নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা : 'উপেক্ষিত অভিধান-নায়ক জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস'
.........
বই : উপেক্ষিত অভিধান-নায়ক জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসলেখক : সমীরকুমার ঘোষ প্রকাশক : পেজেস প্রচ্ছদ : দেবাশিস সাহা মূল্য : ২৫০/- টাকা
আগে গেলে কখনও কখনও অমরতা জোটে ঠিকই, তবে বাঘে খাবার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বাংলার প্রথম প্রামাণ্য অভিধানকার জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের কপালে দ্বিতীয়টা জুটেছিল বললে ভুল বলা হয় না। তাঁর প্রাপ্য আলো আত্মসাৎ করে অন্যেরা আলোকিত হয়েছেন এমন অভিযোগ সেকালেও ছিল। সমীরকুমার ঘোষ তাঁর সাম্প্রতিক বইটিতে সেই অভিযোগ ফিরিয়ে এনেছেন। 'বঙ্গীয় শব্দকোষ'-রচয়িতা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে যাঁকে 'পথপ্রদর্শক' বলে মেনেছেন, তাঁর ভাগ্যে হরিচরণের খ্যাতির ছিটেফোঁটাও জুটল না কেন, তা এক রহস্যই বটে। ১৯৩৯ সালে তাঁর মৃত্যুর পর গভীর শোক প্রকাশ করে আনন্দবাজার পত্রিকা তাঁর অভিধানটিকে 'বাঙ্গালার শ্রেষ্ঠ অভিধান' বলে উল্লেখ করেছিল। তা সত্ত্বেও জ্ঞানেন্দ্রমোহন 'পিছিয়ে' পড়লেন?
'বিস্মৃত' শব্দের বাজারমূল্য আজকাল বেশ চড়া। তবে ভরসার কথা, বাজারি গিমিকের বাইরে প্রকৃত অনুসন্ধানের কাজ জারি রেখেছেন কেউ কেউ। গত কয়েক বছর ধরে 'বিস্মৃত বাঙালি' সিরিজ প্রকাশ করে চলেছেন খোয়াবনামা প্রকাশনী। অকালপ্রয়াত শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় জাদুকর গণপতি, গায়ক নিধুবাবু, মল্লবীর গোবর গোহ ও গণিতজ্ঞ রাধানাথ শিকদারকে নিয়ে চারটি বই লিখে গেছেন। সম্প্রতি অর্পণ পাল লিখেছেন সিরিজের পঞ্চম বইটি। চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকারকে নিয়ে। এই ধারায় এক অতি উল্লেখযোগ্য সংযোজন 'উৎস মানুষ' পত্রিকার সম্পাদক সমীরকুমার ঘোষের লেখা 'উপেক্ষিত অভিধান-নায়ক জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস' বইটি। নবীন প্রকাশনা পেজেস গত বইমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে।
জ্ঞানেন্দ্রমোহনের 'বাঙ্গালা ভাষার অভিধান' প্রকাশ পায় ১৯১৭ সালে। শব্দ ছিল ৭৫ হাজারের বেশি। ১ লক্ষ ১৫ হাজার শব্দ নিয়ে দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় কুড়ি বছর পর, ১৯৩৭ সালে। এর বেশ কয়েক বছর পর আমরা পাচ্ছি হরিচরণের কাজ, যা নিজগুণেই অতুলনীয়। কিন্তু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় থেকে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, প্রবাসী পত্রিকা থেকে মডার্ন রিভিউ পত্রিকা, এমনকি হরিচরণ স্বয়ং যাঁর কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন, তাঁর হয়তো এতটা অবহেলা প্রাপ্য ছিল না।
সমীরবাবু ছোট ছোট অধ্যায়ে ভাগ করে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের জীবন, পরিবার, পড়াশোনা, সাহিত্যকর্ম ও অভিধান-রচনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রচুর তথ্য তুলে এনেছেন। তবে আলোচনার ভরকেন্দ্রে আছে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের বঞ্চনা ও তার কারণ-অনুসন্ধান। এতরকম অধ্যায়-বিভাজন প্রয়োজন ছিল কিনা তাই নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। বইয়ের মুড়ো-ল্যাজার বিভিন্ন অংশে জ্ঞানেন্দ্রমোহন বনাম হরিচরণ বিতর্ক নিয়ে বারবার এত কথা খরচ করার দরকার ছিল কিনা, প্রশ্ন তোলা যেতে পারে তাই নিয়েও। কিন্তু লেখকের আত্যন্তিক 'প্যাশন' নিয়ে প্রশ্ন তোলা যাবে না। স্পেনীয় চিত্রনির্মাতা লুইস বুনুয়েলের ছবিতে তাঁর অসম্পাদিত রাগ প্রকাশ পেত। এই বইটি লেখার ক্ষেত্রেও সমীরবাবুর রাগ, ক্ষোভই কাজ করেছে বেশি। এমনকি রবীন্দ্রনাথও বাদ পড়েননি তাঁর নিশানা থেকে। এক জায়গায় তিনি লিখছেন : "এত কিছুর পরেও প্রচারের দৌড়ে জ্ঞানেন্দ্রমোহন কীভাবে পিছিয়ে পড়লেন? এর জন্য কি অনেকাংশে দায়ী রবীন্দ্রনাথ? তাঁর শিবিরের লোক বলেই কি প্রচারের আলো সবটা গিয়ে পড়েছে হরিচরণের মুখে?"
এ-বই নিঃসন্দেহে পাঠককে নতুন ভাবনার খোরাক দেবে। জ্ঞানেন্দ্রমোহন এবং তাঁর সমকালীন বাংলার বিদ্যাচর্চার জগতটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। বইয়ের শেষে সংযোজিত হয়েছে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের লেখা তিনটি মূল্যবান অপ্রকাশিত প্রবন্ধ। সেগুলি উপরি পাওনা।
...............
#জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস #হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় #বঙ্গীয় শব্দকোষ #বাঙ্গালা ভাষার অভিধান #সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় #Pages