প্রশ্নগুলো সহজ?
উচ্চতা প্রায় আমারই মতো, ছয় ফুটের কাছাকাছি। দেখেই বোঝা যায় শরীরে বেশ শক্তি আছে। সোজা আমার কাছে এসে প্রথম প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন, “আপনি বলুন, ডিভোর্স চাওয়াটা কি আমার অন্যায়?”
হঠাৎ এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। বসতে বলে পরিচয় জানতে চাইলাম। উনি বললেন, “আমি প্রগতি। ডাঃ প্রগতি। কিন্তু জানেন, সরকারের এত টাকা খরচ করে এত ভালো র্যাংক নিয়ে আমি ডাক্তার হলাম যাতে মানুষের কাজে লাগতে পারি। কিন্তু বিয়ের পর আমাকে জানানো হল, আমাকে সংসারে মনোযোগ দিতে হবে। ডাক্তারি করলে নাকি সংসার ঠিক থাকে না!”
আমি কোনও উত্তর দেবার আগেই উনি বলে চললেন, “আমি তো আসলে লিঙ্গহীন। সব মেয়েই লিঙ্গহীন। কারণ সমাজে একটাই লিঙ্গ। পুরুষ। আমি, আমার স্বামী, আমার বন্ধু-বান্ধব, আমার অত্যন্ত প্রিয় মাসি, এমনকি আমার মা-বাবা, সবাই ওই একটা লিঙ্গেরই বাহক। আমার মা নিজে একজন ডাক্তার, এবং উনিও মনে করেন আমার সংসারে মনোযোগ দেওয়াই বেশি জরুরি। উনিও চান, হাজব্যান্ড যা বলবেন আমি সেগুলোকেই যেন গুরুত্ব দিই।”
আরও পড়ুন : অস্পৃশ্যতার শরীর, নাকি শরীর ভোগের অস্পৃশ্যতা? / হেমন্ত মণ্ডল
ভদ্রমহিলার দৃষ্টি চলে গেছে অনেক দূরে। চোখের কোনা থেকে গড়িয়ে নামতে চাইছে জল। আমি একটু সোজা হয়ে বসলাম। এতক্ষণে পুরো ব্যাপারটা মাথার মধ্যে সাজিয়ে নিতে পেরেছি। সমবেদনা জানাতে যাব, উনি আবার বলে উঠলেন, “এই যে মেয়েরা আর্মিতে গেলে অহেতুক গৌরবান্বিত করা হয়, বলা হয় মেয়েরাও সাহসী হচ্ছে। কিন্তু পুরুষেরা গুলি খেলে কেউ তো আলাদা করে সাহসের কথা তোলে না। আচ্ছা বলুন তো, পুরুষগুলো যে দিনরাত গোলা-গুলি-বন্দুক নিয়ে যুদ্ধের আবহে মাতে, এই যে এত অ্যাগ্রেশন-এর প্রকাশ, কেউ তো প্রশ্ন তোলে না যে এটা আদৌ স্বাভাবিক কি না।” একটু থেমে তিনি বললেন, “ডঃ রায়, আপনি বলুন, এটা কি এক শ্রেণির ওপর আর-এক শ্রেণির ক্ষমতার প্রকাশ নয়? পুরুষ নারীকে বাঁধবে, ধনী গরিবকে শোষণ করবে, উঁচুজাত নিচুজাতকে অবহেলা দেখাবে– সবকটা কি একই পাওয়ার স্ট্রাকচার-এর অঙ্গ নয়? ধর্ষণ কি শুধু হাথরস বা বলরামপুরেই হয়? আমার বাড়িতে হয় না? যখন ‘ডাক্তারি করতে পারবে না’ শুনে শুনে আমার মন খারাপ– স্বামীর সঙ্গে বিছানায় যেতে, কাপড় খুলে দিতে মন চাইছে না– আমার স্বামী কিন্তু পারেন এক কথায় আমার মনখারাপকে নস্যাৎ করে দিতে। ‘এই সব ফালতু মন খারাপ ছাড়ো তো!’ বলে তিনি অবলীলায় জোর করে আমার শুকনো যোনিতে আনন্দের ঠিকানা খুঁজতে শুরু করে দেন।”
আমি বললাম, “প্যাথেটিক! এরকম হলে সেটা খুবই কষ্টকর।”
কথা শেষ করার আগেই উনি বলে উঠলেন, “আমি কিন্তু কষ্ট পাইনি। এটাই তো পাওয়ার স্ট্রাকচার-এর উপহার। আমার সঙ্গে সেদিন যখন এটা হচ্ছিল, আমি শুধু ভেবে গেছি সেই দলিত মেয়েটির কথা। এক-এক করে চারজন, পাঁচজন… না জানি আরও কতজন। আমি নিশ্চিত, সেদিন মেয়েটা চিৎকার করেনি। যেমন আমিও করিনি। আপনারা এক-একটা রেপ কেসের কী ব্যাখ্যা দেন তা আমি জানি। হয়তো বলবেন ওরা ধর্ষকামী। হয়তো বলবেন মনে মনে কোথাও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে বেশি বেশি ক্ষমতা দেখানোর চেষ্টা। নিজেকে ক্ষমতাবান অনুভব করার চেষ্টা। হয়তো বা কোনও এক জায়গায় ক্ষমতা দেখাতে না পেরে দুর্বল জায়গা খুঁজে নিয়ে আঘাত করে আত্মতৃপ্তির চেষ্টা। জাতও তো সেই একই ক্ষমতা-প্রকাশের ক্ষেত্র। কিংবা আয়ের বৈষম্য। ঘরেও তো সেই একই পাওয়ার স্ট্রাকচার-এরই অন্য এক মুখ। এ জিনিস কি আমাদের আটকানোর ক্ষমতা আছে? কী বোঝাবেন আমার শিক্ষিত স্বামীকে? যুগ যুগ ধরে তাঁর মনে যে তন্ত্র বাসা বেঁধে আছে, তা থেকে তিনি বেরোতে পারবেন? আপনি আপনার মনোবিজ্ঞানের দিক থেকেই বলুন না, তা কি সম্ভব?”
আরও পড়ুন : INDIA’S DAUGHTER: একটি ছেঁটে ফেলা সত্য / সায়নদীপ গুপ্ত
“কিন্তু একবার কি তবু চেষ্টা করা যায়?” আমি বললাম, “আপনি কী চাইছেন?”
উনি একটু চুপ করে থাকলেন। চোখদুটো একবার ওপরের দিকে তুলে কিছুক্ষণ সিলিং পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। একটু পরে খুব নিচু গলায় বললেন, “হাথরসের মেয়েটা বেঁচে থাকলে আপনি কি ওকেও বলতেন, ওই চার-পাঁচজনের কেউ যদি একটুও ভুল বুঝতে পারে, একটুও বদলায়, তাকে ক্ষমা করে দেওয়া যায় কি না? আপন করে নেওয়া যায় কি না?”
আমি স্তব্ধ। চোখদুটো অজান্তেই নেমে এসেছে। ওঁর চোখের দিকে তাকাতে পারছি না।
“সরি। কথাটা ওভাবে না বললেও হয়তো হত,” ডাঃ প্রগতিই বিরতি ভাঙলেন, “যাই হোক, আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। আমি আমার হাজব্যান্ডের সঙ্গে থাকব না। সে এমনিতে খুব ভালো। তার অনেক গুণ। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে তার পুরুষ-ধর্ম। মানুষ হলে জড়িয়ে থাকতাম। কিন্তু সে যে নিজেই এক মুহূর্তের জন্য আমাকে ভুলতে দেয় না যে সে ‘পুরুষ মানুষ’। বাড়ির সবার চাপাচাপিতে আমি আপনার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু এখন আমার যেটা দরকার সেটা আমি নিজেই বুঝতে পারছি।” বলে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। তারপর আবার শুরু করলেন, “বুঝতে আগেই পেরেছি। কিন্তু আমার মধ্যেও তো রয়ে গেছিল কিছু কিছু আবহমান পেট্রিয়ার্কাল সংস্কার। সেটাকে জয় করা বাকি ছিল। আর দরকার ছিল সাহস। দুটোর ব্যবস্থাই আমি করে ফেলেছি। আমার এলোমেলো কথাগুলো ধৈর্য ধরে শোনার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে, ডঃ রায়। এটা আমার ব্যক্তিগত লড়াই, আমি লড়ে নিচ্ছি। কিন্তু যদি কোনও দিন আমাদের মেয়েদের সমস্ত ছেঁড়া ছেঁড়া লড়াইগুলোকে জুড়ে জুড়ে বড়ো সংগঠিত এক লড়াইয়ের ময়দান তৈরি করা যায়, তাতে যদি আপনাকে সামিল হতে বলি, আপনি আসবেন কিন্তু। আশা করি একজন বিত্তবান উচ্চবর্ণের পুরুষতন্ত্রের বাহক হয়ে থেকে যাবেন না।”
প্রায় ছ ফুটের দৃপ্ত চেহারাটা আমাকে একরাশ প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেল প্রগতির খোঁজে।