বড়োপর্দায় বল্লভপুর: ‘ছায়া’ছবির রূপ-কথা
.....................
চলচ্চিত্র : বল্লভপুরের রূপকথা
পরিচালনা : অনির্বাণ ভট্টাচার্য
চিত্রনাট্য ও সংলাপ : অনির্বাণ ভট্টাচার্য ও প্রতীক দত্ত
শ্রেষ্ঠাংশে : সত্যম ভট্টাচার্য, সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল চক্রবর্তী, দেবরাজ ভট্টাচার্য, ঝুলন ভট্টাচার্য প্রমুখ
সিনেমাটোগ্রাফি : সৌমিক হালদার
সঙ্গীত পরিচালনা : শুভদীপ গুহ, দেবরাজ ভট্টাচার্য
........................
প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া এককালের চোখ ধাঁধানো রাজবাড়ি। চোদ্দ পুরুষের বিশ্বস্ত কাজের লোক। দেনার দায়ে সর্বস্বান্ত রাজপরিবার। ডাক্তারি পাস করা যুবক রাজা। আর চারশো বছরের অভিশাপ ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো নরম-সরম রোমান্টিক সাহিত্যপ্রেমী ভূত, যে নাকি রাত এগারোটা বাজলেই মেঘদূত-গীতগোবিন্দ আওড়াতে শুরু করে।
কী ভাবছেন? সিনেমার রিভিউ পড়তে গিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের অদ্ভুতুড়ে সিরিজের কোনও উপন্যাসের প্লটে ঢুকে পড়েছেন? এই আখ্যানে শীর্ষেন্দুর কিশোর উপন্যাসোচিত মালমশলা তো রয়েইছে। সঙ্গে জুড়ে গেছে আকবরের সময়কার বাঙালি ভুঁইয়াদের নস্টালজিক ইতিহাস। পাহাড় আর সবুজ-ঘেরা বিস্তীর্ণ ল্যান্ডস্কেপ। শুধু তাই নয়, রয়েছে ধনবান শিল্পপতির সুরুচিসম্পন্না বুদ্ধিমতী কন্যার সাথে স্বয়ং রাজাবাহাদুরের অম্লমধুর সম্পর্কের ইতিবৃত্ত।
সব মিলিয়ে সফল কমেডি হয়ে ওঠার উপযুক্ত ফর্মুলা আগে থেকেই মজুত ছিল বাদল সরকারের নাটক ‘বল্লভপুরের রূপকথা’য়। তাকেই চলচ্চিত্ররূপ দিয়েছেন পরিচালক। মূল কাহিনি, এমনকি সংলাপেরও বিরাট কোনও রদবদল না করেই। বদল যেটুকু এসেছে তা মাধ্যমগত পরিবর্তনের জন্য অনিবার্য ছিল। ‘বল্লভপুরের রূপকথা’র ভূমিকায় বাদল সরকার লিখেছিলেন, ‘এই নাটকের মূল রসিকতাটুকুর অনুপ্রেরণা একটি বহু পুরাতন – বিদেশী চলচ্চিত্র’। ছায়াছবির অনুপ্রেরণায় লেখা নাটকের চলচ্চিত্ররূপ হিসেবে বেশ কিছু সিনেমাটিক এলিমেন্ট এর টেক্সটের মধ্যেই ছিল। পরিচালক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার সদ্ব্যবহার করতে ত্রুটি রাখেননি।
প্রথমেই বলতে হয় বল্লভপুরের রাজবাড়িটির কথা। সুপ্রাচীন রাজবাড়ি নিজেই যেন এ সিনেমার একটি চরিত্র । লোকেশন নির্বাচন, ক্যামেরা ও সিনেমাটোগ্রাফির গুণে ক্ষয়িষ্ণু ঐশ্বর্য-আভিজাত্যের স্মৃতিসত্তা জীবন্ত হয়ে উঠেছে পর্দায়। গোটা ছবিজুড়ে ছড়িয়ে থাকা কমিক আবহেও নষ্ট হয়নি পিছুটানময় সেই সৌন্দর্যের বিষণ্ণতা ও গাম্ভীর্য। ভূত নিজে সশরীরে ক্যামেরার সামনে আবির্ভূত হওয়ার আগে (এবং পরেও), কেবল ক্যামেরার এগোনো-পিছনো যেভাবে ভৌতিকতার সমার্থক হয়ে উঠেছে, তা টেকনিক হিসেবে চমৎকার। বিশেষ করে একেবারে প্রথম যে দৃশ্যে ভূতবাবাজি ক্যামেরার সামনে না এসে পিছন থেকে জানান দিয়েছেন তাঁর অস্তিত্ব, সেখানে নির্দেশনার মুনশিয়ানা অনবদ্য। এরকম কিছু দৃশ্যেই আমরা নির্দেশকের ইমপ্রভাইজেশন-কৌশলের আঁচ পেয়ে যাই। থিয়েটার এবং চলচ্চিত্র – এই দুই মাধ্যমের সেতুনির্মাণের কাজটি করতে গিয়ে কোথাও হোঁচট খেতে হয়নি তাঁকে, বরং সিনেমার পর্দায় নতুন এক সিগনেচার-স্টাইল তৈরি হয়েছে – সামগ্রিকভাবে বাংলা ছবির ক্ষেত্রেই এ এক সুসংবাদ।
তার পরেও কিছু বিষয়ে অভিযোগ থেকেই যায়। বাঙালি দর্শকের রসবোধের সূক্ষ্মতা সম্পর্কে আস্থা সম্ভবত সব পরিচালকেরই অল্পবিস্তর কমে আসছে, এ ছবিও তার ব্যতিক্রম নয়। দর্শককে হাসানোর চেষ্টা যদি খুব বেশি করে ধরা পড়ে, তাহলে হাসির মূল উদ্দেশ্যটুকু পর্দাতেই মারা যায়। সংলাপ আপাতভাবে হাসিতে ফেটে পড়ার মতো না হলেও, অভিনেতার শরীরীভাষায় থাকতে পারে হাসির উপাদান। থাকতে পারে তাঁর স্বরপ্রক্ষেপণে, কিংবা কমিক টাইমিংয়ে। বাদল সরকার তাঁর টেক্সটে এই সূক্ষ্মতার আভাস দিয়ে গেছেন মঞ্চ নির্দেশনার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া শব্দগুচ্ছে। যেমন, বাড়ি কিনতে শিল্পপতি হালদার এসে গেলে ভূপতির বন্ধু সঞ্জীব কোথায় থাকবে এই সংকটের সময়ে নাট্যকারের মন্তব্য [এ সব দুরূহ প্রশ্ন এ অবস্থায় মীমাংসা করা কঠিন]। আবার, বল্লভপুরের সাবেকিয়ানা ও প্রাচীনত্বে মুগ্ধ-অভিভূত হালদার যখন অপূর্ব ইতিহাস ‘রচনা’ করার জন্য ভূপতিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন, তখন ভূপতির সংলাপের আগে ফার্স্ট ব্র্যাকেটে লেখা হয় (অপরাধী বিবেক)। এই টুকরো মন্তব্যগুলো কি মঞ্চ নির্দেশনা হিসেবে অপরিহার্য ছিল? তা তো নয়! আসলে, খুব সন্তর্পণে হাসির চোরা স্রোত বইয়ে দেয় এইসব সংযোজন।
হাসির এই সূক্ষ্ম আয়োজনেরই অভাব দেখা গেল এই নাটকের চলচ্চিত্রায়নে, বিশেষত প্রথম দিকের দৃশ্যগুলোয় কমেডি হয়ে ওঠার চেষ্টা যেন বড়ো বেশি প্রকট। কমেডি হতে গেলেই যে মোটা আর চড়া দাগের হিউমর থাকতে হবে, প্রত্যেক মজাদার সংলাপের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রমাণ করে ছাড়তে হবে পর্দায় অভিনীত দৃশ্যের হাস্যযোগ্যতা, এ ধারণা থেকে বেরনোর সময় হয়তো এসে গেছে। ভালো ছবিই হোক আমজনতার রুচির নির্ধারক। স্থূলরুচির চাহিদা ছবির গতিপথ এত প্রবলভাবে নির্ধারণ করছে দেখলে খারাপ লাগে বৈকি! এন্ড ক্রেডিটের সময়ে থিয়েটারের কার্টেন কলের কায়দায় অভিনেতাদের পর্দায় আনা হলেও ব্যাকগ্রাউন্ডের গান গোটা সিনেমার মেজাজের প্রেক্ষিতে খাপছাড়া লাগে।
এ ছবিতে প্রত্যেক অভিনেতাই অত্যন্ত সাবলীল, স্বচ্ছন্দ, নিজের নিজের ভূমিকায় যথাযথ। বল্লভপুরের রাজা ভূপতির চরিত্রাভিনেতা সত্যম ভট্টাচার্যের কণ্ঠ, স্বরক্ষেপণ, কথা বলার ভঙ্গিমায় পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের অভিনয়-ঘরানার ছাপ বেশ স্পষ্ট। তবে তা তাঁর চরিত্রের জন্য বেমানান হয়নি। বন্ধু সঞ্জয়ের ভূমিকায় দেবরাজ ভট্টাচার্য অসাধারণ। ছন্দার চরিত্রে সরলতা, বুদ্ধি ও পরিণতির মিশেল যথেষ্ট দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন সুরঙ্গনা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই ছবির ঘটনাকাল ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দ। তাই অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে ষাটের দশকের সিনেমার স্বাদ তুলে ধরার চেষ্টা বেশ উপভোগ্য মনে হয়েছে।
আরও পড়ুন : বল্লভপুর নিয়ে বলার কথা / সৌপ্তিক
আরেকটি খামতির কথা না বললেই নয়। (এর পরের অংশটি স্পয়লার অ্যালার্টসম্পন্ন, অনিচ্ছুক পাঠক এড়িয়ে যেতে পারেন) বাদল সরকারের মূল নাটকে রাজা আর ছন্দার প্রেম কী করে ঘটল, সে ইতিহাস প্রায় ঊহ্য রাখা হয়েছে। মূল নাটক ও সিনেমা – দু-জায়গাতেই দেখা যায় ছন্দা ভূপতির আচরণে যত না মুগ্ধ, তার চেয়ে ঢের বেশি ইমপ্রেসড প্রেতাত্মা রঘুদার গলায় সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তিতে, তাঁর রাজপোশাকের আভিজাত্যে। পরে যখন বোঝা যায় সংস্কৃত শ্লোকের আবৃত্তিকার ভূপতি নয়, বরং চারশো বছরের পুরনো ভূত, তখন ছন্দা হৃদয় সমর্পণ কাকে করবে, ভূত না মানুষকে, এই নিয়ে দোলাচল আসাটাই কি স্বাভাবিক নয়! মূল নাটক এই জটিলতার মধ্যে ঢুকতে চায়নি বলেই গোটা প্রেমপর্বটি একপ্রকার অনুক্ত রেখে একেবারে বিয়ের খবর দেওয়া হয়েছে দর্শককে। কিন্তু সিনেমার ‘মিটমাট পর্বে’ সবিস্তারে গোটা ঘটনা দেখাতে গিয়েই বোধহয় কিঞ্চিৎ গোলমাল বেঁধেছে। ভূপতি সংস্কৃতের স-ও জানে না একথা জানার পরেও ছন্দা তেমন বিচলিত হয় না, দেখা যায় বিয়ের ব্যাপারেও তার তেমন আপত্তি নেই। যেন যার প্রেমে পড়েছিল, তার লুক-এলাইক পেয়েই সে সন্তুষ্ট। এতে ছন্দা চরিত্রের পরিণতি ও গভীরতায় খানিক ভাঁটা পড়ে। ছবির মেজাজ হালকা বলে, তার চরিত্রদেরও সর্বদা লঘু করে দেখা তেমন যুক্তিযুক্ত নয়। অন্যদিকে এই খামতির অনেকটাই ক্ষতিপূরণ করে দেয় ভূপতি ও রঘুদার সম্পর্কের রসায়ন। সিনেমায় এই সম্পর্ক মূল নাটকের চেয়েও স্পষ্ট ও মর্মস্পর্শী। নাটকে অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার পর রঘুদা শেষ দেখা করে গেল না বলে ভূপতির কিছুটা দুঃখমিশ্রিত অভিমান প্রকাশ পায় মাত্র। কিন্তু সিনেমায় ভূপতি-রঘুদার শেষ সাক্ষাতের দৃশ্যে তাদের সংক্ষিপ্ত বিদায় সম্ভাষণেরও সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। গোটা গল্পে অসামান্য কোনও চমক না নেই বটে। কিন্তু ছিমছাম ন্যারেটিভ, মূলানুগ পরিচ্ছন্ন পরিবেশন আর অভিনয়ের পেশাদারিত্বে বাংলা বাণিজ্যিক ছবির জগতে এ ছবি নিঃসন্দেহে এক ব্যতিক্রমী সংযোজন। খাঁটি বাঙালিয়ানা, সাবেকি ছাঁদের লিনিয়ার গল্প, নির্মল খুশি আর নির্ভার বিনোদন যদি লক্ষ্য হয়, তবে অন্তত একবার দেখা যেতেই পারে ‘বল্লভপুরের রূপকথা’।
........................
#বল্লভপুরের রূপকথা #বাদল সরকার #অনির্বাণ ভট্টাচার্য #Ballavpurer Rupkatha #Badal Sarkar #Anirban Bhattacharya #silly পয়েন্ট