কোন পথে চলেছে আমাদের প্রযুক্তিচালিত ভবিষ্যৎ, তা নিয়ে আস্ত বই
....................
..............................
বই : ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ
লেখক : গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশনা : পঞ্চালিকা
প্রকাশকাল : আগস্ট ২০২২
দাম: ২৫০/-
..............................
হাতের মুঠো আজকাল ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মোবাইল নামক জীবন্ত বস্তুটিকে হাতের মধ্যে অনুভব করতে না পারলে। ওর মধ্যেকার অজস্র হাবিজাবি অ্যাপ, সেগুলির কায়দাকানুন বা সেগুলি দিয়ে যে কাজগুলো করতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি; তা যে আমাদেরকে প্রতিনিয়ত ব্যস্ত করে রেখেছে, এ আমরা একটু ভাবলেই টের পাই। এই যুগ তথ্য-প্রযুক্তির যুগ, এমন একটা কথাও আমাদের কানে আসে। প্রযুক্তি আমাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে, এর হাত থেকে সহজে নিস্তার পাওয়া যাবে বলেও তো মনে হয় না।
এই প্রযুক্তি (যার ইংরেজি প্রতিশব্দ টেকনোলজি) তার রূপ এত দ্রুত বদলে ফেলছে, এর সঙ্গে তাল মেলানো অনেকের কাছেই হয়ে উঠছে দুষ্কর। মোবাইলের যে উদাহরণ দিলাম একটু আগে, সেই যন্ত্রটিই গত কয়েক বছরে কতটা বদলেছে ভেতরে-বাইরে, তা দেখেই অনুমান করা চলে, প্রযুক্তি কতটা এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। বছর পাঁচেক যদি কেউ এই সবকিছু থেকে দূরে থাকেন (যেটা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না, তবু কল্পনা করা যাক) তবে তিনি ফিরে এসে যে পরিবর্তনগুলি দেখবেন চারপাশে, তাঁর পক্ষে সেসবে অভ্যস্ত হতে অনেকটা সময় যাবে।
সুতরাং, প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবা খুব কঠিন। আগামী দিনে কী ধরনের পরিবর্তন বা উন্নতি ঘটতে চলেছে প্রযুক্তিনির্ভর নানা ক্ষেত্রে, তা নিয়ে আলোচনা করা কঠিন এই কারণে যে কেউই সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু তেমন বলে উঠতে পারেন না। দু-চার বছরের মধ্যে কী ধরনের ব্যাপার ঘটতে চলেছে তা হয়ত কিছুটা বলা যায়, কিন্তু আগামী পনেরো বা কুড়ি বছর পর পৃথিবীর বুকে এই মানুষ-কৃত সভ্যতার চালচিত্রে নানারকম প্রযুক্তির রূপ ঠিক কেমন হবে, সে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারবেন না কেউই। তবে নিশ্চিত করে না বলা গেলেও, সব দিকে না হলেও কিছু ক্ষেত্রে অন্তত একটা রূপরেখা এঁকে দেখাতে পারেন বিশেষজ্ঞরা। যেমন চিকিৎসাব্যবস্থা, মহাকাশ-অভিযান বা আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্যের কিছু দিক— পুরোপুরি না হলেও এই সব ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের মানুষ কী ধরনের সুবিধে পেতে পারেন, তা বলা সম্ভব। আগামী কয়েক বছর পর চাদের বুকে আবার নামবে মানুষ, বা মঙ্গলের বুকে সবুজ উদ্ভিদের চাষ করা শুরু হবে, এরকম কিছু পরিকল্পনার কথা দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞানের টাটকা খবর জাতীয় পাতায় হামেশাই প্রকাশ পায়। কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড বা রবোটিক হাতের মতো প্রযুক্তিচালিত উন্নত সুবিধেও চলে আসছে আমাদের নাগালেই, এমন আশ্বাসও পাই। সুতরাং প্রযুক্তির আগামী দিন যে অনেকটাই রোমাঞ্চকর হয়ে উঠছে, এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
এইরকম কিছু ভবিষ্যতের প্রযুক্তির রূপরেখা নিয়ে বেশ ভালোরকম আন্দাজ পাওয়া গেল একটি বই পড়তে পড়তে। একেবারে হাতেগরম টাটকা বই, (বিষয় যেখানে প্রযুক্তি সেখানে বাসি বই পড়া আর পুরনো সিনেমার রিভিউ পড়া একই ব্যাপার) এই আগস্ট মাসেই প্রকাশিত হয়েছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলায় বিজ্ঞান-সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবার প্রচেষ্টায় সাধনারত, এই বই সেই সাধনার পথে একটা নজরে পড়বার মতো ধাপ।
প্রকাশনাটিও নতুন, নাম পঞ্চালিকা। রাহুল ভট্টাচার্য বেশ উদ্যমী প্রকাশক, কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি বেশ কয়েকটি চোখে পড়বার মতো বই প্রকাশ করে বাংলা প্রকাশনায় নজরে এসেছেন। সুন্দর ছিমছাম সাদার ওপর ভিত্তি করে বানানো প্রচ্ছদ (অক্ষরবৃত্ত-এর নির্মাণ) দেখলে বইটি পড়তে শুরু করবার ইচ্ছে জেগে ওঠে। যার ফল, একটানা দু-দিন ধরে পড়ে বইটি শেষ করে ফেলা। এবং এই পাঠ প্রতিক্রিয়াটি লিখতে বসা।
১৭৪ পাতার বইটিতে তিনটি বড় বড় অধ্যায়, তিনটিই স্বয়ং-সম্পূর্ণ। ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ক্লোনিং ও জিন টেলরিং’, ‘নতুন যুগের নানা প্রযুক্তি’ এবং ‘মহাকাশ ও মহাকাশ প্রযুক্তি’। নামেই মালুম, প্রথমটিতে আলোচিত হয়েছে ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ নামে যাকে আমরা জানি, সেই বিষয়টি। কৃত্রিম বুদ্ধিবিশিষ্ট কোনো যন্ত্র যদি সত্যিই তৈরি হয় কখনও, তারা কি দখল করবে মানবসভ্যতা? আমরা কি হয়ে উঠব তাদের হাতের পুতুল? এ ভাবনা অনেকের। অন্যদিকে সত্যিই কি আগামী দিনে এই ধরনের কিছু নির্মিত হতে পারে? হলে আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠবে না তো? আর আগামীদিনই বা কেন, এই আমলেও কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দেখা যায় না কোথাও? এই সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে এই লেখায়।
‘ক্লোনিং’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের পরিচয় আছে অনেকেরই। কোনো প্রাণির দেহকোশ থেকে ক্রোমোজোম নিয়ে তা থেকে একই ধরনের নতুন প্রাণির জন্ম দেওয়া হল ক্লোন তৈরির মূল পদ্ধতি। কোনো বিশেষ মানুষের দেহ থেকে নেওয়া ক্রোমোজোম কাজে লাগিয়ে একেবারে সেই মানুষটির মতো জিনগত বৈশিষ্ট্যযুক্ত নতুন মানুষ জন্ম দেওয়া যাবে, এই হল ক্লোন করবার পিছনে আসল উদ্দেশ্য। যদিও নৈতিক এবং অন্য কিছু কারণে মানুষের ক্লোন এখনও করা না গেলেও আগামী দিনে তা করা যাবে কি না, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না কেউই। ক্লোনিং-এর ইতিবৃত্ত এই বইয়ে দারুণ করে বোঝানো হয়েছে।
তবে এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ আমার যেটা মনে হয়েছে তা হল তৃতীয় অধ্যায়টি, যেখানে আলোচনা করা হয়েছে মহাকাশে বিভিন্ন গ্রহে বা উপগ্রহে মানুষের উপনিবেশ স্থাপনা করবার সুবিধে-অসুবিধের দিকটি নিয়ে। অদূর ভবিষ্যতে এই গ্রহে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়লে মহাবিশ্ব থেকেই উধাও হয়ে যেতে পারে মানবপ্রজাতি, এই আশঙ্কায় স্টিফেন হকিং-এর মতো অনেকেই অন্য গ্রহে বসতি স্থাপনের কথা চিন্তাভাবনা করছেন। কিন্তু খরচের ধাক্কা আর নানাবিধ অসুবিধেকে জয় করার কথা চিন্তা করে কীভাবে বাস্তবে ভবিষ্যতে মঙ্গল বা শুক্র বা চাঁদের বুকে অল্প করে হলেও মানুষের থাকবার মতো ব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে, এই আলোচনাটি সত্যিই আমাদের অনেক সমৃদ্ধ করে। স্বল্পপাল্লার মহাকাশে পাড়ি জমানো আগামিদিনে স্বপ্ন থেকে বাস্তব হয়ে উঠতে পারে, এই সম্ভাবনা আমাদের পুলকিত না করে পারে না।
সব মিলিয়ে এই বইটিকে ‘মাস্ট রিড’-এর পর্যায়ে ফেলা চলে। ছাপার ভুল খুব কম, ছোট ছোট ছবিও দেওয়া আছে দরকারমতো। এই যে আজকাল ইন্টারনেট বা অন্যত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, তাকে নিজের মতো করে সাজিয়ে বিজ্ঞানীদের জীবনভিত্তিক গদ্য নির্মাণের কাজে নিয়োজিত হতে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন তরুণ লেখককে; এই বই তাঁদের কাছে দিশা দেখাবে, কোন ধরনের ভাষাভঙ্গি আর শৈলী বজায় রাখতে হয় জনপ্রিয় গদ্য লেখবার সময়। বিজ্ঞানের তত্ত্ব আর তথ্যকে নির্ভার, সহজপাঠ্য গদ্যে কীভাবে উপস্থাপিত করতে হয় সে শিক্ষা যদি আমরা এই ধরনের বই থেকে গ্রহণ করতে পারি তবেই এই বইয়ের সার্থকতা। তবে দুঃখের ব্যাপার হল এই ধরনের বইয়ের প্রচার কম, পাঠক কম; আর প্রকাশকের তরফে এরকম বই প্রকাশ করবার উৎসাহও কম। আগামী দিনে যদি বাংলায় বিজ্ঞান-সাহিত্য প্রকাশে আরও বেশি করে এগিয়ে আসেন তাঁরা, এই ক্ষীণ ধারাটি আরও বেশি করে বেগবান হয়ে উঠতে পারে। সাধারণ মানুষের কাছে বেশি করে এই ধরনের বই না পৌঁছে দিতে পারলে তাঁরা মহাভারতের যুগে সত্যিই টিভি আর এরোপ্লেন ছিল, এই বিশ্বাসেই স্থিত থাকবেন। আধুনিক বিজ্ঞান তাঁদের কাছে পৌঁছবেই না।
..................
#Technology #প্রযুক্তি #বই রিভিউ