মৃত্যুর পটে আরেকটি প্রেমের গল্প
ক্রিসমাস থেকে বর্ষবরণ, এই কদিন কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তার নাম কী?
সঠিক উত্তরের জন্য অবশ্যই কোনও পুরস্কার নেই। তবে ইংরেজিনবিশ বাঙালি হলে বলবে- “Not only busiest, brightest also”. আশ্চর্যের বিষয় হল, সবচেয়ে উজ্জ্বল এই স্থানের সঙ্গে জুড়ে আছে মানব-অভিজ্ঞতার বিষণ্ণতম সংঘটন, মৃত্যুর অনুষঙ্গ।
হ্যাঁ। এ এক আশ্চর্য বিরোধাভাস। মিউজিয়াম, এশিয়াটিক সোসাইটি, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে সাজানো, কলকাতাসেরা রেস্তোরাঁয় ছয়লাপ অভিজাত সরণী পার্কস্ট্রিটের আগের নাম ছিল বেরিয়াল গ্রাউণ্ড রোড। ১৭৬৭ সালে এক ইংরেজ কেরানিকে অন্তিমশয্যায় শোয়াতে এখানেই নিয়ে আসা হয়েছিল। পরের পঞ্চাশবছর এটি কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত কবরস্থান। এলাইজা ইম্পে থেকে উইলিয়াম জোন্স! কোলসওয়ার্দি গ্রান্ট থেকে ডিরোজিও! ব্রিটিশশাসনের প্রথম যুগের রথী-মহারথীরা এখানে শায়িত। উইকিপিডিয়া বলবে দুহাজারের বেশি কবর এখানে আছে। মৃত্যুর প্রদর্শনী!
ডরোথি স্মিথ তাঁর ছেলেমেয়েকে আঁকড়ে ধরে এই কবরে শুয়েছিলেন ১৭৯৮ সালে। ছেলে ডেভিড সাতমাসের, মেয়ে এলিজার বয়স সাড়ে তিন। এক, দুই, পাঁচ বছরের শিশুদের কবর তো আছেই, এমনকি টমাস আর সারার মৃত্যুকালে বয়স ছিল আটমাস আর ছ-মাস। পঞ্চাশ পেরোনো মানুষের কবর হাতে গোনা। বেশিরভাগই অপরিণত শিশু বা তরুণ-তরুণী।
জোব চার্নকের শহরে সাহেবদের অধিক মৃত্যুহারের প্রধান কারণ ছিল আবহাওয়া। শীতল ইউরোপ থেকে এসে এই জলাভূমিময় পরিবেশ আর গরমের সঙ্গে মানাতে গিয়ে অকালমৃত্যু ছিল রুটিন ঘটনা। অন্যরকমের মৃত্যুর খোঁজও পাওয়া যায় এখানে, যুদ্ধ, মহামারি, দুর্ঘটনা। একটি কবরে নাম খোদাই করা আছে উইলিয়াম ম্যাকে, ‘জুনো’ নামক জাহাজ ডুবে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। এই ঘটনার আদলেই নিজের কাব্যে জাহাজডুবির ছবি এঁকেছিলেন কবি বায়রন।
এহেন মৃত্যুযাত্রার মাঝখানে যদি কুড়ি বছরের এক তরুণীও সামিল হন, তাতে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। তাঁর নাম রোজ আইলমার। ২রা মার্চ, ১৮০০ মৃত্যু ছিনিয়ে নেয় তাঁকে। শোকসন্তপ্ত পরিজনরা এই লাইনগুলি লিখে দিয়েছিলেন কালো মার্বেলের ওপর – “What was her fate? Long before her hour Death called her tender soul by break of bliss/From the first blossoms to the buds of joy/Those few our noxious fate unblasted leaves/In this inclement clime of human life”.
সুদূর ওয়েলসের উপকূলের এক ছোট্ট জনপদে থাকতেন লর্ড আইলমার, তাঁর পরিবার নিয়ে। মেয়ে রোজের বয়স তখন সতেরোর আশেপাশে। একদিন তাঁর বাড়িতে উপস্থিত হলেন বছর একুশের এক যুবক। নাম ওয়াল্টার স্যাভেজ ল্যাণ্ডার, সদ্য অক্সফোর্ড ফেরত। সেটা ১৭৯৭ সাল । ক্রমে আলাপ গাঢ় হল, বাড়ির ভেতরেও স্বচ্ছন্দ গতায়াত হল ল্যাণ্ডরের। অচিরেই রোজের সঙ্গে তাঁর দেখা হল। আঠারো শতকের শেষের ইংল্যাণ্ড বর্তমান পাশ্চাত্য সমাজের মত খোলামেলা অবশ্যই ছিল না তবুও এই তরুণ-তরুণী একান্ত আলাপের অবকাশ খুঁজে পেতেন। এমনটাই জানাচ্ছে H.E.Busteed এর বই-“They seemed to have been thrown much together, in the excursions and similar amusements which their quiet life afforded opportunity for.”
সমুদ্রতীরে কাটানো সেই সময়ের ছবি সুদীর্ঘদিন পরে ধরা পড়েছিল সাহিত্যিক ল্যাণ্ডরের লেখায়। রোজ-ল্যাণ্ডরের সম্পর্ক প্রেম অবধি গড়িয়েছিল কিনা তা জানা যায়নি। তবে এটুকু জানা গিয়েছিল যে অচিরেই বিচ্ছেদ ঘটে দুজনের। আকস্মিক মৃত্যু হয় লর্ড আইলমারের, এরপর লেডি আইলমার অর্থাৎ রোজের মা বিয়ে করেন হাওয়েল প্রাইস নামে এক ব্যক্তিকে। ঠিক এখানে এসেই লেখক Busteed (যাঁর লেখা থেকে বর্তমান রচনার উপাদান নেওয়া হয়েছে) মন্তব্য করেছেন, সম্ভবত মায়ের দ্বিতীয় বিবাহের ফলেই রোজকে ইউরোপ ছেড়ে কলকাতায় পাড়ি দিতে হয়েছিল। তাঁর ইচ্ছে ছিল না নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করার।
ভৌগোলিক দূরত্ব তাঁদের আর কখনও কাছে আসতে দেয়নি। কলকাতায় এসে রোজ উঠলেন তাঁর মাসি লেডি রাসেল এর বাড়িতে। তাঁর স্বামী হেনরি রাসেল ছিলেন ব্যারনেট এবং পরে চিফ জাস্টিস। মার্চের প্রথম সপ্তাহের Calcutta Gazette জানাচ্ছে – “...in the bloom of youth and possessions of every accomplishment that could gladden or embellish life, deplored by her relatives and regretted by a society of which she was the brightest ornament, the Honourable Miss Aylmer.
এই মৃত্যুর কারণ কী? জানা যায় না। তবে ইংরেজি সাহিত্যের বিখ্যাত অধ্যাপক কলভিন মনে করিয়ে দেন ল্যাণ্ডরের লেখা একের পর এক কবিতা যাতে সংলগ্ন হয়ে আছে রোজের সুমধুর স্মৃতি। ‘Three roses’ কবিতাটির সূচনাংশে লেখা-
Till before us up there stood
Briton ferry’s oaken wood,
Whispering, ‘happy as thou art
Happiness and thou must part,”
এ কবিতা অবশ্য ল্যাণ্ডর লিখেছিলেন বহুদিন পর। উননব্বই বছরের সুদীর্ঘ আয়ু পেয়েছিলেন তিনি, পেয়েছিলেন কবি ও প্রাবন্ধিক হিসেবে যশ। তাঁর সাহিত্যরীতির প্রভাব পড়েছিল চার্লস ল্যাম্বের লেখাতেও। রোজের মৃত্যুসংবাদ ওয়েলসে পৌঁছলে স্বভাবতই ভেঙে পড়েন ল্যাণ্ডর। দীর্ঘ অদর্শনের পর রোজের মৃত্যু পুনর্মিলনের সম্ভাবনাকে চিরকালের মতো ধুয়েমুছে দিল। ল্যাণ্ডর লিখলেন একটি ছোট্ট এলিজি, তার চারটি লাইন এরকম-
Rose Aylmer, whom these wakeful eyes
May weep, but never see,
A night of memories and of sighs
I consecrate to thee.
এই চারটি লাইন মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল চার্লস ল্যাম্বকে, একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন ল্যাণ্ডরকে। ল্যাণ্ডর তখনোও শোকে মুহ্যমান। দীর্ঘদিন পর লেখেন ‘Abertway’ নামে আরও একটি কবিতা। ল্যাণ্ডর মনে করতেন রোজের ভারতযাত্রা নিজের ইচ্ছেয় নয়, তাঁর মনও সায় দেয়নি এই বিচ্ছেদে। তাই ‘Abertway’ তে স্পষ্ট ভাষাতেই তুলে ধরেন সেকথা আর লেখেন- Where Ganges rolls his widest wave/She dropped her blossom in the grave. ১৮০০ সালে রোজ কবরের নিচে অন্তিমশয্যায় গেলেও আরো চৌষট্টি বছর বেঁচেছিলেন ল্যাণ্ডর। তাঁর সাহিত্যে অকালপ্রয়াতা রোজ রয়ে গিয়েছেন এক কাব্যপ্রতিমা হয়ে। কাদম্বরীর অকালমৃত্যু রবীন্দ্রমনে যে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা সৃষ্টি করেছিল তেমনই এক যন্ত্রণার রূপ ধরে কবিতা সৃষ্টির পথে ল্যাণ্ডরকে প্রেরণা যোগালেন রোজ আইলমার।
দুশো কুড়ি বছর পরে আজও রোজের কবরটি রয়েছে পার্কস্ট্রিট সেমিট্রিতে। গঙ্গা তো সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সেখান থেকে ছুটে আসে কি সেই ঝোড়ো হাওয়ারা, সোয়া দুশো বছর আগে ওয়েলসের সাগরতীরে যাদের স্পর্শ মেখে রোজ-ল্যাণ্ডর হেঁটে বেড়াতেন?