অনিদ্রার উৎস উদরে?
কথায় বলে, কোনও মানুষের হৃদয়ে পৌঁছনোর সহজতম রাস্তা তাঁর পেটের ভিতর দিয়ে। কাউকে খাইয়ে তুষ্ট করার এই পদ্ধতির সঙ্গে শারীরবৃত্তীয় কোনও সত্যের সম্পর্ক আছে, এমন দাবি কেউ করবেন না। অথচ সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা বলছেন, পেটের সঙ্গে খুব গূঢ় যোগাযোগ আছে মস্তিষ্কের, বলা ভালো ঘুমের।
ঘুম সম্ভবত আমাদের সবচাইতে প্রিয় প্রক্রিয়া। একটা ক্লান্তিকর সপ্তাহের শেষেই হোক কিংবা ব্যস্ত কাজের দিন, পিঠকে একটু আরাম দিয়ে দুমিনিটের জন্য হলেও গড়িয়ে নিতে আপত্তি করবেন, এমন মানুষ পাওয়া বিরল। তবে শুধু প্রিয়ই নয়, ঘুম আমাদের শরীরের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রক্রিয়াও বটে। নিয়মিত ঠিকমতো ঘুম না হলে ক্লান্তি, অবসাদ, শারীরিক অসুস্থতা ঘিরে ধরে সহজেই, এমনকি একটানা ঘুম ছাড়া কাটানোর ফলে প্রাণহানির আশঙ্কাও হতে পারে। কারণটা সহজেই অনুমেয়; সারাদিন ধরে আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম, ভাবনাচিন্তা, অনুভূতিকে সচল রাখার দায়িত্ব পালন করে যে অঙ্গটি, সেই মস্তিষ্কের একটা সময়ে বিশ্রাম প্রয়োজন হয় বৈকি। শুনতে সহজ হলেও এমন তত্ত্বকে বিজ্ঞানের আলোয় ফেললে একগুচ্ছ ধাঁধা প্রতিফলিত হয়। আচ্ছা, আদিম প্রস্তরযুগে তো মানুষের শিকার করা আর খাওয়া ছাড়া বিশেষ কোনও কাজ ছিল না, মাঝেমধ্যে অন্য গোষ্ঠীর সঙ্গে মারপিট লাগলে আলাদা কথা। কিন্তু আধুনিক যুগের কর্মব্যস্ততা, বুদ্ধির ক্রমাগত প্রয়োগ, ভাষার ব্যবহার – কিছুই তো ছিল না। তাহলে তাদের শরীরে ঘুমের প্রয়োজন হত কেন? আজকের তুলনায় সে ঘুম কী কিছু কম হলেও চলত? জীবের বিবর্তনের হদিস অনেকাংশে পাওয়া গেলেও ঘুমের বিবর্তনের গল্প আজও অনেকটাই অজানা। মস্তিষ্কই যে আমাদের প্রধান চালক অঙ্গ একথা সবাই মানি, আর তাই হয়ত ফাঁক রয়ে যায় অন্য অঙ্গগুলির গুরুত্ব বুঝতে। ঘুম যে শুধু মস্তিষ্ক ও তার শাখাপ্রশাখা নিউরনের জন্যই নয়, শরীরের বাকি অংশের জন্যও জরুরি, হালে সেকথা জানা যাচ্ছে।
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের অধ্যাপক ড্রাগানা রোগুইয়া বিগত কয়েক বছর ধরে কাজ করে চলেছেন এমনই কিছু অজানা প্রশ্নের উত্তরের খোঁজে। তাঁর গবেষকদলের বহুবিধ মাথাব্যথার মধ্যে অন্যতম দুটি বিষয় – আমাদের বেঁচে থাকার জন্য ঘুম এত জরুরি কেন? কীভাবে ঘুমের সময়ে সদাসচল মগজখানা দিব্যি বহির্বিশ্বের সব কোলাহল থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেয়? সাধারণ সময়ে আমরা টোকা মারলে সাড়া দিই, অথচ ঘুমের সময়ে অন্তত ধাক্কা না মারলে নড়ে উঠব না। সেই একই মগজ, একই তার সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা, কিন্তু ঘুমের সময়ে সে আস্ত একখানা দেওয়াল তুলে দেয়! ঘুমের সে চালচলন বুঝতে তাঁরা পরীক্ষা চালান ইঁদুর আর ড্রসোফিলা মাছির উপরে। খোলা জায়গায় ফল বা অন্যান্য খাবার রেখে দিলে একরকম খুদে খুদে পোকার আনাগোনা দেখা যায়, বিজ্ঞানের পরিভাষায় তাদেরকেই বলে ড্রসোফিলা বা ফ্রুটফ্লাই। জীবদেহে গবেষণার প্রাথমিক ধাপের মডেল প্রাণী হিসেবে এরা দুজনেই বেশ বিখ্যাত। তা এদের উপর গবেষণা চালিয়ে ড্রাগানা ও তাঁর সহকর্মীরা দেখেছেন, একটানা কম ঘুম বা ঘুমহীন অবস্থায় থাকা প্রাণীদের আয়ু নিয়মিত ঘুমোতে পাওয়া প্রাণীদের তুলনায় বেশ কম। বিভিন্ন রকম উত্তেজনা দিয়ে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটিয়ে তাঁরা দেখেছেন, কী কারণে ঘুম হচ্ছে না তা গৌণ, ঘুম হচ্ছে না এইটাই আয়ুক্ষয়ের আসল কারণ।
ব্যাপারটা আরও ভালো করে বোঝার জন্য তাঁরা ড্রসোফিলার শরীরে ঢুকিয়ে দিয়েছেন একরকম রঞ্জকের মিশ্রণ। সে মিশ্রণ শরীরের কোনও ক্ষতি করে না, বরং বিভিন্ন অঙ্গের কোশে কোনোরকম ক্ষয়ক্ষতি হলে সেটাকেই রাঙিয়ে তোলে। এইবার সেই ড্রসোফিলাদের ঘুমের সর্বনাশ ঘটলে দেখা যায়, তাদের পেটের মধ্যে অক্সিড্যান্টের (অক্সিডেশন বা জারণে সক্রিয় অণু) পরিমাণ বেড়ে গিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা! একই পরীক্ষা করা হল ইঁদুরেও, ফলাফল একই। অক্সিড্যান্টের প্রতিষেধকের নাম আর গুরুত্বটা আমরা কমবেশি সকলেই জানি খবরের কাগজ আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে – অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট। স্বাভাবিক অবস্থায় শরীর তার প্রয়োজনীয় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট জোগাড় করে নেয় দৈনন্দিন খাবার থেকে, কিন্তু অক্সিড্যান্টের পরিমাণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেলে তার একার আর কিছু করার থাকে না। বিজ্ঞানীরা করলেন কী, পরীক্ষিত প্রাণীগুলোর একদলকে খানিক অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট খাওয়ালেন, আরেকদলের পেটে নিজস্ব অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট উৎপাদনকারী ব্যবস্থাটাকেই জেনেটিক কারিকুরির মাধ্যমে কিছুটা চাঙ্গা করে দিলেন। দেখা গেল, দুই ক্ষেত্রেই প্রাণীরা ঘুমের ব্যাঘাতের সঙ্গে লড়ে দিব্যি টিকে যাচ্ছে। অর্থাৎ অন্ত্রের মধ্যে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট বাড়াতে পারলে অনিদ্রার একটা জুতসই জবাব পাওয়া যেতে পারে!
গল্প এখানেই শেষ নয়। ড্রাগানা ও তাঁর দলবল মিলে লঘু থেকে গুরু, বিভিন্ন রকম কম্পনতরঙ্গ দিয়ে ঘুমের দফারফা করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন; ঠিক যেমন ঘুমের মধ্যে টোকা দিলে আপনার কিছুই বোধ হবে না, ঠেলা দিলে “উঁ” বলে পাশ ফিরবেন আর কষিয়ে থাপ্পড় মারলে “তবে রে” বলে জেগে উঠবেন, তেমনই বিভিন্ন রকম কম্পনে ড্রসোফিলাদের ঘুমের ব্যাঘাতেরও রকমফের হচ্ছিল। বিজ্ঞানীরা যখন এইসব মাছিদের জেনেটিক পরীক্ষা করলেন, তখন দেখলেন ঘুমের মধ্যে কোন মাত্রার উদ্দীপনায় সাড়া দেব আর কোনটায় দেব না, সেইটা ঠিক করে দিচ্ছে একাধিক জিন। তাদের অন্যতম সদস্য জিনটি তৈরি করে একটি পেপটাইড (প্রোটিনের খুদে সংস্করণ) – CCHa1। কোনোভাবে যদি CCHa1-কে নষ্ট করে দেওয়া যায়, কম মাত্রার কম্পনেও ড্রসোফিলাদের ঘুমের বারোটা বেজে যায়। মজার ব্যাপার, এই CCHa1 শুধু কম্পনের ক্ষেত্রেই কার্যকরী, উষ্ণতা বা অন্যান্য উদ্দীপনায় ইনি বিশেষ গা করেন না। আবার স্নায়ু এবং অন্ত্র দুজায়গাতেই থাকলেও, অন্ত্রের কোশে থাকা CCHa1 নষ্ট হলে অনিদ্রার পরিমাণ মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে! অন্ত্রের যেসব কোশে CCHa1 তৈরি হয় তাদের কাজই হল স্নায়ুকোশের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা, আর দৈনন্দিন খাবারে প্রোটিনের পরিমাণ বাড়লে অন্ত্রে CCHa1-এর পরিমাণও বাড়ে। ফলত ঘুম হয় আরও গভীর, সুখকর এবং স্বাস্থ্যকর।
তাহলে মোদ্দা কথাখানা কী দাঁড়াল? প্রচুর প্রোটিন খেলে ঘুম ভালো হবে? উঁহু, সে নিদান দেওয়ার দিল্লি এখনও অনেক দূর। কিন্তু সুষম খাদ্য যে ঘুমের অন্যতম নিয়ন্ত্রক, সেই কথা এর আগে এত পরিষ্কার করে বোঝা যায়নি। কোন পথে, কীভাবে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা থেকে শরীর নিজেই নিজেকে রক্ষা করে, জানা ছিল না সেই উত্তরও। ড্রাগানা ও তাঁর সহকর্মীরা হয়ত আমার-আপনার জীবন পাল্টে দেওয়ার মত সাঙ্ঘাতিক কিছু আবিষ্কার করেননি, কিন্তু পেট ভালো রাখলেই যে রাতের ঘুম, এবং তার সঙ্গে শরীর ভালো থাকবে, সেই আপ্তবাক্যটিকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছেন।
.................
তথ্যসূত্র : A gut-secreted peptide suppresses arousability from sleep, Cell, 2023