ফিচার

কাছের মানুষ অবন ঠাকুর

শৌভিক মুখোপাধ্যায় Aug 6, 2021 at 6:08 pm ফিচার

সমারোহ শেষে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন প্রৌঢ় মানুষটি। এত আড়ম্বর, উদযাপনের মাঝে তিনি মোটেই স্বচ্ছন্দ নন। এর আগে একবার আকাশবাণী থেকে তাঁর জন্মদিন পালন করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। প্রথমে বারণ করেও পরে নিমরাজি হয়ে একটা ছোট ভাষণ দিয়েছিলেন। নয়তো পারতপক্ষে এসব এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করেন। তবে রবিকাকার কথা ফেলতে পারেন না। একদিন ভাইপোকে ডেকে পাঠিয়ে রবিকাকা শুধোলেন, ‘অবন, লোকে তোমার জন্মোৎসব করতে চায় কেন তুমি রাজি হও না?’ ভিড়ের দোহাই দিয়ে সেবার না হয় ছাড় পাওয়া গেল। কিন্তু কতদিনই বা তাঁকে ঠেকিয়ে রাখা যায়। একদিন রাজি হতেই হল। মাঝে-মধ্যে শুভেচ্ছার তোড়ে হাঁফিয়ে উঠে বলতেন, ‘ এমন একটা দিনে জন্মেছি যে কেউ এ দিনটা ভুলবে না।’ যে মানুষটি তাঁর তুলির রঙে ভারতীয় চিত্রকলায় দেশজ সুরের জন্ম দিলেন, তাঁকে ভুলে যাওয়া কী এতই সহজ? তিনি বিশ্বজয়ী কাকার বিশ্বখ্যাত ভাইপো অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। Father of Indian Art.

ঠাকুরবাড়িতে তাঁর জন্মদিনের পরিবর্তে জন্মতিথি পালন করা হত। জন্মাষ্টমী তিথিতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। নির্দিষ্ট তিথিতে গৃহদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দনের বিশেষ পুজোর উপকরণের সঙ্গে তাঁর জন্মতিথি পালনের আয়োজন সাজানো থাকত। গৃহদেবতার পুজোর পর, তাঁর জন্মতিথির অর্ঘ্য দেওয়া হলে ঠাকুরঘর থেকে বেরিয়ে মাকে প্রণাম করে নিচে নেমে আসতেন। তারপর ঠাকুরবাড়ির রীতি অনুযায়ী, একটি মাগুর মাছ তাঁর হাতে ছুঁইয়ে পুকুরে ছেড়ে দেওয়া হত। শুধু তিনি নন, প্রত্যেকের জন্মদিনেই এমন করে একটি মাছ পুকুরে ছাড়া হত। প্রতিবার রীতিতে তিনি খুব মজা পেতেন। বলতেন, ‘ আমার জন্মদিনে একটা প্রাণ বামুনের হাত থেকে রেহাই পেল।’  

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন আদ্যন্ত পারিবারিক মানুষ। বড়দাদা-মেজদাদার সঙ্গে দক্ষিণের বারান্দায় বসে ছবি আঁকতে পারলেই তিনি খুশি। আন্তর্জাতিক শিল্পীমহলে সর্বজনমান্য নাম; বড়লাট থেকে সাধারণ মানুষ সবাই তাঁর ছবি লেখার ভক্ত। সেসব নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। ছবি তাঁর কাছে যেচে ধরা দেয়। মনের চোখেই দূরের রূপ ফুটিয়ে তোলেন।

নিজের চিত্র প্রদর্শনীর সুবাদে প্যারিসে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ দেখেন অবনের সেখানে খুব নামডাক। নানা আর্ট গ্যালারীতে তার ছবি সাজানো আছে, সবাই তার স্টাইলের প্রশংসা করছে। দেখে শুনে খুব খুশি হলেন। ফিরে এসে ভাইপোকে সে কথা জানিয়ে বললেন, আমি ভাবছি তোমারও একবার সেখানে যাওয়া দরকার। তাহলে ল্যাটিন কোয়ার্টারের ছবি নিখুঁত ভাবে আঁকতে পারবে। সেকথা শুনে গড়গড়ায় টান দিয়ে বেশ খানিকটা ধোঁয়া ছেড়ে ভাইপো বললেন, ‘আমি শিল্পী, মানস চক্ষে সব দেখতে পাই ঐ ধোঁয়ার মধ্যে। হুগো আর বালজাক যখন পড়েই নিয়েছি তখন আর নিজের চোখে প্যারিস দেখার দরকার হবে না। তুমি আমাকে বল, আমি হুবহু ল্যাটিন কোয়ার্টারের ছবি এঁকে দিচ্ছি।’ নাতি মোহনলাল জানিয়েছেন, চট করে দাদুদের বাড়ি ছেড়ে নড়ানো যেত না। অথচ একবার বেরিয়ে পড়লেই স্ফুর্তিভরা ছেলেমানুষটি বেরিয়ে পড়ত। দার্জিলিং, এলাহাবাদ, সাহজাদপুর, মুসৌরী কত জায়গায়ই না গেছেন। তবে দেশের বাইরে? উঁহু। 

যত কাজই থাকুক না কেন, সন্ধে হলেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসে বাড়ির ছোটদের নিয়ে গল্পের আসর বসাতেন। গল্প, ধাঁধাঁ, নতুন নতুন গান অথবা নাটকের মহলা সব কিছুতেই ছোটদের সঙ্গে তিনি সমানভাবে মিশে যেতেন। অলোকেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতিচারণে জানিয়েছেন, ‘সন্ধ্যা হলেই আমরা চারজন--- তিন বোন আর এক ভাই তিন তলার পাথরের ঘরে সেজের আলো জ্বেলে বসতুম আর বাবা মহাভারত কিংবা রামায়ণ থেকে ছোটদের উপযোগী করে মুখে মুখে গল্প শোনাতেন।’ অথবা এলাহাবাদ ভ্রমণের সময়, ‘আমাদের বাসাবাড়ির বাগানের ধারে একতলার বারান্দায় বাবা বসেছেন জাঁকিয়ে তাঁর হরদমতাজা গড়গড়া নিয়ে। একটা কেরোসিন বাতি জ্বলছে আর আমরা বাড়ির সব ছেলেমেয়ে তাঁকে ঘিরে বসেছি। আমার মা, জ্যাঠাইমারা একপাশে বসেছেন, একটু দূরে আমার দুই জ্যাঠামশাই তাদের সটকায় মসগুল হয়ে টান দিচ্ছেন আর আমার ঠাকুরমা ঘরের ভিতর দরজার আড়ালে কান খাড়া করে শুনছেন, বাবা তাঁর নতুন লেখা রাজকাহিনীর গল্প একটার পর একটা পড়ে চলেছেন। রোজ নতুন গল্প। কী ভালই যে লাগত।’ 

গল্পের আসরে সবার জন্যে ছিল অবারিত দ্বার। কথকও বদলে যেত। যেমন কবি জসীমুদ্দিন একদিন সেখানে গল্প বলতে এলেন। শ্রোতার আসনের দিকে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। কে নেই ? গগন-সমর-অবন তিনভাই ছাড়াও বাড়ির সকল কচি-কাঁচা, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা তো আছেনই, এসেছেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকেও দেখা যাচ্ছে এক পাশে। সুসজ্জিত হলঘরে কথক ঠাকুরের মত গল্প বলিয়ের জন্যে একটি আসনও রাখা আছে। প্রথমবার গল্প বলতে এসে এতো মানুষের সামনে জসীমুদ্দিন ঘাবড়ে গেলেন। ফলে এর আগে নানা জায়গায় বহুবার বলা গল্পেও খেই হারিয়ে যেতে লাগল। অভ্যাগতদের মধ্যে কেউ কেউ উঠে চলে গেলেন, শ্রোতাদের মধ্যে উশখুস, কানাকানি শুরু হলো। গল্প শেষে কথক অধোবদন। বুঝতেই পারছেন, শ্রোতাদের ভালো লাগেনি। অবন ঠাকুর এসে শুধু বললেন, ‘বেশ হয়েছে।’ দেশে ফেরার পর বন্ধু মোহনলালকে চিঠি লিখে জসীমুদ্দিন জানালেন, গল্প বলা না শিখে তিনি আর ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় পা দেবেন না। তারপর বহুদিন ধরে বহু গায়েনের সঙ্গ করে, ভালো গল্প বলা আয়ত্ত করতে রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা অভ্যাস শেষে আবার তিনি পা দিলেন জোড়াসাঁকোয়। গল্পের আসর বসল। শ্রোতার আসনে এবার তিন ভাই আর বাড়ির ছোটরা। এবার বিনা হোঁচটে বলা গল্পের শেষে, অবন ঠাকুর খানিক চুপ করে রইলেন। এরপর জসীমুদ্দিনের বলা গল্পটিই আবার বললেন। শুধু করুণ রসের জায়গাগুলো বদলে দিলেন হাস্যরসে। আপাদমস্তক এক নতুন গল্প তৈরি হল। ঠিকঠাক গল্প বলার তারিফ না পেয়ে অবাক জসীমুদ্দিনের কাছে পৌঁছে মোহনলাল বললেন, ‘এবার তোমার গল্প বলা ভাল হয়েছে। সেইজন্যই দাদা-মশায় ওটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তোমাকে শুনিয়ে দিলেন। ওটাই তোমার গল্প বলার পুরস্কার।’

এমনতর কত কথা, কত গল্প তাকে ঘিরে। একবার যে তাঁর ছোঁয়া পেয়েছে অজান্তেই তার দাম গিয়েছে বেড়ে। প্রাত্যহিকের বাইরেও সে পেয়েছে বাড়তি কিছু। ছদ্ম গাম্ভীর্য দেখে যে দূরে থেকেছে সে দূরেই থেকে গেছে। যে সেই আবরণের আড়ালে আসল মানুষটির সন্ধান করেছে তার কাছে তিনি সমস্তটুকু দিয়ে ধরা দিয়েছেন । তার কাছে, তিনি বয়ঃবৃদ্ধ নন, চিরকিশোর। রানী চন্দ-কে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, ‘গুটিপোকার মুখোশ দেখেছ? প্রজাপতি হবার আগে ‘গুটি’ যখন বাঁধে---পাতার নীচে ঘাসের গায়ে ঝুলতে থাকে সেই গুটিপোকা। বেশ কিছুদিন তাদের থাকতে হয় সেই অবস্থায়। তাদের মুখের দিকটা থাকে উপরের দিকে, লেজের দিকে থাকে রঙ-বেরঙের মুখোশ আঁকা। পাখিরা খেতে এলে গুটিপোকাটা নড়েচড়ে ওঠে, মুখোশও নড়ে। ওই মুখোশ দেখেই পাখিরা ভয়ে পালিয়ে যায়।

আমারও তেমনি। মুখোশ পরে থাকি। সেই মুখোশ পেরিয়ে কেউ এসে গেল তো এসেই গেল।’

 

তথ্য সহায়তা : 

১. শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ - রানী চন্দ

২. অবনীন্দ্রনাথ স্মৃতি - সম্পাদনা : বিশ্বনাথ দে

....................................... 


#সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal #অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর #জন্মদিন #সার্ধশতবর্ষ #Abanindranath Tagore #Artist #শৌভিক মুখোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219123