বইয়ের খবর

বাজারুর বাজার-ই

সায়নদীপ গুপ্ত Dec 15, 2020 at 10:32 am বইয়ের খবর

বইঃ রোববারের বাজার
লেখকঃ রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ দে’জ পাবলিশিং
প্রচ্ছদ ও রেখাচিত্রঃ দেবাশীষ দেব

খেয়ে ও খাইয়ে তৃপ্তি – এই কথাখানা বাঙালির মতো করে বোধকরি কেউ বুঝে উঠতে পারেননি। ‘খেয়ে তৃপ্তি’ বা তৎসংলগ্ন পেটুক তকমাধারী মানুষদের নিয়ে চর্চা, বাংলা সাহিত্যের আনাচেকানাচে মণিমুক্তোর মতো ছড়িয়ে আছে। তুলনায় ‘খাইয়ে তৃপ্তি’ পাওয়ার মানুষেরা খানিক আড়ালেই থেকে যান। ‘মনোজদের অদ্ভুত বাড়ি’র বিশ্ববাজারু মেজছেলে ভজহরির মতো মানুষ তাই কদাচিৎ লাইমলাইট পান; বাজার করাও যে একটা আর্ট, তেমন শিল্পী আছেন বলেই যে আমাদের হেঁশেলশিল্প এত উন্নত, সে কথা মনে করিয়ে দেওয়ার অবকাশ বিশেষ ঘটে না। সেটুকুর খবর নিয়েই রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের বই ‘রোববারের বাজার’। 

বাজারুদের নিয়ে যত না, এ বই তার থেকেও বেশি করে বাজার নিয়ে লেখা। স্মৃতি-আলেখ্য নাকি অভিজ্ঞতার চালুনি-সাঁচা জনতোষ প্রবন্ধ – সাহিত্যের কোন আঙ্গিনায় এমন নধর কচুর লতির মত লকলকে লেখা ফলে, তা বুঝে উঠতে উঠতে এর সম্মোহনী শক্তি পাঠককে আচ্ছন্ন করে ফেলে। কষিয়ে রাঁধা লইট্যা মাছের ঝুরি বা মিহি করে বাটা পোস্ত দিয়ে কষানো পেয়াঁজ যেমন প্রতিদিন অল্প অল্প করে খেলেও আশ মেটেনা, আবার একটানে একথালা ভাত মেখে সাবড়ে দিলেও আইঢাই করে না, এই বইয়ের লেখা ঠিক তেমনই। আদিতে এই লেখা ‘প্রতিদিন’-এর রবিবার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে বেরোত, কাজেই আপনি রবিবাসরীয় দুপুরবিলাস হিসেবেই পড়ুন বা প্রত্যহের খুচরো মুখচালানো হিসেবে – যথার্থ খাদ্যরসিক হলে এই লেখা আপনার মননে বশীকরণ করে ছাড়বে। পারিবারিক গানবাজনার পরিবেশের সূত্রে রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের পরিচিতি লিস্টে ঠাঁই করে নিয়েছেন প্রখ্যাত নানান ব্যক্তিত্ব; কবি থেকে গায়ক, চিত্রকর থেকে চলচ্চিত্রকর – বাদ যাননি কেউই। সুচারুভাবে সকল মহাজীবনকে লেখক মিলিয়ে দিয়েছেন এক একটি খাদ্যসামগ্রীর সাথে। কখনও সেই খাদ্যের চারিত্রিক মিষ্টত্ব চারিয়ে গেছে সেই ব্যক্তিত্বের বিন্যাসে, আবার কখনও কৈশোর বা যৌবনের রঙিন ঘটনাগুলির মধ্যে দিয়ে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে কাছের সম্পর্ককে। যেমন পরম মমতায় আসলি হিমসাগর চিনিয়ে দেন সাহিত্যিক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, তেমনই প্রায় হারিয়ে যাওয়া ক্ষীর-কমলার স্মৃতি ফিরে আসে শঙ্খ ঘোষের বাড়ির আড্ডার হাত ধরে। ভাঙ্গা প্রেমের চিনচিনে যন্ত্রণা যে পড়ন্ত বিকেলের নুনমাখানো কালোজামের আদরে হুহু করে ওঠে, ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা আতাগাছের জীবন বাজি রেখে যে সংসারজীবন শুরু করা যায়, নিঃসঙ্গ এক মসজিদের মৌলবির রাঁধা কাঁকরোল দিয়ে বাটামাছের ঝোল খেতে বসে যে গলার কাছে একদলা ভালোবাসা আর কান্না আটকে যায় – এই বই না পড়লে আপনি জানবেন কী করে? কীভাবে জানবেন বরেণ্য পরিচালক বাসু চ্যাটার্জী মশাইয়ের ফেভারিট ডাব-হুইস্কি বা গুন্টার গ্রাস আর অ্যালেন গিন্‌সবার্গের ঝাপটে এবং সাপটে খাওয়া ধনেপাতা বাটার মহার্ঘ বীজমন্ত্র? তা বলে ভাববেন না রকমারি রেসিপির সম্ভার, এই বইতে মোটেও তা নেই। বরং সব রান্নার, সবরকম খাওয়াদাওয়ার পিছনের গল্পগুলি এর পাথেয়। শুরুতে যে শিল্পের কথা বলেছিলাম, সেই বাজারকরিয়ে শিল্পীদের তালিকায় লেখক নিঃসন্দেহে সুফিমার্গের সাধক। না হলে অমন ভাবে লিখতে পারেন না “এমন অনেক মানুষ দেখেছি, যারা মানকচুর মতো একা থাকতে পছন্দ করে”; কী জাদুতে কাছের মানুষের টানাপোড়েনের সাক্ষ্য দিতে গিয়ে বলতে পারেন “নানান সময়ে সমরেশদার হাতে ঝকঝকে পমফ্রেট দেখে ভেবেছি, ও বুঝি নিজের সাদা আর নরম মনটাকেই হাতে নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে ... শুধু অজস্র অনাত্মীয় মানুষের ভালোবাসা, ওর বুকের উপরের চেরা দাগগুলোকে এখন হয়তো অনেকটাই ফিকে করে দিয়েছে”! বাজারজোড়া হাজার রকম ঢাকবাজানো বেস্টসেলারের ভিড়ে এই বই আদতে নিঃশব্দে হেসে জড়িয়ে ধরা সেই  বন্ধু, যার সঙ্গে তীব্র ঝগড়ায় মাঠ ছেড়েছিলাম এই পণে যে আর কথা বলবই না। এর এক একটি লেখা যেন রবিবারের সকালে রান্নাঘরে ব্যস্ত মা, জলখাবারের লুচির সঙ্গে বকুনি হাতে ধরিয়ে আড়ালে নিজের মুখে পুরে নেবে গতরাতের বাসি রুটি; অথবা শীতশেষের দুপুরে লেক টেম্পল রোডের কাঠচাঁপা গাছের তলায় ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেওয়া মুহূর্ত, যার ভিতর চন্দ্রবিন্দুর গানের মতো শিরশিরানি জাগানো ভালোলাগা বাসা বাঁধে। না পড়লে কীসেরই বা ক্ষতি, তবে পড়লে রসিক মন তৃপ্তি পায়। 


#বাংলা #বইয়ের খবর #রোববারের বাজার #Book review

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

28

Unique Visitors

214996