ফিচার

যারা সব খুঁজছে পুতুল, মেয়েদের পাড়ায় পাড়ায়

প্রতিভা সরকার Aug 19, 2024 at 7:39 am ফিচার

পুড়ল মেয়ে, উড়ল ছাই
তবে মেয়ের গুণ গাই!

মানে মেয়ে যে ভালো মেয়ে ছিল, তার প্রমাণ তাকে দিয়ে যেতে হবে মরা অবধি। মরার পরে যদি না-কাম পাড়াপড়শি আতশকাচে মন্দ বলার মতো কিছু খুঁজে না পায়, তবে তাকে ভালো মেয়ে বলে সার্টিফিকেট দেবে সমাজ! 

কী আস্পর্ধা এই সমাজের, কী বজ্জাত এই সার্টিফিকেট দেনেওয়ালারা! মেয়ে বলে তারা মানুষ নয়! 


নয়ই তো। মেয়ের শরীরে মন থাকতে নেই, অন্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না থাকলেও চলবে, থাকতে হবে শুধু দুটি স্তন ও একটি যোনি! সবাই যেমন মরে তেমন মরার আগে সে ভোগ্যবস্তু, হ্যাঁ আশি বছর বয়স হলেও কারও কারও কাছে সে তখনও তা-ই থাকে। ধর্ষিত হয়ে, নিষ্ঠুর অত্যাচার সয়ে মরলে সে ধর্ষক-মনোবৃত্তির “মানুষ”-দের কাছে বিনোদন!  


এই কথাগুলো আমি আর জি করের মেয়েটির মৃত্যুতে খেপে গিয়ে বলছি এমন নয়। এই ট্রেন্ড সর্বত্র। গত কয়েকদিন যাবৎ পর্ন সাইটে সবাই হামলে খুঁজে বেড়াচ্ছে মৃত আর জি করের ডাক্তার মেয়েটিকে। গিয়ে দেখতে হয় না, ফেবুতেই ট্রেন্ডের ছবিসহ ঘুরে বেড়াচ্ছে এইরকম রিপোর্ট। আগেও শুনেছিলাম, নির্ভয়া, প্রিয়াঙ্কা, যে যখন ধর্ষিত হয়ে মরছে, সে-ই পর্ন দেখা পুরুষের নয়নমণি হয়ে উঠছে। কী খোঁজে ওরা?  মেয়েটির অত্যাচারিত হবার ভিডিয়ো, নাকি ডিপফেকের সাহায্যে ওই মুখ-বসানো ধর্ষণ-দৃশ্য? মদের গ্লাস হাতে নিয়ে ওই ভিডিয়ো দেখতে দেখতে স্বমেহন কিংবা যৌনতা করা কি এতই আনন্দদায়ক? 

এরা কি কখনও কাকে ভালোবেসেছে?  কাউকে মা ডেকেছে? বোনকে হাত ধরে হাঁটা শেখাবার সময় বোন পড়ে গেলে নিজেও কেঁদেছে? কারও ওষ্ঠাধরে প্রথম চুম্বন এঁকে দেবার সময় আবেগে থরোথরো কেঁপেছে? এরা কি কখনও সন্তানের কপালে চুমো দিয়েছে? এদের কাছে মেয়ে মানেই কি ভোগ্যা! কীভাবে সে মৃত মেয়েকেও মনে মনে ভোগ করে! 

নীল ছবিতে না মজেও অনেক পুরুষ অসংযত হয়। আমাদের ছোটবেলায় শুনতাম পুরুষের নাকি সহজেই চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে, তখন আর সে নিজেকে সামলাতে পারে না। তাই মেয়েদেরই উচিত তার চিত্তচাঞ্চল্যের কারণ না হওয়া। যেসব সাবধানতা নিতে হবে তার মধ্যে আছে চুল খুলে সামনে না যাওয়া, পুরুষ ঘরে ঢুকলে শুয়ে না থাকা, আরও কত কী! উচ্চ কণ্ঠে কথা বলতে নেই, অসংবৃত হয়ে হাসতে নেই৷ কোন বরাহনন্দনের লিঙ্গোত্থান হয়ে যাবে, এই ভয়ে মেয়েরা যেন জবুথবু হয়ে থাকে।  



আমি বড় হয়েছি মফস্‌সলে। সেখানে সালোয়ার কুর্তার সঙ্গে ওড়না ব্যবহার না করলে লোকে অসভ্য বলত। মাকে কথা শুনতে হত। বুকদুটো নিয়ে সব বয়সের মেয়েরা যেন বিব্রত থাকে সেটা সযত্নে শেখানো হত। আমরা কুঁজো হয়ে হাঁটতাম। ফ্রক বানাবার সময় দর্জির হাত বুকে লেগে গেলে নিজেদের অশুচি বোধ হত। লিপস্টিক পরা বারণ ছিল। আর এত সাবধানতার মধ্যেও ধর্ষণের মতো কোনও ঘটনা ঘটে গেলে সযত্নে তা চাপা দেবার চেষ্টা চলত। ধর্ষিতাকে নিজের মেয়ে বা বউ বলে বুক ফুলিয়ে বিচার চাইবার প্রশ্নই ছিল না। মিছিল তো দূরস্থান। আর ছিল না ক্ষতিপূরণ দিতে চাইবার ঔদ্ধত্য। কীসের ক্ষতি?  ওরকম ঘটনাই তো ঘটত না। মাঝখান থেকে মেয়েটি অত্যাচারিত হতেই থাকত। অত্যাচারীটি যদি নিজের ঘরের ভেতরকার লোক হয়, তাহলে তো সোনায় সোহাগা! আর যদি গণধর্ষণের কাণ্ড ঘটত, চেপে না দেওয়া গেলে, হয়তো থানা পুলিশ আদালত অবধি গড়াত কেসটা। কিন্তু তারপর তার ফয়সালা হল কি না, কীভাবে হল, তার খবর কেউ রাখত না। মেয়েটিকে অন্য কোথাও পাচার করে দিলে সব গোল মেটে। না হলে একটি সাজানো আত্মহত্যা, কিংবা স্বেচ্ছায় যাতে করে সেদিকে প্রাণপণে ঠেলে দেওয়া। ওর তো আর কোনও দিন বিয়ে হবে না। ওর বোনগুলোর যাতে হয়, সেই ব্যবস্থা করা আর কি! 


মনে পড়ে, বর্ণালী বিশ্বাস নামে এক নার্সের গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল তার চাকরিস্থলে ভাড়া নেওয়া ঘরের দরজা ভেঙে। মেয়েরা কেন একা থাকবে! 

তার থেকেও বড় কথা, আমরা দুই বন্ধু তখন সদ্য অধ্যাপনার কাজে যোগ দিয়েছি, রিকশা করে যাচ্ছি, শহরের কেন্দ্রে একটি চায়ের দোকান থেকে মন্তব্য উড়ে এল, এইজন্যই তো  বর্ণালী বিশ্বাস কেস হয়। আমাদের দোষ, আমার বন্ধুটি স্লিভলেস ব্লাউজ পরেছিল। আমরা মুখ কালো করে রিকশায় চলে গেলাম, তবে খেয়াল করতে ভুলিনি, রিকশাওয়ালাও মৃদু মৃদু হাসছে। দুই অধ্যাপককে এইভাবে হেনস্থা যে করল, তার মা হয়তো বাড়িতে সেমিজ পরেন। তখন বাড়ির কাজ করার সময় খালি গায়েও থাকতেন অনেক মহিলা। তাহলে এমন তো নয় অনাবৃত বাহুমূল সে দেখেনি। কিংবা ধর্ষণ করার মতো জঘন্য কাজটা সে সাহস করে হয়তো কখনোই করে উঠতে পারবে না। কিন্তু রেপ করে দেব বা রেপের জন্য মেয়েরাই দায়ী, এই মনোভাব থাকতে আপত্তি নেই, এ বহু পুরোনো ব্যাধি। তাপস পালের আগেও এই কথা বহু পুরুষ উচ্চারণ করেছে। উদ্দিষ্ট মহিলা অধ্যাপক, নার্স, কাজের মেয়ে যা খুশি হতে পারে, চাকুরিরতা না হলেও ঠিক আছে, কিন্তু এই চেতাবনি শোনেনি, এমন মেয়ে ভূভারতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। 

তবে সবচেয়ে বেশি শুনেছে, সবচেয়ে বেশি মলেস্টেড হয় বোধহয় ওই কাজের মেয়েরাই। ঘরের চার দেওয়াল তাদের নিরাপত্তা দেবার বদলে, ধর্ষককে নিরাপত্তা দেয়। রাস্তাঘাটও তার জন্য নিরাপদ নয়। অল্পবয়সি কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে ঝুলিয়ে দেওয়া খুব কমন ঘটনা। গরিব বাপ মা আদালত, থানা পুলিশ, বিচারব্যবস্থা বোঝে না। দৌড়োদৌড়ি করতে পারবে না। কয়েক হাজার টাকা জোর করে তাদের হাতে গুঁজে দিলেই হল। 


মেয়েদের হেনস্থার কথা আর কত কব! এ যেন ফুল্লরার বারোমাস্যা। পদে পদে অসম্মান, অপমান। অনেকে দেখছি, মেয়েদের ক্যারাটে শেখানো সর্বরোগহর বলে ধরে নিয়েছেন।  ছেলেই কি মেয়েই কি, ক্যারাটে সবাই শিখতে চাইবে? মারকুটেমি অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে। তারা ওই সময়টায় গান করতে চাইতে পারে,  ছবি আঁকা বা সেলাই করা। তাতে অপরাধ হয়ে যাবে?  এরপরে হয়তো ‘এইজন্য ধর্ষণ হয়’-এর লিস্টে “ক্যারাটে শেখাননি কেন”-ও ঢুকে যাবে। 

আর-একটা রব উঠেছে ছেলেকে শেখান। মানে মায়েদেরই সে দায়িত্ব। কিছুদূর অবধি ঠিক। শুনতেও ভালো। কিন্তু কীভাবে মা পারবে, যখন অন্য নারীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকা বাবাটি দামি দামি ঘুষ দিয়ে সন্তানকে হাতে রাখে?  একটা দামি মোবাইলের লোভ বড়রাই ছাড়তে পারে না, তায় বাচ্চারা!  মহিলা কমিশনে লোক আদালতে এক মাকে ঠিক এই কথাটাই বলে কাঁদতে দেখেছি। সে গৃহবধূ। ঘুষ দিতে পারবে না। আর পারলেও সেটা কি খুব সুস্থ উদাহরণ হত?  এই পরিস্থিতিতে কুচবিহার থেকে একটি মেয়ে যখন লেখে, “আমার মতো মেয়েকে জন্মানোর আগেই মেরে দেওয়া ভালো, পরে তো সেই তিলে তিলে মরতেই হবে”, তখন তাকে চিয়ার আপ করার আগে এক মুহূর্ত চুপ করে থাকি। 

যাই হোক, অনেক কথা বললাম আন্তরিক ক্ষোভে। আরও বলার আছে এত, যে, তার কোনও শেষ নেই। ধর্ষিতার ছবি, নাম শেয়ার হচ্ছে দেদার। আইনে বারণ। একজনকে বললাম, মেয়েটির ছবি শেয়ার করছেন!  তিনি উত্তর দিলেন, তো? না জানলে লোকে জিজ্ঞাসা করে কেন বারণ করছ?  এইরকম দাপটে “তো” বলে না। আমরা এইরকম।  এই সমাজের খামতিগুলোর পেছনে বেশিটাই নর থাকলে, নারীর অবদান একেবারেই নেই এমন নয়! আমাদের লক্ষ্য হোক স্বনির্ভরতা, আমাদের জ্ঞান প্রসারিত হোক আইনি ক্ষেত্রেও, আমাদের ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠুক এমনই, যেন কুঁজো হয়ে না চলতে হয় কাউকে। 

আপাতত রাতের ঘুমে ফিরে আসুক সেই সুকুমারীর মুখ। অপরূপ সুন্দরী নয় বলে পর্নখেকোরা “ওকে আবার কে রেপ করবে” বলে হ্যাটা করছে, করুক। আমার কাছে ওর হাসিটি বড় সুন্দর, ওর মাথায় গোঁজা ফুলটি যেন পারিজাত! তোমাকে নিরাপত্তা দিতে পারিনি মা, এ আমাদের সবার পাপ। প্রাণপণ চেষ্টা করে যে ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক বা যা কিছু হয়, আমরা তার রূপ দেখি, জাত দেখি, তার রক্তাক্ত মৃতদেহকে কামনার বিষয়বস্ত বানাই, আমরা মহাপাপী! 

• শিরোনাম ঋণ: শঙ্খ ঘোষ     

অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র এবং বিবস্বান

আরও পড়ুন :   যে রাষ্ট্র মেয়েদের দায়িত্ব নেয় না, আমরাও কি তার ধারক নই?/ বিবস্বান

                    যে আর জি কর-কে চিনতাম, আর যাকে চিনি না/ ব্রতেশ

                    আমাদের মিছিল/ জুঁই নিয়োগী

                    অ্যাবিউজের যে দীর্ঘ দিনলিপি আমরা জানি/ যশোধরা রায়চৌধুরী

                    আমাদের পরিবারেই বেড়ে ওঠে ধর্ষক/ সায়নদীপ গুপ্ত

                    চিন্তা নেই, পিএইচডি হয়ে যাবে!/ বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

                    পুরুষ থেকে ধর্ষকের মাঝে যেটুকু ফারাক/ শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী

                     মিছিলে পা মেলান, তবে মনে রাখুন…/মুনিয়া দেবলীনা

                     অন্ধকার পথে একলা হাঁটার স্বাধীনতা চেয়ে…/অঙ্কিতা ভট্টাচার্য

#we want justice #R G Kar #reclaim the night #স্পর্ধা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

91

Unique Visitors

207056