ফেলুদা হিসেবে সত্যজিতের পছন্দ ছিলেন বচ্চন?
ধরুন আপনাকে জিজ্ঞেস করা হল, বলুন তো সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সব্যসাচী চক্রবর্তী, আবির চট্টোপাধ্যায়, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এবং অমিতাভ বচ্চন - এই পাঁচজন অভিনেতার মধ্যে যোগসূত্র কী? আপনি নিশ্চয় ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসবেন। আর যখন শুনবেন উত্তরটা হচ্ছে যে এঁরা সবাই ফেলুদার চরিত্রে খোদ রায়পরিবারের পছন্দের মানুষ, তখন সম্ভবত বচ্চনের নাম এই তালিকায় দেখে অবাক হবেন।
আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই, ফেলুদা হিসেবে স্বয়ং সত্যজিৎ রায়ের মনে ধরেছিল ‘বিগ বি’ অমিতাভ বচ্চনকে। সময়টা আটের দশকের মাঝামাঝি। দূরদর্শনের থেকে প্রস্তাব এল সত্যজিতের ফেলুদা-কাহিনি নিয়ে মিনি সিরিজ করবার। কিন্তু ইতোমধ্যেই ১৯৮৪ সালে দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে সত্যজিতের। পরিচালনা বা অন্যান্য শ্রমসাধ্য কাজ ডাক্তারের নির্দেশে একেবারেই বন্ধ। তবু ‘যত কাণ্ড কাঠমান্ডুতে’ গল্পের উপর ভিত্তি করে হিন্দিতে চিত্রনাট্য লিখে ফেললেন সত্যজিৎ। ঠিক হল পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন তাঁর পুত্র সন্দীপ রায়। এই সময়েই ফেলুদা চরিত্রে নিজের পছন্দ হিসেবে সত্যজিৎ সন্দীপকে জানালেন অমিতাভের কথা। সন্দীপের কথায়, “বাবা চেয়েছিলেন অমিতাভ বচ্চন এই চরিত্রে অভিনয় করুন। ওঁকে এই চরিত্রে দেখার প্রবল ইচ্ছে ছিল বাবার।” এ-নিয়ে অমিতাভের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হলেও সমস্যা দেখা দেয় অচিরেই। কারণ এই সিরিজের শুটিঙের জন্য অনেক সময়ের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বচ্চনের হাতে তখন পরপর কাজ। শেষ অবধি তাই বচ্চনকে পরিকল্পনা থেকে বাদ দিতে হয়। সন্দীপ তখন যান শশী কপুরের কাছে। এককালে রাজ কপুর সেই কুখ্যাত ‘হু ইজ সত্যজিৎ রায়?’ উক্তি করলেও পরবর্তীকালে কপুর পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে সত্যজিতের। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির শুটিং চলাকালীন কালার প্রিন্ট ফুরিয়ে যাওয়ায় নিকটবর্তী শাম্মি কপুরের শুটিং ইউনিট থেকে প্রিন্ট নিয়ে আসেন সত্যজিৎ। ‘কিসসা কাঠমান্ডু কা’ নামের এই সিরিজের কথা শুনে ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েন শশী। সন্দীপকে কথা দেন, ওজন কমিয়ে নিজের চেহারাকে ফেলুদার কাছাকাছি নিয়ে যাবেন। তোপসে চরিত্র করেন ‘শোলে’-র মতো ছবিতে কাজ করা শিল্পী অলঙ্কার জোশী। জটায়ু হন মোহন আগাশে, আর মগনলাল মেঘরাজ উৎপল দত্ত। কিন্তু ‘কিসসা কাঠমান্ডু কা’ পরিচালনা করে মন ওঠেনি সন্দীপের। তাঁর মনে হতে থাকে ফেলুকাহিনির চিরাচরিত স্বাদ এ সিরিজে অনুপস্থিত। কারণ ছিল একাধিক। সবচেয়ে বড় কারণ হল, হিন্দি ভাষার জন্য ফেলুকাহিনির বাঙালিয়ানা হারিয়ে যাওয়া। আরেকটা বড় কারণ অবশ্যই শশী কপুরের ভারী চেহারা। ওজন কমানোর যে প্রতিশ্রুতি শশী দিয়েছিলেন, তা পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারেননি তিনি। এখন ‘কিসসা কাঠমান্ডু কা’ সিরিজের প্রিন্ট পাওয়াই মুশকিল। ইউটিউবে রাশ প্রিন্ট দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয় দর্শককে। শশী কপুরের ‘মোটু ফেলুদা’ এখন প্রধানত ইন্টারনেটে ঠাট্টা তামাশার পাত্র। এমন অবস্থায় মনে হয় বটে যে, বচ্চনকে পাওয়া গেলে ছবিটা অন্যরকম হতেই পারত। অভিনয় জগতে আসার আগে কলকাতায় চাকরি করেছেন অমিতাভ। হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়, দুলাল গুহর মতো পরিচালকের একের পর এক ছবিতে সে-সময় তিনি করেছেন বাঙালির চরিত্র। শক্তি সামন্তর ‘অনুসন্ধান’ বা টিটোর ‘ওরা কারা’-র মতো বাংলা ছবিতেও কাজ করেছেন। ছয় ফুট দু ইঞ্চি অমিতাভকে ছয় ফুটিয়া ফেলুদা হিসেবে কেমন লাগত, ভাবলে সত্যিই আগ্রহ জাগে। অমিতাভের স্ত্রী জয়ার প্রথম কাজ ‘মহানগর’ ছবির পরিচালক ছিলেন সত্যজিৎ। সত্যজিতের নির্দেশনায় অমিতাভের একমাত্র কাজ ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ী’ ছবির নেপথ্যে ভাষ্যপাঠ। ‘মানিকদা’-র সঙ্গে আরও কাজ না করতে পারার জন্য একাধিকবার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন অমিতাভ। সত্যজিতের শতবর্ষ পালন উপলক্ষ্যেও আবার স্মরণ করেছেন সে কথা। কে বলতে পারে, ‘কিসসা কাঠমান্ডু কা’ করতে পারলে হয়তো ‘অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’ ছাড়া আরও একটি তকমা পেয়ে যেতেন বচ্চন। পর্দার অন্যতম সেরা ফেলুদা হিসেবে!
#ফেলুদা #সত্যজিৎ রায় #অমিতাভ বচ্চন #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য #ফিচার #সিলি পয়েন্ট