ্চিত্রের বিভিন্ন টেকনিকাল বিষয়ে জ্ঞান লাভের সুযোগ পান। আর তারপরেই আসে হিচককের ছবিতে কাজের সুযোগ। হিচককের দ্বিতীয় ছবি ‘The Mountain Eagle’-এ ইতালীয় ক্যামেরাম্যান গেতানো ডি. ভেন্তিমিগলিয়ার সহকারী ছিলেন তিনি।
নিশ্চিতভাবেই এরপর হলিউডে আরও কাজের সুযোগ পেতেন। কিন্তু হঠাৎ অসুস্থতার কারণে ভারতে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। ফিরে আসার পর কিছুদিন নাট্য-চর্চা করেন। ১৯২৮ সালে প্রথমবার অভিনয় করেন পেশাদার মঞ্চে। কিন্তু নিজের ছবি তৈরির প্রস্তুতিও চলছিল একইসঙ্গে। ১৯২৯ সালে তিনি বিয়ে করেন কেশবচন্দ্র সেনের নাতনি সাধনাকে। সাধনা বসু ছিলেন তিন ও চারের দশকের বাংলার সবচেয়ে বিখ্যাত ও গ্ল্যামারাস অভিনেত্রী। ১৯২৯ সালেই ফ্রাঞ্জ অস্টেন ভারতে এসে মহাভারতের একটি অধ্যায়কে ভিত্তি করে ‘A Throw of Dice’ নামে একটি ছবি তৈরি করেন। তাতে মধু বসু আলোকচিত্রের কাজ এবং অভিনয় করেছিলেন। ১৯৩০ সালে মধু বসু রবীন্দ্রনাথের ‘মানভঞ্জন’ থেকে নির্মাণ করেন তাঁর প্রথম ছবি ‘গিরিবালা’। তবে তাঁকে পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দেয় ১৯৩৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আলিবাবা’ ছবি। এই ছবিটি সারা ভারতে তো বটেই, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও পরিচিতি পেয়েছিল। মর্জিনার ভূমিকায় সাধনা বসুর অভিনয় প্রভূত জনপ্রিয়তা পায়। মধু বসুর অন্যান্য ছবিগুলির মধ্যে দালিয়া(১৯৩০), অভিনয় (১৯৩৮), দ্য কোর্ট ডান্সার : রাজনর্তকী (১৯৪১), মীনাক্ষী (১৯৪২), মাইকেল মধুসূদন (১৯৫০), রাখি (১৯৫৩), শেষের কবিতা (১৯৫৩), মহাকবি গিরিশচন্দ্র (১৯৫৬), বীরেশ্বর বিবেকানন্দ (১৯৬৪) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ১৯৩২ সালে ‘Khyber Falcon’ নামে একটি বর্মী ছবিতেও তিনি নির্দেশকের কাজ করেছিলেন। এছাড়া ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে ‘Musical Instruments of India’ নামে একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করেন। রবীন্দ্রনাথের সমকালে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্র-কাহিনি নিয়ে মধু বসুর মতো শিল্পোত্তীর্ণ ছবি আর কেউ নির্মাণ করতে পারেননি। ‘মাইকেল মধুসূদন’ ছবিতে নামভূমিকায় অসামান্য অভিনয় করেছিলেন উৎপল দত্ত। এই ছবি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উৎপলবাবু নিজে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে পরিচালক হিসেবে মধু বসুর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। বস্তুত, সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের অনেক আগে ভারতীয় চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় পরিচিতি এনে দিয়েছিলেন মধু বসু। ১৯৬৯ সালে তিনি মারা যান। এ বছর ফেব্রুয়ারিতে ১২০ তম জন্মদিন পেরিয়ে এলেন তিনি। আমরা তাঁর অবদান মনে রাখব কি?
[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস]