ভূত দেখেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্র!
হ্যাঁ। শুনতে আশ্চর্য লাগলেও এটা সত্যি। তবে নিজে সেই ভূত-দর্শনের কাহিনি লিখে যেতে পারেননি বঙ্কিম। খুব সম্ভবত, এই অভিজ্ঞতার ওপরে ভর করেই বঙ্কিম লিখতে শুরু করেন “নিশীথ রাক্ষসীর কাহিনী”, যার প্রথম পরিচ্ছেদ প্রকাশিত হয় ‘নারায়ণ’ পত্রিকার বৈশাখ ১৩২২ সংখ্যায়। এই রচনাটি বঙ্কিম শেষ করে যেতে পারেননি। তবে তাঁর ভূত দেখার অভিজ্ঞতার কথা লিপিবদ্ধ হয়ে রয়েছে তাঁর নাতি দিব্যেন্দুসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে, যা মুদ্রিত হয় সমালোচনী পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় (১৯০২)।
বঙ্কিমচন্দ্র তখন কাঁথির হাকিম। একবার এক জরুরি প্রয়োজনে তাঁকে কাঁথি থেকে সাত-আট ক্রোশ দূরে যেতে হয়। বঙ্কিমচন্দ্র রোদ একদম সহ্য করতে পারতেন না। তাই কোথাও যেতে হলে হয় খুব ভোর ভোর বেরিয়ে যেতেন, না হয় বেরোতেন সন্ধেবেলা। এইবারেও বঙ্কিম বেরিয়েছিলেন বিকেল নাগাদ, পালকি নিয়ে। ভেবেছিলেন কাজ শেষ হলে সেই রাতেই পালকি করে কাঁথি ফিরে আসবেন। কিন্তু Man proposes god disposes। কাজ শেষ করতে রাত দশটা বেজে গেল। খাওয়া দাওয়া সেরে যখন তিনি ফেরার জন্য প্রস্তুত তখন স্থানীয় মানুষজন অত রাতে তাঁকে পালকি করে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে বারণ করলেন। একে তো অমাবস্যার রাত। তার ওপর সেই সময়ের বাংলায়, রাতের জনহীন প্রান্তর ডাকাতদের মুক্তাঞ্চল। বঙ্কিম সে রাতটা স্থানীয় জমিদারের বাগানবাড়িতে থাকাই মনস্থ করলেন।
তিনমহলা বাড়ির চারদিকে বিশাল বাগান। বাগান ঘিরে রেখেছে উঁচু পাঁচিল। বাড়ি থেকে ফটকের দূরত্ব বেশ অনেকটা। এই বাড়িতেই একটা ঘরে বঙ্কিমের রাত্রিবাসের আয়োজন হল। বঙ্কিমের খানসামা মুরলী আর বাকি চাকররা রইল তার পাশেই একটা ঘরে। দরজায় খিল দিয়ে তামাক টানতে টানতে সবে তাঁর দু চোখ বুজে এসেছে ঘুমে, ঠিক তখনই দরজায় আওয়াজ। কে যেন গায়ের জোরে দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে!
কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় বেশ ক্ষেপে গেলেন বঙ্কিম। ভাবলেন, মুরলী হয়ত আবার এসেছে কোনও প্রয়োজনে। মুরলীকে ধমকাতে ধমকাতে দরজা খুললেন তিনি। কিন্তু কী আশ্চর্য! কেউ নেই! দরজা বন্ধ করে আবার বিছানায় এলেন বঙ্কিম। একটু ঘুম আসতে না আসতেই আবার সেই আওয়াজ। সারাদিনের কাজের হ্যাপা, পথশ্রম - তারপরে এই হাঙ্গামা কার সহ্য হয়! যতবার দরজা খুলছেন ততবারই দরজা ফাঁকা। বঙ্কিম শেষে ঠিক করলেন যে একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। হয়ত কোনও কুকুরের কীর্তি। কিংবা হয়তো এই পরিত্যক্ত বাড়ি কোনও চোর-ডাকাতের আস্তানা। এ তাদেরই কাজ।
বঙ্কিম যখনই কোনও মফস্বলে রাত কাটাতেন, সঙ্গে রাখতেন একটি ছোরা। এইবার ঘরের মধ্যে সেই ছোরা বের করে বসলেন বঙ্কিম। আবার দরজায় শব্দ। তবে এইবারের শব্দ অনেক মৃদু। এক হাতে আলোর বাতি অন্য হাতে ছোরা নিয়ে খুব সন্তর্পণে দরজা খুললেন বঙ্কিমচন্দ্র। এইবার দেখতে পেলেন দরজার সামনে একজন খর্বাকৃতি যুবতী। বঙ্কিম দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সেই মেয়েটি ছুটে পালাল।
অকুতোভয় বঙ্কিম ছোরা আর আলো হাতে তার পেছনে গেলেন। দেখলেন, মেয়েটি বারান্দার পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে।
মেয়েটি বঙ্কিমকে বলল, “আমি তো আপনার কোনও ক্ষতি করিনি। আপনি আমায় তাড়া করেছেন কেন?”
বঙ্কিম মেয়েটির পরিচয় জিগ্যেস করলেন।
মেয়েটি বলল, তার নাম বিরহ। সে স্থানীয় জমিদারের মধ্যম পুত্রবধূ। প্রতি রাতে, যে ঘরে বঙ্কিম আছেন, সেই ঘরে সে আসে।
বঙ্কিম বললেন, সেই মেয়েটিকে তিনি পরদিন সকালে জমিদারবাবুর মধ্যমপুত্রের কাছে দিয়ে তবে যাবেন। কিন্তু মেয়েটিকে তিনি ধরতে পারলেন না। যখন তিনি মেয়েটিকে ধরার জন্য হাত বাড়ালেন, তার হাত গিয়ে লাগল দেওয়ালে। মেয়েটি খিলখিল করে হাসতে হাসতে কীভাবে যেন বঙ্কিমের পেছনে চলে গেল। বঙ্কিম তার দিকে ঘুরতেই সে লাগাল এক ছুট। বঙ্কিমও তার পেছনে ছুটলেন। দৌড়াতে দৌড়াতে সে মেয়ে চলে গেল একদম ফটকের সামনে। একটা চাঁপা গাছের সামনে গিয়ে মেয়েটি যেন হাওয়ায় উড়ে গেল। আর চাঁপাগাছটা প্রচণ্ড দুলতে শুরু করল। অথচ তেমন হাওয়া তো নেই! তবু চাঁপাগাছ খুব দুলছে।
এইবার বঙ্কিম ভয় পেলেন। বুঝলেন তিনি যে মেয়েটির পেছনে ছুটেছেন, সে আসলে ছায়া মূর্তি। তৎক্ষণাৎ চাকরদের জাগিয়ে তাদের সঙ্গে সেই বাড়ি ত্যাগ করেন বঙ্কিম। তখন প্রায় চারটে।
এই ঘটনার কয়েকদিন পর ঐ গ্রামের জমিদারের গোমস্তা কোনও কাজের জন্য বঙ্কিমের কাছে এলে, বঙ্কিম তাঁকে ঐ বাড়ির মেজবউয়ের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। গোমস্তা জানায়, সেই বাগান বাড়ির পুকুরেই স্নান করতে গিয়ে মারা গেছিলেন, মেজবউ। বঙ্কিমের রাত্রিসঙ্গিনী।
অবিশ্বাসীরা নাক কুঁচকে বলবেন, গাঁজাখুরি! উনিশ শতকের থিওজফি-চর্চার সঙ্গে এই ধরণের গল্পের যোগ খুঁজবেন পণ্ডিতেরা। বঙ্কিমের নাতির বলা ‘গল্প’ কতটা সত্যি এ নিয়েও সংগত প্রশ্ন উঠবে। বঙ্কিমচন্দ্র আদৌ ভূত দেখেছিলেন কিনা সে প্রশ্নের উত্তর দিতে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের ভূত তো আর আসবেন না!
[ কৃতজ্ঞতা - উপছায়া, সুকুমার সেন , সুভদ্রকুমার সেন সম্পাদিত, সিগনেট প্রেস, মে ২০১৭। ]
[ কভার ছবি - অন্তর্জাল ]
#বাংলা #ফিচার #বিবস্বান দত্ত #বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়